একজন শিক্ষানুরাগী আব্দুল মতিনের গল্প
এস এম শফিকুল ইসলাম, জয়পুরহাট : জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত সদস্য (মেম্বার) আব্দুল মতিন আকন্দ নিজ খরচে স্কুল শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুল ড্রেস তুলে দিয়ে এলাকাবাসীর নজর কেড়েছেন।
এখানেই শেষ নয়, শিক্ষকদের কক্ষে বসে আলাপচারিতায় তিনি শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দেন-আপনারা ছাত্র ছাত্রীদের ভালভাবে পড়ান কমপক্ষে ৪ জন শিক্ষার্থী বৃত্তিলাভ করলে তাদের প্রত্যেককে ৫ হাজার টাকা এবং বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষককে ৫ হাজার টাকা প্রণোদনা প্রদান করা হবে।
জানা গেছে, আলমপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত সদস্য (মেম্বার) আব্দুল মতিন আকন্দেও এলাকার একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানিয়াচাপড় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র ছাত্রী গরীব পরিবারের সন্তান। তাদের অভিভাবকরা দিন আনে, দিন খায়।
কেউ বা ভ্যান-রিকশা চালান, আবার কেউ দিনমজুরী খেটে সংসার চালান। এরই মধ্যে তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে যেখানে হিমশিম খায়, সেখানে স্কুল ড্রেস কিনে দেওয়ার সামর্থ্যই বা কি করে হয়। যে কারণে যে যার মতো করে স্কুলে কাপড় পড়ে যেত। আর এই বিষয়টি নজরে আসে নব নির্বাচিত ইউপি সদস্য আব্দুল মতিনের।
তিনি ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ফুটবল প্রতীকে তিনজনকে হারিয়ে ৪৩৮ ভোট পেয়ে মেম্বার নির্বাচিত হওয়ার পর বিদ্যালয়ে গিয়ে ঘোষণা দেন সব শিক্ষার্থীকে নিজ খরচে স্কুল ড্রেস বানিয়ে দেবেন। ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল শনিবার প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল ড্রেস বানিয়ে ওই স্কুলে উপস্থিত হন তিনি। পরে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ারুজ্জামান তালুকদার নাদিমকে সঙ্গে নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে স্কুল ড্রেস বিতরণ করেন।
এ সময় দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীরা অপ্রত্যাশিতভাবে স্কুল ড্রেস পেয়ে দারুন উচ্ছাসিত হয়ে পড়ে। তাদের অনাবিল আনন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে স্কুল চত্বর।
বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র জিহাদ হোসেন জানায়, আমার বাবা ভ্যান চালায়। খেয়ে না খেয়ে কোনোমতে সংসার চলে। এরই মাঝে নতুন কাপড় পড়ে স্কুলে আসা যাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার মনে করতাম। কিন্তু আজ আমাদের মেম্বার আঙ্কেল নতুন ড্রেস উপহার দিয়েছে, এতে আমরা খুব খুশি।
ওই বিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণির ছাত্রী আফরিনের দিনমজুর বাবা আজমল হোসেন অনেকটা আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন, অভাবের সংসারে কতো দিন হলো মেয়েটাকে নতুন কাপড় কিনে দিতে পারিনি। পুরাতন একটা জামা গায়ে দিয়েই সে স্কুলে যাতায়াত করতো। কিন্তু আজ দেখলাম আমাদের এলাকার নতুন মেম্বার আমার মেয়ের মতো সব ছাত্র ছাত্রীদের নতুন ড্রেস কিনে দিয়েছে। এতে একজন গরিব বাবা হিসেবে কতটা যে খুশি হয়েছি, তা বুঝিয়ে শেষ করতে পারবো না।
স্কুল ড্রেস বিতরণ করা ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত সদস্য (মেম্বার) আব্দুল মতিন আকন্দ বলেন, প্রতিটি শিশুই প্রত্যাশা করে তারা নতুন কাপড় পড়ে স্কুলে যাবে। কিন্তু আমার এলাকার স্কুলটির অধিকাংশ শিক্ষার্থী গরিব হওয়ায় তা সম্ভব হয় না। তারা অধিকাংশই পুরনো কাপড় পরে স্কুলে আসে। আর এই দৃশ্যটি দেখেই মূলত আমি এ সিদ্ধান্ত নিই এবং বাস্তবায়ন করি।
এ ব্যাপারে বানিয়াচাপড় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মেহেরুল ইসলাম বলেন, নব নির্বাচিত মেম্বারের এমন উদ্যোগে আমরা অত্যন্ত খুশি। তিনি শুধু স্কুল ড্রেস বিতরণ করেই দমে যাননি, তিনি পড়াশোনায় মনোযোগী করাতে বৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষকদের প্রত্যেককে ৫ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন।
এ বিষয়ে আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ারুজ্জামান তালুকদার নাদিম জানান, তিনি ধন্য এমন একজন শিক্ষানুরাগী মেম্বার পেয়ে। বর্তমান সময়ে যেখানে যে যার পকেট ভরাতে ব্যস্ত, সেখানে একজন মেম্বারের এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। আমরা চাই এমন জনপ্রতিনিধি প্রতিটি এলাকায় নির্বাচিত হোক।
জানা যায়, জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের বাঁশতা গ্রামের বাসিন্দা মৃত আব্দুস সামাদ আকন্দের সাত ছেলে মেয়ের মধ্যে আব্দুল মতিন ২য়। তিনি ১৭ বছর ধরে মালয়েশিয়াতে থাকার পর দেশে এসে গরিব মানুষদের নানাভাবে উপকার করে যাচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রত্যেক ঈদে দরিদ্র মানুষদের শাড়ি, লুঙ্গি, সেমাই, চিনি বিতরণের পাশাপাশি সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন এলাকায় টাকা ও খাবার বিতরণ করেন। তার উদ্দেশ্য যত দিন তিনি বেঁচে থাকবেন, ততদিন অসহায় মানুষদের উপকার করবেন।