রাজশাহীতে গরু-মহিষের ‘জন্ম নিবন্ধন’

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৭, ২০২১; সময়: ২:৫২ অপরাহ্ণ |
রাজশাহীতে গরু-মহিষের ‘জন্ম নিবন্ধন’

নিজস্ব প্রতিবেদক : সীমান্তবর্তী এলাকায় গরু বা মহিষের বাচ্চা জন্ম নিলেই বাধ্যতামূলক করতে হবে নিবন্ধন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানে কাছে এ নিবন্ধন করতে হয়। এমনকি নিজের কাছেও রাখতে হয় এ সংক্রান্ত একটি খাতা।

বিজিবি সূত্র জানায়, খাতায় নিবন্ধনের নিয়মটি অনেক পুরনো একটি বিষয়। মূলত সীমান্তবর্তী এলাকায় গরু-মহিষের অবৈধ চোরাচালান রোধে এ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। যা বাধ্যতামূলক। এতে একটি সীমান্তবর্তী এলাকা বা ইউনিয়নের ভেতর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গরু-মহিষের হিসাব রাখা যায়।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার আষাড়িয়াদহ ইউনিয়ন পরিষদের সূত্রে জানা যায়, এ ইউনিয়নে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বাড়ি আছে। প্রতিটি বাড়িতেই কমপক্ষে দুটি ও গড়ে পাঁচ থেকে সাতটি করে গরু-মহিষ পশু আছে। সে হিসেবে পুরো ইউনিয়নে প্রায় ২২ থেকে ২৩ হাজার গরু-মহিষ পশু আছে। এসব পশুর হিসাব আছে আষাড়িয়াদহ বিজিবির দুটি ক্যাম্পেও। একটি ডিএমসি বিওপি ক্যাম্প ও আরেকটি সাহেব নগর বিওপি ক্যাম্প।

সাহেব নগর বিওপি ক্যাম্পের সহকারী ক্যাম্প কমান্ডার নায়েব সুবেদার আব্বাস উদ্দিন বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকায় গরু-মহিষের চোরাচালান হয় অনেক। এ কারণে গরু-মহিষের সঠিক হিসেব রাখার জন্য রেজিস্ট্রার খাতায় পুরো ইউনিয়নের সংখ্যাটি সংরক্ষণ করা হয়।

একটি আমাদের ক্যাম্পে থাকে, আরেকটি থাকে ইউনিয়ন পরিষদে ও আরও একটি খাতা থাকে পশু মালিকের কাছে। কেউ গরু-মহিষ ক্রয় অথবা বিক্রয় করলে এ হিসেব রাখা হয়। এমনকি কারও বাসায় নতুন কোন গরুর জন্ম নিলেও সেটি বিজিবি ক্যাম্প ও ইউনিয়ন পরিষদের রেজিস্ট্রার খাতায় সংযোজন করতে হয়।

তিনি আরও বলেন, কেউ বাইরের গরু-মহিষ কিনে আনলে সেটিও বিজিবি এবং ইউনিয়ন পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা লাগবে। আবার কেউ তার গরু বিক্রি করতে চাইলে সেটিও জানাতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে একটি ছাড়পত্র দেওয়া হয়। সেটি আমাদের কাছে নিয়ে আসলে আমরা ওই ছাড়পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে গরু-মহিষের সংখ্যাটি বাদ দিয়ে দেই। কেনার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা।

চরমাঝারদিয়াড় এলাকার বাসিন্দা মো. রুবেল বলেন, এখানে গরু পালতে হলে বিজিবির কাছে থাকা নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রার খাতায় তোলা লাগে। এর জন্য কোনো টাকা লাগে না। তবে নিবন্ধন না করলে সেটি অবৈধ গরু হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই বাছুর জন্ম নিলে সেটিকেও নিবন্ধন করিয়ে নেই।

একই এলাকার বাসিন্দা হামিদা বেগম পালছেন একটি গুরু। তার গরুর বাচ্চা হবে আর কিছুদিন পর। সেটিও বিজিবি ক্যাম্পের তালিকাভুক্তির মধ্যে আনতে হবে। তুলতে হবে ইউনিয়ন পরিষদের খাতায়ও। নিজের কাছেও থাকে একটি খাতা।

গৃহিণী হামিদা বলেন, আমার বাড়িতে এখন একটাই গরু। দুদিন পর বাচ্চা হলে সেই বাচ্চাটিকে ক্যাম্পে ১০ দিনের মধ্যে নিয়ে গিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। সেখানে তারা গরুটি দেখতে কেমন তার একটি বর্ণনা লিখে নিবেন। লিখে নেওয়ার পর আর কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু গরু বিক্রি করতে গেলে আবার একদিন আগে ক্যাম্পে গরুসহ গিয়ে সেটির ছাড়পত্র নিতে হয়।

একই এলাকার বিউটি বেগমের আছে সাতটি গরু ও চারটি খাসি। তিনি বলেন, গরুর রেজিস্ট্রার বা নিবন্ধন করতে হয়। তবে ছাগলের নিবন্ধন করা লাগে না।

গরু-মহিষের নিবন্ধন কেন করতে হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাশেই ভারতের বর্ডার। আগে বর্ডার থেকে ভিনদেশি ও এলাকার মানুষ গরু নিয়ে এসে দেশি গরুর মধ্যে বেঁধে রাখতো। এতে বোঝা যেতো না কোনটা দেশি আর কোনটা ভারতীয়। কিন্তু এখন ভারত থেকে গরু আনার পর বাঁধলেও তা ধরা পড়ে। তাই রেজিস্ট্রার খাতায় নাম তোলার সিস্টেম চালু হয়েছে।

বিউটি বেগমের ভাষ্য, বিজিবির এ হিসেব রাখার প্রথাটি আগে থেকে চালু থাকলেও গত দুই-তিন বছর থেকে অনেক কড়াকড়ি হয়েছে। বেচলেও খাতায় তুলতে হবে কিনলেও তুলতে হবে আবার জন্ম নিলেও তুলতে হবে। এ ব্যবস্থায় আমাদের বেশ সুবিধাই হয়েছে। এতে গরু-মহিষ হারানোর কোনো ভয় নাই।

আষাড়িয়াদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সানাউল্লাহ বলেন, অনেক আগে থেকেই এ নিয়ম চলছে। তবে ২০১৭-১৮ সাল থেকে ব্যাপারটি বেশ কড়াভাবে দেখছে বিজিবি। আমরা ছাড়পত্র দিলেও মোট হিসাব আমাদের কাছে নেই। বিজিবির কাছে পুরো ইউনিয়নের হিসাব আছে। তারা জানে কোন বাড়িতে কয়টা গরু আছে।

তিনি আরও বলেন, ক্রয়-বিক্রয়ের ছাড়পত্র ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দিলেও তা বিজিবির রেজিস্ট্রার খাতায় তোলা লাগে। যে ছাড়পত্র দেওয়া হয় তাতে চেয়ারম্যান, একজন মেম্বার ও বিজিবি ক্যাম্প কমান্ডারের সই লাগে। এরপর কেউ সেই পশু ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে। এ ক্ষেত্রে পশুর মালিককে ক্যাম্পে তার গরু-মহিষ টেনে নিয়ে আসা লাগে।

ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, এখানকার অনেকেই শুধু গরু লালন-পালন করেই সংসার চালান। কারও কারও একসঙ্গে ৪০-৫০টিও গরু আছে। একসঙ্গে এতোগুলো গরুকে খাওয়ানোর সামর্থ্য তাদের নেই। তাই তারা গোদাগাড়ী উপজেলার আলতলী ইউনিয়নের বিশাল মাঠে গরু নিয়ে যান খাওয়াতে।

সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত গরু চড়িয়ে সন্ধ্যা হলে তারা নিজের গোয়ালগরে নিয়ে আসেন। সেই গোয়ালঘর কোথায় সেটিও বলা লাগে তাদের। হিসাব রাখার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাটি ভালো হলেও সাধারণ মানুষের কাছে এটি বেশ ঝামেলার কাজ। গরু-মহিষ নিয়ে এখানে-ওখানে যাওয়ার কারণে অনেকেই এটি পছন্দ করেন না বলেও জানান চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ।

রাজশাহীর বিজিবি অধিনায়ক সাব্বির আহম্মেদ বলেন, গরু-মহিষের জন্য সীমান্তবর্তী বিওপি ক্যাম্পগুলোতে একটি রেজিস্ট্রার খাতা মেনটেইন করা হয়। এটি স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বার ও ক্যাম্প কমান্ডারদের সমন্বয়ে হয়ে থাকে। মূলত চর এলাকায় কী পরিমাণ গরু আছে, সেটির একটি হিসেব বিজিবির থাকে। তা নাহলে সীমান্তে গরু চোরাচালান রোধ সম্ভব নয়। যে কেউ ওপার থেকে গরু এনে বলে দেবে যে, ওই গরুগুলো তার।

তিনি আরও বলেন, সাধারণত সীমান্তবর্তী এলাকা থেকেই অবৈধভাবে ভারতীয় গরু বাংলাদেশে ঢোকে। এ সিস্টেমের কারণে গরু-মহিষের চোরাচালান রোধ হয়েছে। এমনকি আমরা একটি নির্দিষ্ট এলাকায় পশুর সঠিক হিসাবও রাখতে সক্ষম হচ্ছি। সূত্র- জাগো নিউজ

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে