বেড়েই চলেছে রাজশাহীর তাপমাত্রা

প্রকাশিত: নভেম্বর ২, ২০২১; সময়: ১১:৩৬ পূর্বাহ্ণ |
বেড়েই চলেছে রাজশাহীর তাপমাত্রা

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : একসময় গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহ সিলেট অঞ্চলে যেত না, পশ্চিমাঞ্চলেই শৈত্যপ্রবাহের দাপট থাকত বেশি। কিন্তু আবহাওয়ার মতিগতি বদলেছে। এখন সিলেট অঞ্চলও প্রতিবছর তাপদাহে নাকাল হয়; শীতের হাওয়ায় বেশি কাঁপে দেশের উত্তরাঞ্চল।

বৈশ্বিক উষ্ণতা যত বাড়ছে তত বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর চেনা জলবায়ু। প্রকৃতিক দুর্যোগ আসছে আরও ঘন ঘন, আরও বেশি ধ্বংসের শক্তি নিয়ে। বাংলাদেশের জলবায়ু কতটা কীভাবে বদলেছে তা নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণা সেভাবে নেই।

তবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের রেকর্ড বলছে, গত ছয় দশকে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়েছে। এই ধারা চলতে থাকলে আগামী তিন দশকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই পরিমাণ ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাতে পারে বলে আবহাওয়া বিদদের ধারণা।

সম্প্রতি পরিচালিত এক সমীক্ষার তথ্য তুলে ধরে জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান জানান, ২০১৫ সালের পর থেকে দেশে উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রবণতা বেড়েছে বেশি। সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ঢাকা, খুলনা ও রাজশাহী মহানগরের তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। থার্মোমিটারের পারদ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চেয়ে উঠে যাচ্ছে, এমন দিনের সংখ্যাও বাড়ছে।

তবে উষ্ণতা বৃদ্ধির এই প্রবণতার মধ্যে ময়মনসিংহ ও রংপুর কিছুটা ব্যতিক্রম। এ দুটি জায়গায় গড় তাপমাত্রা কিছুটা কমছে। এক সময় সিলেটে হিটওয়েভ ছিল না। দেশের নর্থ ইস্টার্ন পার্টে, নর্দার্ন পার্টে হিটওয়েভ হত না। ইদানিং সিলেট সিটিতে তাপমাত্রা বেড়েছে, তাপপ্রবাহ হচ্ছে গ্রীষ্মে। ডেইলি হিটওয়েভ ইনডেক্স পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, জলবায়ুর যে ধরন আগে বাংলাদেশের উত্তরাংশে ছিল, সেটা এখন দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে দেখা যাচ্ছে।

আব্দুল মান্নান বলেন, এক সময় দেশের পশ্চিমাঞ্চলে শৈত্যপ্রবাহ বিরাজ করত বেশি। গত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে, উত্তরাঞ্চলে শৈত্যপ্রবাহের দাপট বেশি থাকছে। বিশেষ করে রংপুর বিভাগ, ময়নসিংহ বিভাগ শৈত্যপ্রবাহের আওতায় বেশি আসছে।

আবহাওয়াবিদ ড. আব্দুল মান্নান বলেন, ১৯৬০ থেকে শুরু করে ২০২০ সাল- এ সময়ের ব্যবধান যদি দেখি, তাহলে আমাদের গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মত। স্থান বিশেষে এর পরিবর্তন আসতে পারে। ঠিক তেমনিভাবে সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও বেড়েছে।

অর্থাৎ সব মিলিয়ে গড় তাপমাত্রা এ অঞ্চলে শূন্য দশমিক ৭ থেকে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়েছে। গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বাড়ার পাশাপাশি মহানগর এলাকাগুলোতে তাপপ্রবাহের প্রবণতাও বেড়েছে। দুযোগপূর্ণ আবহাওয়া দেখা দিচ্ছে ঘনঘন, ধরনও পাল্টেছে।

আব্দুল মান্নান বলেন, ক্রমাগতভাবে তাপমাত্রার বাড়তির প্রবণতা রয়েছে। বিশেষ করে ২০১৫ সালের পরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি।

বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ৪৪ বছরে বাংলাদেশের তাপমাত্রা ০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এভাবে চললে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের তাপমাত্রা ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে উত্তরে গলছে বরফ, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে দক্ষিণের অনেক দ্বীপ দেশ। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাও সেই ঝুঁকির বাইরে নয়।

বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের মানুষ গ্রীষ্ম দীর্ঘায়িত হতে দেখছে, গরমও বাড়ছে। আবার শীতকালেও গড় তাপমাত্রা বেশি থাকছে। বর্ষা প্রলম্বিত হচ্ছে ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। আবহাওয়ার এমন পরিবর্তনে ঋতুবৈচিত্র্য যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক একেএম সাইফুল ইসলাম জানান, ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়ার কারণে এখন তো অনেক ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ছে, আগামীতে আরও বাড়বে। আমরা এক্সট্রিম ইভেন্ট দেখতে পাচ্ছি সারাবিশ্বে। বন্যা, খরা, দাবানল, ভূমিধস, সাইক্লোন-এসবের তীব্রতা বাড়ছে, কখনও কখনও শক্তিশালী রূপ নিচ্ছে।

এখানে গত পাঁচ বছরে আমরা দুটি বড় বন্যা দেখেছি; দুটি ঘূর্ণিঝড় দেখছি। আমরা প্রচণ্ড গরম ও হিটওয়েভ দেখছি, মুনসুনের প্যাটার্ন চেঞ্জ হচ্ছে দেখছি; মুনসুন আসে দেরি করে, যায় দেরি করে; এমন অনেক কিছু আমরা ইতোমধ্যে অবজার্ভ করছি। আগামীতে আরও বেশি দেখব।

সাইফুল ইসলাম বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যেমন বাড়ছে, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততাও বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই ধারা চললে ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বাড়বে, সেই সঙ্গে বন্যার শঙ্কাও বাড়বে। হিটওয়েভ কন্ডিশন বাড়ায় অনেক সময় দেখা যাবে ডায়রিয়া, কলেরার মতো রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুর বিস্তার বাড়তে পারে বলেও বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।

বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, সংক্রামক রোগের বিস্তার ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে জলবায়ু পরিবর্তন। ২০১৯ সালে ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ব্যাপক মাত্রায়। সে সময় ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ৭৭ শতাংশ ছিল ঢাকায়।

ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় স্বাভাবিকের তিনগুণ বৃষ্টি রেকর্ড হয়েছিল, আর মার্চে গরম ও আর্দ্রতাও ছিল বেশি। এটাই ডেঙ্গুর বাহক এইডিস মশার ব্যাক বিস্তারে ভূমিকা রেখেছিল বলে গবেষকদের ধারণা।

এমনিতে শুষ্ক মৌসুমে বর্ষাকালের চেয়ে সংক্রামক রোগের বিস্তার অন্তত ২০ শতাংশ কম দেখা যায়। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বাড়ার সঙ্গে শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতা বাড়ে। তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতা ৫.৭ শতাংশ এবং আর্দ্রতা ১ শতাংশ বাড়লে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ১.৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. মুশতাক হোসেন বলছেন, তাপমাত্রা বাড়ার কারণে অনেকগুলো প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। সব কিছু আলটিমেটলি স্বাস্থ্যের উপরেই প্রভাব ফেলবে। ক্লাইমেট চেইঞ্জের প্রধান শিকার হচ্ছে মানুষ, প্রাণী।… এটা আনপ্রেডিকটেবল। আগে তো ভাবতাম জ্বর সিজনে আসে; এখন যে কোনো সময় হতে পারে। বৃষ্টির পরিমাণ ও তীব্রতা বাড়বে, নানা রোগবালাইও বাড়বে।

মুশতাক হোসেন বলেন, জলবায়ুজনিত পরিস্থিতির শিকার হয়ে নতুন নতুন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়তে পারে। কীটপতঙ্গবাহিত রোগ, ডেঙ্গু থেকে শুরু করে চিকনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, কালাজ্বর- এসব বেড়ে যেতে পারে। তবে তার দৃষ্টিতে, সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সমস্যা হবে প্রান্তিক মানুষের পুষ্টির সমস্যা। স্বাস্থ্যকে কেন্দ্রে রেখে আগামীতে পরিকল্পনা না করলে নতুন সঙ্কটের জন্ম হতে পারে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে