কে এই সান্টাক্লজ? জানুন এর ইতিহাস

প্রকাশিত: ২৮-১২-২০২১, সময়: ১৩:০৭ |

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : সাদা চুল দাড়ির সদাহাস্যময় মোটা এক বৃদ্ধ। তিনিই বিশ্বজুড়ে প্রতি ক্রিসমাসে ঘুরে বেড়ান। পরনে সাদা কলার দেয়া লাল কোট, সাদা লাইনিং দেয়া লাল ট্রাউজার, কোমরে কালো চামড়ার বেল্ট, মাথায় লাল টুপি যাতে ঝুলতে দেখা যায় কদমফুলের মতো বল। কাঁধে থাকে একটি ব্যাগ, যাতে রয়েছে বিভিন্ন খেলনা ও নানা উপহার। তিনি প্রতি ক্রিসমাস ইভে শিশুদের জন্য উপহার নিয়ে আসেন। মজাদার এই বৃদ্ধের নাম ‘সান্টাক্লজ’।

শিশুরা জানে, উত্তর মেরুতে আছে সান্টাক্লজের খেলনা তৈরির কারখানা। যেখানে বরফে তার স্লেজ টানে উড়ন্ত শিংওয়ালা হরিণ, রেইনডিয়ার ‘কমেট’। প্রাণোচ্ছ্বল মানুষটি কথায় কথায় ‘হো হো’ শব্দ করে হাসেন। প্রতি ২৪ ডিসেম্বর রাতে শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ার পর ঘরের দরজায় টাঙানো মোজার ভেতরে লুকিয়ে রেখে আসেন নানা উপহার।

সান্টাক্লজকে চেনে না বিশ্বে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। তবে বাস্তবের যেই মানুষটিকে নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল কাল্পনিক চরিত্র সান্টাক্লজ, সেই মানুষটিকে আজও বিশ্বের অনেকেই চেনেন না। ক্রিসমাসের মরসুমে তাই আজ চিনে নেব সেই অসামান্য মানুষটিকে।

কে এই অসামান্য মানুষটি?

খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে আনাতোলিয়ার মেইরা শহরে বাস করতেন এক ধনী ব্যবসায়ী। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সমস্ত সম্পদ হারিয়ে সুদখোর মহাজনদের ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। সেই ব্যবসায়ীর ছিল তিন কন্যা। মহাজনেরা টাকার বদলে চেয়েছিল তিন সুন্দরী কন্যাকে। তাদের পতিতাবৃত্তিতে নামিয়ে টাকা পাওয়া ছিল মহাজনদের লক্ষ্য। দিশেহারা ব্যবসায়ী দ্রুত কন্যাদের বিয়ে দিতে চাইছিলেন। তবে পণের টাকা দেয়ার মতো সামর্থ্য ছিল না তার। বাধ্য হয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন চারজন।

যেই রাতে তারা আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেই রাতেই ঘরের জানলা গলিয়ে কেউ সোনার মোহর ভর্তি একটি ব্যাগ ফেলে দিয়ে গিয়েছিলো। সেই মোহর দিয়ে বড় কন্যার বিয়ে দিয়েছিলেন ব্যবসায়ী এবং কিছুটা ঋণ মিটিয়েছিলেন। বাকি মহাজনেরা ঋণ পরিশোধ করার জন্য চেপে ধরেছিলো ব্যবসায়ীকে। কিছুদিন পরে একইভাবে কেউ সোনার মোহর ভর্তি আরেকটি ব্যাগ ফেলে দিয়ে গিয়েছিলো। এবার সেই মোহর দিয়ে ব্যবসায়ী তার মেঝো কন্যার বিয়ে দিয়েছিলেন এবং পরিশোধ করেছিলেন আরও কিছুটা ঋণ।

কে এই দেবদূত! তা জানার জন্য প্রতিরাতে ব্যবসায়ী জেগে থাকতেন। পাওনা আদায়ের জন্য আবার অত্যাচার শুরু করেছিল মহাজনেরা। শুরু হয়েছিল ছোট মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। একদিন ভোর রাতে ব্যবসায়ী শুনতে পেয়েছিলেন ভারী জুতার আওয়াজ। তিনি লুকিয়ে দেখেছিলেন জানলার ভেতরে একটি ব্যাগ ছুঁড়ে দিয়েছিলো রাতের পোশাক পরা একটি লোক।

ঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে লোকটিকে ধরে ফেলেছিলেন ব্যবসায়ী। তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে ব্যবসায়ী বলেছিলেন, ‘প্রভু যিশু, আপনি স্বয়ং আমাদেরকে উদ্ধার করলেন!’ মানুষটি বলেছিলেন, ‘আমি প্রভু নই, প্রভুর দাস। আমার নাম নিকোলাস। দয়া করে কাউকে জানাবেন না আমার কথা।’

কে এই নিকোলাস?

২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত আনাতোলিয়ার পাটারা শহরে জন্ম নিয়েছিলেন নিকোলাস। বাবার নাম ছিল থিওফেনিস, মতান্তরে এপিফেনিয়াস ও মায়ের নাম ছিল নোন্না, মতান্তরে জোহানা। ধনী পরিবারের সন্তান নিকোলাস বাল্যকালে হারিয়েছিলেন বাবা-মাকে। কাকার কাছে থাকতেন। কাকা ছিলেন মেইরা শহরের গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের বিশপ।

গরিবদের সাহায্য

ছোটবেলা থেকেই নিকোলাসের ছিল প্রভু যিশুর প্রতি গভীর অনুরাগ। যৌবনে পৌঁছনোর পর নিকোলাস তার অগাধ সম্পত্তি গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন। রাতের অন্ধকারে সবার অজান্তে গরিব মানুষদের বাড়িতে ফেলে আসতেন ব্যাগ ভর্তি টাকাপয়সা। কারণ তিনি মনে করতেন, সবাইকে জানিয়ে সাহায্য করলে গরিবদের অপমান করা হয়।

বিপদবন্ধু অথচ অজ্ঞাতপরিচয় এক মহানুভব মানুষের কথা ক্রমশ মেইরা ও আশেপাশের শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর্তকে সাহায্য করাই যাঁর একমাত্র ব্রত। ভাইপো নিকোলাসের এই অসামান্য দানশীলতার কথা একমাত্র জানতেন তার কাকা। তাই তিনি নিকোলাসকে দিয়েছিলেন যাজক হওয়ার দীক্ষা।

পবিত্রভূমিতে নিকোলাস

নিকোলাস তার কাকার মৃত্যুর পর নৌকা করে রওনা হয়েছিলেন খ্রিস্টানদের পবিত্রভূমি বা ‘হোলি ল্যান্ড’ এর উদ্দেশ্যে। ভূমধ্যসাগর ও জর্দান নদীর পূর্ব তীরের মধ্যবর্তী অঞ্চল হলো এই হোলি ল্যান্ড। আজ যেখানে আছে ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, পশ্চিম জর্দান, দক্ষিণ লেবানন ও দক্ষিণ সিরিয়া।

নিকোলাসের নৌকা চলেছিল ভূমধ্যসাগরের বুক চিরে। মাঝ সমুদ্রে উঠেছিল ভয়াবহ ঝড়। নৌকা ডোবার উপক্রম হয়েছিল। কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন আতংকিত যাত্রীরা। তবে নিকোলাস ছিলেন অবিচল। তীর্থযাত্রীদের মৃত্যুর মুখে ফেলে দেয়ার জন্য নিকোলাস তীব্র ভাষায় তিরস্কার করেছিলেন সমুদ্রকে। কিছুক্ষণের মধ্যে যাত্রীদের বিস্মিত করে পুকুরের মতো শান্ত হয়ে গিয়েছিল সমুদ্র। থেমে গিয়েছিলো প্রবল ঘূর্ণিঝড়।

মেইরার গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের পরবর্তী বিশপ

বেশ কয়েক বছর হোলি ল্যান্ডে কাটিয়ে নিকোলাস ফিরে এসেছিলেন মেইরাতে। সেই দিনই কাকার পরবর্তী বিশপ মারা গিয়েছিলেন। যাজকদের মধ্যে নতুন বিশপ নির্বাচন নিয়ে মতভেদ হয়েছিল। ঠিক হয়েছিলো পরদিন সকালে যে যাজক চার্চে প্রথম প্রবেশ করবেন, তিনিই হবেন নতুন বিশপ। ঘটনাটি জানতেন না নিকোলাস। পুরোনো অভ্যসের বশবর্তী হয়ে পরদিন ভোরে সবার আগে পৌঁছে গিয়েছিলেন চার্চে। নিকোলাস হয়েছিলেন মেইরার গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের পরবর্তী বিশপ।

একের পর এক অলৌকিক ঘটনা

৩১১ খ্রিস্টাব্দে মেইরাতে দেখা দিয়েছিলো ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ। ঠিক সেই সময়েই নিকটবর্তী অ্যান্ড্রিয়াক বন্দরে দাঁড়িয়েছিল গম বোঝাই করা এক জাহাজ৷ কনস্টান্টিনোপলের সম্রাটের জন্য যাচ্ছিল সেই গম। জাহাজের নাবিকদের নিকোলাস বলেছিলেন, কিছু গম দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদের জন্য নামিয়ে দিতে। রাজি হননি নাবিকেরা। কারণ গমের ওজন সম্রাটের লোককে বুঝিয়ে দিতে হবে। ওজন সামান্য কম হলেই গর্দান যাবে।

নিকোলাস বলেছিলেন, জাহাজে থাকা গমের ওজন কমবে না। এরপর নিকোলাস মেইরার পথে পথে নাবিকদের নিয়ে ঘুরেছিলেন। দেখিয়েছিলেন রাস্তায় পড়ে থাকা শত শত মৃতদেহ। সেই দৃশ্য দেখার পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নাবিকেরা নামিয়ে দিয়েছিলো প্রচুর গম। মেইরার প্রত্যেক বাড়িতে সেই গম নিকোলাস বিলিয়ে দিয়েছিলেন।

যথাসময়ে কনস্টান্টিনোপল পৌঁছেছিল গমভর্তি জাহাজ৷ গমের ওজন করছিলো সম্রাটের লোকজন। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন নাবিকেরা। কিন্তু অবাক কাণ্ড! জাহাজে তোলার সময় গমের যে ওজন ছিল, নামানোর পরও একই ওজন ছিল। অলৌকিকভাবে বাঁচিয়েছিলেন তিনটি প্রাণ।

অলৌকিকভাবে বাঁচিয়েছিলেন তিনটি প্রাণ

আনাতোলিয়ার ফ্রিজিয়াতে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। বিশ্বস্ত তিন সেনাপতিকে বিদ্রোহ দমন করতে রোম সম্রাট কনস্টানটাইন পাঠিয়েছিলেন। তারা হলেন উরসস, নেপসিয়ানোস ও হার্পাইলিওঙ্কে। সেনাবাহিনী ফ্রিজিয়াতে পৌঁছনোর পর শুরু হয়েছিল ভয়াবহ ঝড়। বালির ঝড়ে দিশেহারা সেনাবাহিনীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিলো। সেনাপতিরা পথ ভুল করে পৌঁছে গিয়েছিলেন মেইরাতে।

ঝড় থামার পর বিদ্রোহ দমনের নামে ফ্রিজিয়ায় নারকীয় অত্যাচার শুরু করেছি সেনাবাহিনী। তারা জনসাধারণের বাড়িঘর ধ্বংস, লুঠপাঠ থেকে নরহত্যা কিছুই বাকি রাখেনি। খবর পেয়ে উদবিগ্ন নিকোলাস দেখা করেছিলেন তিন রোমান সেনাপতির সঙ্গে। তারা সেনাবাহিনীদের এই নির্মম অত্যাচারের কথা জানতেনই না। নিকোলাসের কাছ থেকে সব শুনে সেনাদের রোমে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলেন তিন সেনাপতি।

কয়েকদিন পর নিকোলাস শুনেছিলেন তিন সহৃদয় সেনাপতিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন মেইরার গভর্নর ইউস্থাসিয়াস। বিদ্রোহ দমন করার বদলে তারা নাকি সেনাদের বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করতে বলেছিলেন। বধ্যভূমিতে তিন সেনাপতিকেই শিরচ্ছেদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ভোজবাজির মতোই নিকোলাস পৌঁছে গিয়েছিলেন বধ্যভূমিতে।

বধ্যভূমিতে হাঁটু মুড়ে বসেছিলেন তিন সেনাপতি। তাদের পিছনে জল্লাদ তরবারি হাতে দাঁড়িয়েছিল। উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি আব্লাবিয়াস ও গভর্নর ইউস্থেসিয়াস। নিকোলাসের আচমকা হুংকারে কেঁপে উঠেছিলো বধ্যভূমি। শুরু হয়েছিলো বালির ঝড়। সেনাপতিদের শরীরে জড়িয়ে থাকা লোহার শিকল ছিঁড়ে গিয়েছিলো। জল্লাদের হাত থেকে ছিটকে পড়ে গিয়েছিলো তরবারি।

বিচারপতি আব্লাবিয়াসের দিকে তাকিয়ে নিকোলাস বলেছিলেন, ‘ঘুষ নিয়ে নির্দোষ সেনাপতিদের প্রাণ নিতে গিয়েছিলো। এবার প্রভুর দরবারে তোমার ও গভর্নর ইউস্থেসিয়াসের বিচার হবে।’ রুদ্রমূর্তি নিকোলাসকে দেখে ঘোড়ায় চড়ে পালাতে গিয়েছিলেন। ঘোড়াটি তাকে নিয়ে ফিরে এসেছিলো নিকোলাসেরই কাছে। নিকোলাসের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেছিলেন দুইজনে। সেই রাতেই নিকোলাস সম্রাট কনস্টানটাইনের স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন তিন সেনাপতির কথা। আব্লাবিয়াস ও ইউস্থেসিয়াসকে শাস্তি দিয়েছিলেন ক্রুদ্ধ সম্রাট। তিন সেনাপতির হয়েছিল পদোন্নতি।

কারাকক্ষে দেখা দিয়েছিলেন প্রভু যিশু

৩২৫ খ্রিস্টাব্দে রোম সাম্রাজ্যের বিশপেরা একটি বৈঠক করেছিলেন। সেই বৈঠকে প্রভু যিশুর সম্পর্কে অবমাননা সূচক মন্তব্য করায় ক্ষুব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন নিকোলাস। চড় মেরেছিলেন মিশরের বিশপ আরিয়াসকে। কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিলো নিকোলাসকে। তার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে রাখা হয়েছিলো শিকল, যাতে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী নিকোলাস পালাতে না পারেন।

সেই রাতেই নীলাভ আলোয় অন্ধকার কারাকক্ষ ভেসে গিয়েছিলো। নিকোলাসকে দেখা দিয়েছিলেন স্বয়ং প্রভু যিশু ও ভার্জিন মেরি। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে নিকোলাস বলেছিলেন, ‘তোমাদের ভালোবাসাটাই কি আমার অপরাধ!’ এরপর নিজে থেকেই খুলে গিয়েছিলো শিকল। কারাকক্ষের ঘন অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিলেন প্রভু যিশু ও ভার্জিন মেরি। কারাগারের বাইরে বিনা বাধায় নিকোলাস চলে এসেছিলেন। কারণ গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিল জেলের প্রহরীরা।

শিশুদের রক্ষাকর্তা নিকোলাস

এই অলৌকিক ঘটনাটির সময় জানা যায় না। তবে সেই বারও মেইরাতে হয়েছিলো ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ। এক অসাধু কসাই সেই সুযোগে নৃশংস এক ফন্দি এঁটেছিল। তিনটি শিশুকে খাবারের লোভ দেখিয়ে সে নিয়ে গিয়েছিলো একটি পোড়ো বাড়িতে। শিশুগুলোকে হত্যা করে মাংসের টুকরা দিয়ে আচার বানিয়েছিলো। কাঠের পাত্রে লুকিয়ে রেখেছিলো সেই আচার। তার উদ্দেশ্য ছিল শুয়োরের মাংসের আচার বলে বিক্রি করা।

ঘটনাচক্রে সেখানেই ত্রাণ বিলিয়ে দিতে গিয়েছিলেন নিকোলাস। মানসচক্ষে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন এই নৃশংস ঘটনাটি। বাড়িটিতে জনতা একত্রিত করে ঘিরে ফেরেছিলেন। সেই পাত্রটি ভিতর থেকে বের করে আনা হয়েছিল। এরপর নিকোলাস উপস্থিত জনতাকে দিয়েছিলেন নৃশংস ঘটনাটির বর্ণনা।

ভেঙে পড়েছিলো সেই অসাধু কসাই। স্বীকার করেছিলো অপরাধ। দ্রুত বিচারের পর কার্যকর করা হয়েছিলো কসাইয়ের মৃত্যুদণ্ড। শিশু তিনটিকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য নিকোলাসের পায়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন তাদের বাবা-মা। নিকোলাসের নির্দেশে মাংসের টুকরাগুলো ক্রসের আকারে সাজানো হয়েছিলো।

আকাশের দিকে হাত তুলে প্রভুকে ডেকেছিলেন নিকোলাস। নিজে থেকেই জোড়া লাগতে শুরু করেছিলো মাংসের টুকরোগুলো। এক সময় পাত্র থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিলো জীবন্ত তিন শিশু। ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মায়েদের কোলে। সেই দিন থেকে পৃথিবীর বন্ধু ও রক্ষাকর্তা হয়ে গিয়েছিলেন নিকোলাস।

নানা দেশের শিশুরা দল বেঁধে তার সঙ্গে দেখা করতে আসতো। শিশুদের সঙ্গে নিকোলাস খেলতেন ও মজা করতেন। বড়দিনের আগে শিশুদের বাড়িতে গোপনে রেখে আসতেন উপহার। শিশুদের নিয়ে মহা আনন্দে কেটেছিল নিকোলাসের শেষজীবন।

৩৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর ৭৩ বছরের ক্রিসমাস বুড়ো নিকোলাস বিশ্বের শিশুদের কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিলো মেইরাই সেই গির্জার প্রাঙ্গনে, যেখানে তিনি দীর্ঘকাল বিশপের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

চুরি হয়ে গিয়েছিলো নিকোলাসের অস্থি

ক্যাথলিক চার্চ ১০৫৪ খ্রিস্টাব্দে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলো গ্রিক অর্থোডক্স চার্চকে। ইতালির বারি থেকে আসা একদল নাবিক নিকোলাসের কফিন ভেঙে অস্থি নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। তারা অস্থিগুলো দান করেছিলো বারির ব্যাসিলিকা ডি সান নিকোলাকে। নিকোলাসের ভাঙা কফিনে পড়েছিলো ছোট ছোট কিছু অস্থি। সেগুলোও চুরি করে নিয়েছিলো ভেনিসের নাবিকেরা। এই অস্থিগুলো ভেনিসের সান নিকোলাস আল লিডোতে রাখা হয়েছিলো।

ইউরোপের নাবিকেরা মনে করতো নিকোলাস তাদেরও রক্ষাকর্তা। মাঝ সমুদ্রে বিপদের হাত থেকে তিনিই তাদের বাঁচান। তাই তারা চুরি করেছিলো নিকোলাসের অস্থিগুলো। বিশপ নিকোলাসের জীবদ্দশায় ঘটা অলৌকিক ঘটনাগুলোর সত্যতা যাচাইয়ের পর ১৪৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুন পোপ চতুর্থ ইউজিন বিশপ নিকোলাসকে ‘সেন্ট’ ঘোষণা করেছিলেন।

নিকোলাস যেভাবে হয়েছিলেন ‘সান্টাক্লজ’

সারা ইউরোপে শিশুদের প্রিয় বন্ধু বিশপ নিকোলাসের নাম আগেই ছড়িয়ে পড়েছিলো। হলান্ডবাসীরা ছিলেন সেন্ট নিকোলাসের সবচেয়ে বড় অনুগামী। তারা সেন্ট নিকোলাসকে বলতেন ‘সিন্টারক্লাস’। তাদের মাধ্যমেই আমেরিকায় পৌঁছে গিয়েছিলেন সেন্ট নিকোলাস। ১৭৭৩ সালের ৬ ডিসেম্বর আমেরিকাতে তার মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন করেছিলেন হলান্ডের কিছু মানুষ।

সেই শুরু! সেখান থেকে এরপর ধীরে ধীরে আমেরিকাবাসীর নয়নমণি হয়ে উঠেছিলেন সেন্ট নিকোলাস। নিউইয়র্ক হিস্টোরিকাল সোসাইটির সদস্য জন পিন্ট্রাড ১৮০৪ সালে সোসাইটির বার্ষিক বৈঠকে বিতরণ করেছিলেন বেশ কিছু কাঠের ফলক। যেগুলোতে খোদাই করা ছিল সেন্ট নিকোলাসের মূর্তি ও ফায়ার প্লেসের পাশে টাঙানো খেলনা ভর্তি মোজা।

১৮২৩ সালে বিখ্যাত কবি ক্লেমেট মুর লিখেছিলেন ‘আ ভিজিট ফ্রম সেন্ট নিকোলাস’ নামে একটি কবিতা। ১৮৬২ সালে আমেরিকার বিখ্যাত কার্টুনিস্ট টমাস নাস্ট এই কবিতাটি অবলম্বন করে এঁকেছিলেন শিশুদের বন্ধু সেন্ট নিকোলাসের এক মজাদার ছবি। সেই ছবিতে থাকা সদাহাস্যময় সেন্ট নিকোলাসের পরনে ছিল লাল রঙের পোশাক। কোলে এক ফুটফুটে শিশু ও অজস্র উপহার। পিঠেও উপহারের ব্যাগ।

সেন্ট নিকোলাসের এই মজাদার ছবিটি বিশ্ববিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলো উল্কাগতিতে। ছবিতে থাকা সেন্ট নিকোলাসের নতুন নাম হয়েছিলো ‘সান্টাক্লজ’। সেই নামটির মধ্যে আজও মিশে আছেন আনাতোলিয়ার দয়ালু বিশপ সেন্ট নিকোলাস। মিশে আছেন শিশুদের সেরা বন্ধু, ক্রিসমাসের সদাহাস্যময় মিষ্টি বুড়ো ‘সিন্টারক্লাস’।

উপরে