রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বড় অগ্রগতির সূচনা

প্রকাশিত: অক্টোবর ১০, ২০২১; সময়: ৬:২৮ অপরাহ্ণ |
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বড় অগ্রগতির সূচনা

রাজিউর রহমান রুমী, পাবনা : পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথে বড় ধরনের অগ্রগতির সূচনা হল ঈশ্বরদীর রূপপুরে। আজ রোববার স্থাপন করা হল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ‘হৃৎপিণ্ড’ হিসেবে পরিচিত রিঅ্যাক্টর প্রেশার ভেসেল বা পরমাণু চুল্লিপাত্র। এটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল যন্ত্র। এর মধ্যেই শক্তি উৎপাদন হবে, যা কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হবে বিদ্যুৎ।

রোববার বেলা পৌনে ১২টায় গণভবন থেকে থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে সংযুক্ত হন।

এসময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরাসরি উপস্থিত পারলে অনেক ভালো লাগতো। কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। আমি এই রিয়্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপনের অনুমতি দিচ্ছি। এর পরই রিয়্যাক্টর স্থাপন করা হয়।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ পরমাণু বিশ্বে প্রবেশ করেছে এবং আমরা পরমাণু শক্তিকে শান্তির জন্য ব্যবহার করছি। আমরা পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নকে আরও এগিয়ে নিতে চাই এবং সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।

এর মধ্য দিয়ে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ আরও একধাপ এগিয়ে গেল। বর্তমানে বিশ্বে মোট ৩৩টি দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। বাংলাদেশ আগামী ২০২৩ সালে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যাচ্ছে। এই চুল্লি স্থাপনের মধ্য দিয়ে সেই প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে গেল।

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি করপোরেশন রোসাটমের প্রধান নির্বাহী আলেক্সি লিখাচেভ ও এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট গ্রুপ অব কোম্পানিজের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লকসিন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব জিয়াউল হাসান, রূপপুর প্রকল্পের পরিচালক ড. শওকত আকবর, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক ডাঃ মোঃ সানোয়ার হোসেন, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মোজাম্মেল হক, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আতাউল হাকিম সারওয়ার হাসান (সিজিএস), ডিআইজি আব্দুল বাতেন বিপিএম, সংসদ সদস্য শামসুল হক টুকু, গোলাম ফারুক প্রিন্স ও নুরুজ্জামান বিশ্বাসসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। রিয়্যাক্টর ভবনের ভেতর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে রূপপুর প্রকল্পের পরিচালক ও পরমাণু বিজ্ঞানী ড. মো. শৌকত আকবর, রিয়্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপনের অনুমতি চান। প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দিলে, রিয়্যাক্টর ভেসেলটি নকশা অনুযায়ী যথাস্থানে বসানো হয়। ৫ থেকে ৬ মিনিটের মধ্যে এটি বসানো শেষ হলে জয় বাংলা, জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে রিয়্যাক্টর ভবন থেকে অনুষ্ঠানস্থল। গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল যন্ত্রটি স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়।

রাশিয়ার কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় নির্মিত হচ্ছে রূপপুর প্রকল্প। এই প্রকল্পের প্রথম ইউনিটে যে রিয়্যাক্টর স্থাপন করা হলো সেটি রাশিয়ার তৈরি সর্বশেষ প্রযুক্তি থ্রিজি প্লাস প্রজন্মের ভিভিইআর ১২০০ মডেলের। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে যন্ত্রে নিউক্লিয়ার ফুয়েল (পারমাণবিক জ্বালানি) ইউরেনিয়াম থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় তার মূল কাঠামো হচ্ছে এই বিশেষ যন্ত্র অর্থাৎ রিয়্যাক্টর প্রেসার ভেসেল (পরমাণু চুল্লি)। এই রিয়্যাক্টরকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের হার্ট বা হৃৎপিণ্ড বলা হয়।

পারমাণবিক প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা-ইন্টারন্যাশনাল এ্যাটমিক এ্যানার্জি অ্যাসোসিয়েশনের (আইএইএ) গাইড লাইন অনুযায়ী এবং সংস্থাটির কড়া নজরদারির মধ্য দিয়েই রূপপুর প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে।

১৯৬১ সালে ঈশ্বরদীর রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেই উদ্যোগ আর বেশিদূর আগায়নি। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রূপপুরে ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) সফরের সময় দেশটির তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নুপুরকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সহযোগিতার অনুরোধ করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই প্রক্রিয়া থেমে যায়। দীর্ঘদিন পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ডক্টর এম এ ওয়াজেদ মিয়া। এরপর প্রক্রিয়া আগাতে থাকলেও ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর এই কার্যক্রম আবার হোঁচট খায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কার্যক্রম শুরু করে। পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা হয়। ২০২১ সালে রাশিয়ার সঙ্গে এ বিষয়ে বাংলাদেশের চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এরপর প্রক্রিয়া আরও এগিয়ে যায়।

রূপপুর প্রকল্পের রিয়্যাক্টরসহ যাবতীয় যন্ত্রপাতি তৈরি করা হয়েছে রাশিয়াতে। সেখানকার বিভিন্ন কারখানায় এই যন্ত্রগুলো তৈরি করে সমুদ্র পথে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। প্রথম ইউনিটের ভারী যন্ত্র চারটি স্টিম জেনারেটর, প্রেসারাইজার, হাইড্রো একমোডেটর ও কুন্যান্ড পাম্প ইতোমধ্যেই রূপপুরে এসে পৌঁছেছে। এই ইউনিটের রিয়্যাক্টর গত বছর অক্টোবরে রাশিয়া থেকে দেশে এসে পৌঁছায় এবং নভেম্বরে সেটি রূপপুরে নেওয়া হয়। এ বছর আগস্টে দ্বিতীয় ইউনিটের রিয়্যাক্টও এসেছে। এই ভারী যন্ত্রগুলো রাশিয়ার ভলগা নদী থেকে প্রায় ১৪০০০ কিলোমিটার সামুদ্রিক পথ পারি দিয়ে বাংলাদেশের মংলা বন্দর দিয়ে রূপপুরের কাছে পদ্মা নদীতে এসে পৌঁছায়।

স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরের মধ্যে রূপপুর প্রকল্পই দেশের সবচেয়ে বড় এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে সর্বাধিক ব্যয়বহুল প্রকল্প। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচের এই প্রকল্পে ৯০ ভাগ টাকা ঋণ দিয়েছে রাশিয়া। একইসঙ্গে আন্তঃরাষ্ট্রীয় কয়েকটি চুক্তির মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করছে রূশ ঠিকাদার এটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি এটি পরিচালনার জন্য জনবলও দিচ্ছে রাশিয়া। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ সালে প্রথম ইউনিট থেকে ১২০০ মেগাওয়াট এবং ২০২৪ সালে দ্বিতীয় ইউনিট থেকেও ১২০০ মেগাওয়াট অর্থাৎ মোট ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে