মাটিখেকোদের ভয়ংকর থাবা কৃষি জমিতে

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২২; সময়: ১২:১৩ অপরাহ্ণ |
মাটিখেকোদের ভয়ংকর থাবা কৃষি জমিতে

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : ইটভাটা-টাইলস কোম্পানির বিরুদ্ধে উর্বর কৃষিজমির ওপরের মাটি কেটে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন এলাকায়। টাকার লোভ এবং অসচেতনতার কারণে কৃষকরা মাটি বিক্রি করে নিজের পায়ে কুড়াল মারছেন।

জাতীয় ভূমিনীতিবিরোধী এ কাজে যুক্ত আছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। প্রশাসনের কাছে আবেদন করেও প্রতিকার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, আইনের অভাবে নেওয়া যাচ্ছে না শক্ত ব্যবস্থা।

চাঁদপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকার কৃষিজমি থেকে কৌশলে ব্যবসায়ীরা ওপরের মাটি তুলে নিচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক আখতার হোসেন বলেন, এটা খুবই ভয়ংকর বিষয়।

ধান আমাদের প্রধান ফসল। ধান গাছের শেকড় ৫-৯ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর এই ৯ ইঞ্চি পর্যন্তই থাকে মাটির মূল পুষ্টিগুণ। তাই ফসলি জমির ওপরের মাটি কোনোভাবেই অন্য কাজে লাগানো যাবে না। তিনি বলেন, অসচেতন কৃষকরা টাকার জন্য এটা করেন। সচেতন কৃষক কখনোই এটা করেন না। এটা বন্ধে সরকারের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক বিধান কুমার ভান্ডার যশোর এলাকায় কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে  বলেন, ইটভাটার মালিকরা খুব কৌশলে কাজটি করে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, অসচেতন কৃষকদের কোনো একজনকে ইটভাটা মালিকদের পক্ষ থেকে প্রথমে বলা হয় বোরো জমিতে চাষের সময় অনেক পানি লাগে। তোমার জমির ওপরের কিছু মাটি বিক্রি করে দাও তাহলে পানি বেশি থাকবে, খরচ কমবে।

বিধান কুমার বলেন, একইভাবে পরের বছর পাশের জমি মালিককে বলবে, তোমার জমির পানি তো পাশের নিচু জমিতে চলে যায়, এতে তোমার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তোমার জমি থেকে আরেকটু বেশি করে মাটি দাও তাহলে তোমার জমিতে পানির খরচ কমে যাবে।

অসচেতন কৃষক নগদ টাকা ও পানি খরচ বাঁচানোর লোভে এটা করে। কিন্তু তারা জানে না যে, ওপরের মাটিতে গাছের খাদ্য উপাদানের মূল আধারগুলো থাকে। এই মাটি চলে গেলে উৎপাদন অনেক কমে যায়। ৮-১০ বছরেও আগের অবস্থানে ফেরে না।

জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি-২০০১-এর ৫.৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘উর্বর কৃষিজমি যেখানে বর্তমানে দুই বা ততোধিক ফসল উৎপাদনের জন্য সম্ভাবনাময়, তা কোনোক্রমেই অকৃষিকাজের জন্য যেমন ব্যক্তিমালিকানাধীন নির্মাণ, গৃহায়ন, ইটভাটা তৈরি ইত্যাদির জন্য ব্যবহার করা যাইবে না’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সম্প্রতি শেষ হওয়া ডিসি সম্মেলনে চাঁদপুরের ডিসির পক্ষ থেকে কৃষিজমির ওপরের মাটি রক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, কৃষিজমির মাটি কেটে ইটভাটায় ব্যবহার ও দুই-তিন ফসলি জমিতে পুকুর কেটে অবাধে মাছ চাষের কারণে প্রতিনিয়ত কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে। চাঁদপুরের ডিসি অঞ্জনা খান মজলিস যুগান্তরকে বলেছেন, কৃষিজমির ওপরের মাটি কেটে নিলে ফসল উৎপাদন কম হবে।

এটা না জানার কারণে অনেক কৃষক মাটি বিক্রি করে দেন। আবার অনেকে বিক্রি করতে বাধ্য হন। এটা শুধু কৃষকের ক্ষতি নয়, আমাদের জাতীয় খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য বড় ক্ষতি। তিনি বলেন, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় পরিবেশ আইনসহ বিভিন্ন আইনের আওতায় মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়। তাই যুগোপযোগী একটি আইনের প্রস্তাব করেছি। যাতে এই অনিয়ম করতে কেউ সাহস না পায়।

ময়মনসিংহ বিভাগের একজন ডিসি  বলেন, শুধু প্রশাসনিক উদ্যোগে এই অনিয়ম বন্ধ করা কঠিন। প্রয়োজন রাজনৈতিক উদ্যোগের। মধুপুর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ফসলি জমি রক্ষায় একাধিক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীরা এসব কাজে যুক্ত থাকায় তা পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে না।

মধুপুর গড় এলাকার উন্নয়নকর্মী প্রিন্স এডওয়ার্ড মাংসাং বলেন, ভূমিখেকোদের কারণে সাধারণ কৃষক খুব অসহায় অবস্থায় পড়েছে। যারা লোভে জমির মাটি বিক্রি করে দেয় তাদের জন্য সমস্যায় পড়েন পাশের জমির মালিকরা। তিনি বলেন, কোনো এলাকায় ২০-৩০ ফুট পর্যন্ত গভীর করে মাটি নিয়ে যাচ্ছে। ফলে পাশের জমি ভাঙছে। এতে মাটি বিক্রি না করেও পাশের কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে বাঁচতে মধুপুরবাসী কয়েকটি ইটভাটার নাম উল্লেখ করে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন।

সেখানে বলা হয়েছে, মেসার্স তাজ ব্রিকস গরিব কৃষকের জমির মাটি কেটে পৌর এলাকার পাশের একটি জায়গায় নিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে ইট প্রস্তুত করছে। এরপর সেই কাঁচা ইট আউশনারা ইউনিয়নের ইটখোলায় নিয়ে পোড়ানো হচ্ছে। ইটখোলার বাইরে ইট প্রস্তুত করার নিয়ম নেই। কিন্তু তাজ ব্রিকস তাই করছে।

কৃষিমন্ত্রীর কাছে আরেক অভিযোগকারী তুলা সরকার বলেন, আমার পাশের জমির মাটি কেটে নিয়ে গেছে। এখন বৃষ্টি হলেই আমার জমির মাটি নিচু জমিতে গিয়ে পড়ছে। আমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। তিনি বলেন, মদিনা ব্রিকসের মালিক মুনসুর আলীসহ অন্যরাও বিনাবাধায় এসব কাজ করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে মুনসুর আলী যুগান্তরকে বলেন, আমরা মাটি নেই ঠিক আছে। কিন্তু উর্বর ফসলি জমির মাটি না নিয়ে অনুর্বর কৃষি জমির মাটি কিনে নিই।

এসব ক্ষেত্রে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের প্রভাব খাটানোর অভিযোগ রয়েছে। মধুপুর উপজেলার আউশনারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। মধুপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ছরোয়ার আলাম খান আবু  বলেন, ‘রেকর্ডের জমি থেকে মাটি বিক্রি করলে তো কিছু বলার উপায় নেই।’ তিনি বলেন, আমি কোনো অবৈধ কাজে প্রশ্রয় দিই না।

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার ভূমি জুবায়ের হোসেন বলেন, কৃষিজমির মাটি কাটার বিষয়ে কোনো অভিযোগ এলে গুরুত্ব দিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। তিনি বলেন, বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে আমরাও উপজেলার বিভিন্ন এলাকার খোঁজখবর রাখি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে ফসলি জমির সুরক্ষার বিকল্প নেই। জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, উর্বর কৃষি জমির ওপরের অংশ কেটে নেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

এ বিষয়ে আমাদের আরও কঠোর হতে হবে। তিনি বলেন, শিল্পায়ন করতে হলে কিছু বিষয়ে ছাড় দিতে হয়। তবে এক্ষেত্রে উর্বর কৃষিজমি থেকে মাটি না নিয়ে অনুর্বর জমি থেকে মাটি নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।

সূত্র: যুগান্তর

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে