তাড়াশের নওগাঁ শাহী মসজিদ ঐতিহ্যের উজ্জল নিদর্শন

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩০, ২০২১; সময়: ৭:৫৫ অপরাহ্ণ |
তাড়াশের নওগাঁ শাহী মসজিদ ঐতিহ্যের উজ্জল নিদর্শন

নূর ইসলাম রোমান, তাড়াশ : চলনবিল অধ্যুশিত সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় অবস্থিত হযরত শাহ্ শরীফ জিন্দানী (রাঃ) এর পবিত্র মাজার মসজিদ ঐতিহ্যের এতটাই ঐতিহাসিক উজ্জল নিদর্শন আর এতটাই কারুকার্যে তৈরী যা দেশি-বিদেশী পর্যটকদের মনো-মুগ্ধ না করেই পারবে না।

পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর এই তিনটি জেলার সংযোগস্থলে যে বিশাল নিম্ন জলাভূমি রয়েছে এরই নাম চলনবিল। এই বিল বাংলাদেশের অতি-সুপরিচিত।

যে বিশাল এলাকা নিয়ে এই বিলাঞ্চল তার মধ্যে রয়েছে সিংড়া, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, চাটমোহর, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, সলঙ্গা, উল্লাপাড়া ও তাড়াশ উপজেলা। এই ৯ টি উপজেলার বিস্তির্ণ অঞ্চলের আয়তন প্রায় ১৪৫০ বর্গ কি.মি।

যার লোক সংখ্যা প্রায় ৪০ লক্ষের উপরে। আর এই স্বপ্নের চলনবিলকে (জেলা) হিসাবে বাস্তবে দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন চলনবিলাঞ্চলের বসবাসরত ৪০ লক্ষ মানুষ। এই বিলের পাশেই একটি গ্রামের নামকরণ হয়েছে নওগাঁ। আর সেই গ্রামেই গোড়াপত্তন হয়েছে হযরত শাহ্ শরীফ জিন্দানী (রাঃ) এর পবিত্র মাজার মসজিদ।

পাশেই পশ্চিমে আরও একটি নামকরণ হয়েছে ভাঙ্গা মসজিদ। তবে সেটা মসজিদ না মন্দির সঠিকভাবে কেউ বলতে পারেনা। আবার অনেকের ধারণা, সেটা মন্দির। কারণ, বিভিন্ন প্রাণীর ছবি খোদাই করা রয়েছে সেখানে পরে থাকা শত শত ভাঙ্গা পাথরের গায়ে। আর সেই খোদাই করা পাথর এতটাই কারুকার্যে ভরা যে, দেশি-বিদেশী পর্যটকদের মগ্ধ না করেই পারবে না।

বিশেষ সূত্রে জানা যায়, ঐ মাজার মসজিদ ও পাশেই ভাঙ্গা মসজিদ নামক দুটি ঐতিহাসিক উজ্জল নিদর্শণ কবে, কখন বা কিভাবে তৈরি হয়েছে তা সঠিকভাবে কেউ’ই বলতে পারেনা।

জানা গেছে, হযরত শাহ্ শরীফ জিন্দানী (রাঃ) একজন ধর্মপ্রাণ বীরপুরুষ ছিলেন। তিনি ইরাকের জিন্দান শহর হতে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে কিছু অনুচারসহ ভারত বর্ষে আসেন। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি হতে ১৫২০ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান নাছির উদ্দিন নসরত শাহের আমলে বাংলাদেশে উপস্থিত হন এবং বিভিন্ন স্থান অতিক্রম করে চলনবিলের নওগাঁ নামক স্থানে আসেন।

এ সম্পর্কে যে লোককথা প্রচলিত আছে তা এরুপঃ তখন মানসিংহের ভ্রাতা ভানুসিংহ ছিলেন এক প্রভাবশালী রাজা। তিনি নওগাঁ শাসন করতেন। আর তিনি ছিলেন দেব-দেবী ভক্ত ও মুসলমান বিদ্বেষী রাজা। তার কালি মন্দীরে অনেক মূর্তি ছিলো। আর ছিলো তাদের উপাসনা করার মত পরোহিত। রাজা ভানুসিংহের অত্যাচারে রাজ্যে জনজীবন অতিষ্ঠ ছিলো।

তখন হযরত শাহ্ শরীফ জিন্দানী (রাঃ) ভানুসিংহ রাজার এহেন অপকর্মের কথা শুনে আর স্থীর থাকতে পারেননি। তাই তিনি একদিন স্ব-দলবলে বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে নওগাঁ আসেন এবং সরাসরি কালী মন্দীরের সামনে উপস্থিত হন।

এ খবর শুনে রাজা অগ্নিশর্মা দরবেশ দলের সামনে স্বয়ং উপস্থিত হন এবং তাদের মারতে উদ্যত হন। এমন সময় দেখেন দরবেশ দলের সামনে বিশালাকার বাঘ এবং তার পাশেই সর্প। রাজা ভয়ে পলায়ন করেন এবং পরবর্তীতে স্ব-পরিবারে নৌকায় চড়ে আত্মবিসর্জন দেন।

তখন হযরত শাহ্ শরীফ জিন্দানী (রাঃ) খুব সহজেই নওগাঁ জয় করেন। কথিত আছে, রাজার দুই পুত্র জীবিত ছিলো, পরে তারা পীরসাহেবের কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

এসময় তিনি কালী মন্দীরের সকল মূর্তি অপসারন করেন এবং আস্তানা নির্মাণ করেন। হযরত শাহ্ শরীফ জিন্দানী (রাঃ) নব-দিক্ষিত মুসলিমদের একটা দল গঠন করেন এবং চলনবিলাঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত পৌছান। এক সময় মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের নামাজ আদায়ের জন্য ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দে পৌড়াধিপতি সুলতান নসরত সাহের রাজত্বকালে এবং পৃষ্টপোষকতায় একটি মসদিজ নির্মান করেন।

এ মসজিদটি একটি গম্বুজ বিশিষ্ট এবং চারপ্রান্তে চারটি ছোট গম্বুজ রয়েছে। প্রধান গম্বুজের উচ্চতা ২৬ ফুট যাতে আছে খিলানের কাজ করা। মুল মসজিদটির বাহিরের দৈর্ঘ ৫০ ফুট, প্রস্থ ৩৩.৫ ফুট, উচ্চতা ২২.৫০ ফুট।

মসজিদ সংলগ্ন বারান্দার দৈর্ঘ ২৩.৫ ফুট এবং প্রস্থ ১১ ফুট। মসজিদের দেওয়ালের পুরুত্ব ৯.০ ফুট। এই মসজিদের ভেতরেই হযরত শাহ্ শরীফ জিন্দানী (রাঃ) এর পবিত্র মাজার শরীফ অবস্থিত।

এখানে প্রতি বছর চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহের ৩দিন বৃহস্পতি-শুক্র ও শনিবার বাৎসরিক ওরশ অনুষ্ঠিত হয়। ওরশে সারাদেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার এলাকা থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মের জনতা সমবেত হয়। সেখানে দেশের উৎখ্যাতনামা মনুষীগণ, ভক্ত মন্ডলী এবং ওলামায়েকেরাম উপস্থিত হয়ে জিকির আজগার, দোয়া মাহফিল করেন।

চলনবিল অধ্যুশিত পাবনা-নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলার ৯টি উপজেলায় আরও দেখার মত ঐতিহাসিক উজ্জল নিদর্শন স্থান রয়েছে, চাটমোহরের সাহী মসজিদ, হরিপুরের প্রমথ চৌধুরীর জন্মস্থান, জোনাইলে খ্রিস্টান গির্জা ,শাহজাদপুরে রবিন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ী, শাহজাদপুরে শাহ-মোকদমের মাজার, তাড়াশের লাল মন্দির, বিনসাড়ায় বেহুলার কুপ, হান্ডিয়ালের জগন্নাথ মন্দির, তাড়াশের দক্ষিনে ষোড়শ শতাব্দিতে তৈরী নশরত শাহের আমলে পাথরের তৈরী মসজিদসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন স্থান। প্রবাদে আছে, বিল দেখতে চলন, গ্রাম দেখতে কলম আর শিপ দেখতে

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে