ডেঙ্গুর সঙ্গে যুদ্ধ করা কঠিন, প্রয়োজন সচেতনতা

প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২১; সময়: ১০:১৭ পূর্বাহ্ণ |
ডেঙ্গুর সঙ্গে যুদ্ধ করা কঠিন, প্রয়োজন সচেতনতা

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ তুলনামূলক কমে এসেছে। তবে বেড়েছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রকোপ। বর্ষার শুরু থেকে এটি যেন অসহনীয় পর্যায়ে ঠেকেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, এখন পর্যন্ত (১ অক্টোবর) ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৮ হাজার ৩৬২ জন। মৃত্যু হয়েছে ৬৮ জনের।

দেশে ডেঙ্গুর সার্বিক পরিস্থিতি, সংক্রমণ না কমার কারণ, সংক্রমণ ও মৃত্যু রোধে করণীয় নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেন ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিশেষজ্ঞ এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক।

ডা. আশরাফুল হক : আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গুর সঙ্গে যুদ্ধ করা কঠিন। বলা হয়, যে দেশে ডেঙ্গু প্রবেশ করেছে সে দেশকে কখনও-ই ডেঙ্গুমুক্ত করা সম্ভব নয়। অনেকটা আবহাওয়াজনিত কারণে এটি হয়। আমরা জানি, ডেঙ্গুর বাহক হলো এডিস মশা। এ মশার জীবনচক্র অনুসন্ধান করে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, যখন তীব্র গরমে হঠাৎ বৃষ্টিপাত হয় কিংবা বৃষ্টিপাতের পর গরম পড়ে, তখন লার্ভা থেকে পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হওয়ার স্বাভাবিক যে সময়, সেটির পরিবর্তন হয়।

ছোট বাচ্চা, গর্ভবতী মাসহ যারা ডেঙ্গুর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় থাকেন, তাদের জন্য মশানাশক ওষুধ ব্যবহার বাধ্যতামূলক ।

লার্ভা দশা থেকে পূর্ণ মশায় পরিণত হতে স্বাভাবিকভাবে যে সময়টা প্রয়োজন হয়, হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে তা আড়াইশ গুণ কমে যায়।

অর্থাৎ, লার্ভা থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা হতে স্বাভাবিকভাবে চার দিন সময় লাগলেও এক্ষেত্রে তা মাত্র চার ঘণ্টায় হয়ে যায়। এ কারণে ডেঙ্গুর সঙ্গে যুদ্ধ করা কঠিন বলেন ডা. আশরাফুল হক, ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিশেষজ্ঞ ।

এর মাধ্যমে তারা বুঝিয়েছেন, লার্ভা দশা থেকে পূর্ণ মশায় পরিণত হতে স্বাভাবিকভাবে যে সময়টা প্রয়োজন হয়, হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে তা আড়াইশ গুণ কমে যায়। অর্থাৎ, লার্ভা থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা হতে স্বাভাবিকভাবে চার দিন সময় লাগলেও এক্ষেত্রে তা মাত্র চার ঘণ্টায় হয়ে যায়।

ডা. আশরাফুল হক : ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে আমাদের প্রত্যেককেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। বাড়ির আঙিনা, ফুলের টব থেকে শুরু করে কোথাও যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সিঙ্গাপুর এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর, তারপরও তাদের ডেঙ্গু নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। এক্ষেত্রে বলব, সচেতন থাকাটাই বেশি জরুরি। ছোট বাচ্চা, গর্ভবতী মাসহ যারা ডেঙ্গুর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় থাকেন, তাদের জন্য সবচেয়ে বেশি নিরাপদ হবে মশানাশক ওষুধ ব্যবহার।

ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গুর সঙ্গে যুদ্ধ করা কঠিন— বলছেন বিশেষজ্ঞরা ।

ডা. আশরাফুল হক : ইনফ্লুয়েঞ্জা, ভাইরাসজনিতসহ বিভিন্ন কারণে আমাদের প্রায়ই জ্বর হয়। এ জ্বরকে আমরা গুরুত্ব দিই না। আমরা ভাবি, তিন দিনের জ্বর তো স্বাভাবিক, হয়তো ভালো হয়ে গেছি।

এরপর আমরা কাজে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করি এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় চলে আসি। কিন্তু যখন আমাদের ডেঙ্গু হয়, তখন কিন্তু আমাদের প্রথম তিন দিন শরীরে জ্বর থাকে। এরপর জ্বর ছেড়ে যায়। কিন্তু এ সময় শরীর আরও দুর্বল হতে থাকে এবং রক্তের প্লাটিলেট কমে যায়। অনেক সময় প্লাটিলেটের মাত্রা অস্বাভাবিক নিচে নেমে যায়। তখনই শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ হতে থাকে।

শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সিঙ্গাপুর এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর, তারপরও তাদের ডেঙ্গু নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। এক্ষেত্রে বলব, সচেতন থাকাটাই বেশি জরুরি । দেখা যায়, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দিব্যি চলাচল করছেন। হঠাৎ করে যখন প্রেশার কমে যায়, তিনি দুর্বল অনুভব করেন। ছুটে আসেন চিকিৎসকের কাছে। তখন দেখা যায়, প্রেশার অনেকটাই কমে গেছে। যেটাকে আমরা বলি শকড।

এদিকে, রোগীর প্লাটিলেট অনেক কমে যাওয়ায় শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্তক্ষরণ দেখা দেয়।

আমরা যা দেখি তার বাইরেও ব্রেন ও হার্টসহ অনেক জায়গায় রক্তক্ষরণ হতে পারে। রক্তক্ষরণ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রোগীর মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই কোনো জ্বরকেই অবহেলা করা উচিত নয়।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য প্রশাসন ব্যাপক সচেতনতার বার্তা প্রচার করতে পারে। জ্বর হলেই প্রাথমিকভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। স্বাস্থ্য প্রশাসনকে বলতে হবে, এসব জায়গায় পরীক্ষা করানো যাচ্ছে। তাহলে মানুষ সচেতনভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে উদ্বুদ্ধ হবে। ২০১৯ সালে ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু এ বছর করোনার কারণে ডেঙ্গু মাথায় ছিল না। ফলে ভুক্তভোগী হচ্ছেন অনেকেই।

তিন দিনের জ্বর তো স্বাভাবিক, হয়তো ভালো হয়ে গেছি। এরপর আমরা কাজে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করি এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় চলে আসি। কিন্তু যখন আমাদের ডেঙ্গু হয়, তখন কিন্তু আমাদের প্রথম তিন দিন শরীরে জ্বর থাকে। এরপর জ্বর ছেড়ে যায়। কিন্তু এ সময় শরীর আরও দুর্বল হতে থাকে এবং রক্তের প্লাটিলেট কমে যায় । ডেঙ্গু নিয়ে বছরব্যাপী আমাদের সচেতন থাকা উচিত। এটি যেন আমাদের অভ্যাসের ভেতরে চলে আসে। অভ্যাসের ভেতরে এলেই আমরা ডেঙ্গু থেকে কিছুটা রেহাই পাব। ডেঙ্গুতে যেন মৃত্যু না হয়, বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।

ডা. আশরাফুল হক : আমরা আসলে যে ধরনের যান্ত্রিক জীবনযাপন করি, আমাদের প্রায়ই কোমর, ঘাড় ও পেটে ব্যথা হয়। কারণ, আমরা অনেক বেশি মাত্রায় মোবাইল ও ল্যাপটপ ব্যবহার করি।

যখন ডেঙ্গু জ্বর হয়, তখন এসব ব্যথা অনুভব করি। সুতরাং জ্বর ১০১ ডিগ্রি ছাড়ালে এবং সঙ্গে এসব উপসর্গ দেখা দিলে ধরে নিতে হবে যে ডেঙ্গু হতে পারে। তখনই সচেতন হতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। কোনো কিছুকে অবহেলা করা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায়।

ডেঙ্গু পরীক্ষায় মান নিয়ন্ত্রণের একটি বিষয় আছে। যেহেতু মানহীন ডিভাইস ব্যবহারের সুযোগ অনেকেই তৈরি করে থাকে, সেক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো যদি নজরদারি আরও জোরদার করে তাহলে মানুষ সহজেই মানসম্মত রিপোর্ট পাবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। রোগীর প্লাটিলেট অনেক কমে যাওয়ায় শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্তক্ষরণ দেখা দেয়। আমরা যা দেখি তার বাইরেও ব্রেন ও হার্টসহ অনেক জায়গায় রক্তক্ষরণ হতে পারে। রক্তক্ষরণ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রোগীর মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই কোনো জ্বরকেই অবহেলা করা উচিত নয় ।

ডা. আশরাফুল হক : ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে সবারই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। চিকিৎসকই সিদ্ধান্ত নেবেন যে তিনি কখন প্লাটিলেট জোগাড় করার জন্য রোগীকে বা রোগীর স্বজনকে বলবেন। সেক্ষেত্রে যখন রক্তপাত শুরু হয়, তখন প্লাটিলেটের মাত্রা যতই থাকুক না কেন, চিকিৎসক প্লাটিলেট দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করতে পারেন বা ব্যবস্থা নিতে পারেন। প্লাটিলেট কাউন্ট যতক্ষণ ১০ হাজারের নিচে না আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী নিরাপদ।

গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৬৮ জনের— স্বাস্থ্য অধিদফতর ।

ডা. আশরাফুল হক : যেখানে মানুষের প্লাটিলেট তৈরি হয়, ডেঙ্গু সেখানকার স্বাভাবিক কাজ বন্ধ করে দেয়। এ কারণে প্লাটিলেট সংকট দেখা দেয়।

এক্ষেত্রে গতানুগতিক যে চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে, সেগুলো চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি আমরা যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করি, সেটি ডাবের পানি হোক বা অন্য যেকোনো পানি; অথবা প্রতিদিন যে পরিমাণ প্রোটিনের দরকার, তা যদি নেওয়া যায় তাহলে কোনো সমস্যা হয় না।

জ্বর হলেই প্রাথমিকভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। স্বাস্থ্য প্রশাসনকে বলতে হবে, এসব জায়গায় পরীক্ষা করানো যাচ্ছে। তাহলে মানুষ সচেতনভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে উদ্বুদ্ধ হবে। ২০১৯ সালে ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু এ বছর করোনার কারণে ডেঙ্গু মাথায় ছিল না। ফলে ভুক্তভোগী হচ্ছেন অনেকেই ।

আমরা কীভাবে বুঝব? আমাদের যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ ইউরিন (প্রস্রাব) নিঃসরিত হয়, তাহলে বুঝতে পারব যে আমাদের শরীরের চাহিদা অনুযায়ী প্রোটিন ঠিক আছে, তাহলে প্লাটিলেটের প্রয়োজন নেই।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে