দৈহিক গড়ন নিয়ে কটাক্ষের শিকার ৭০ শতাংশ নারী

প্রকাশিত: মার্চ ৫, ২০২২; সময়: ১০:২৬ অপরাহ্ণ |
দৈহিক গড়ন নিয়ে কটাক্ষের শিকার ৭০ শতাংশ নারী

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : দৈনন্দিন জীবনে ঘরে এবং বাইরে ৭০ শতাংশ নারী তাদের চেহারা, গায়ের রং, উচ্চতাসহ দৈহিক গড়ন নিয়ে নানা ধরনের বিরূপ মন্তব্যের শিকার হচ্ছেন বলে এক জরিপে উঠে এসেছে। ‘তরুণীদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব’ শীর্ষক এক জরিপে এমন তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন।

শনিবার ভার্চুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস সামনে রেখে পরিচালিত এই সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ।

জরিপের তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ৬৯ দশমিক ৯২ শতাংশ তরুণী তাদের শারীরিক অবয়ব নিয়ে নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন।

এদের মধ্যে ৩৭ দশমিক ২৪ শতাংশ তরুণী বলছেন, শরীরের আকৃতি ,গঠন এবং অবয়ব নিয়ে আত্মীয়রাই কথায় ও ইঙ্গিতে হেয় প্রতিপন্ন করেন তাদের। এছাড়াও বন্ধুবান্ধবের কাছে বডি শেমিংয়ের শিকার হয়েছেন ২২ শতাংশ। আর ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ তরুণী বলেছেন, পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেও এ ধরনের মন্তব্য শুনেছেন তারা।

বিভিন্ন জেলা এবং বিভাগের ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী এক হাজার ১৪ জন শিক্ষিত তরুণী জরিপে অংশ নেন। এদের মধ্যে ৮৮ দশমিক ১৭ শতাংশ অবিবাহিত , ১০ দশমিক ৯৫ শতাংশ বিবাহিত এবং বাকিরা আর সংসার করছেন না।

প্রতিদিনের জীবনে নারীরা কতটা বৈষম্য, লাঞ্ছনা, যৌন হয়রানি, সমাজ ও পরিবারের বাধা এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সম্মুখীন হয়েছেন এবং সেসব ঘটনা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে কেমন প্রভাব ফেলেছে তা এই জরিপে তুলে ধরা হয়।

দেখা গেছে, ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ তরুণীকে পথচারীর কাছে থেকে শারীরিক অবয়ব নিয়ে নেতিবাচক কথা শুনতে হয়েছে। ওজন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হন ৩৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ তরুণী।

আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, গায়ের রঙে নিয়েও ৩৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ তরুণী এ ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান। এছাড়া উচ্চতা, মুখাবয়বের গঠন ও দাগ, কণ্ঠস্বর নিয়েও নানা বিরূপ কথা শুনেছেন তরুণীদের অনেকেই।

জরিপে অংশ নেওয়া ২৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ তরুণী মনে করেন, আর্থিক অস্বচ্ছলতা তাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। পাশাপাশি বেকারত্বের কারণে ১৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ তরুণী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন।

সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়ে ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং যৌন নিপীড়নের কারণে ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ তরুণী মানসিকভাবে প্রভাবিত হন।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতিনিয়ত হেয় প্রতিপন্ন হলে একজন মানুষের আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং হীনমন্যতা কাজ করে। পরে এসব ঘটনা আত্মহত্যার অনুঘটক হিসেবেও ভূমিকা রাখে।

সমীক্ষা বলছে, পারিবারিক টানাপোড়েন তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যে সবচেয়ে প্রভাব ফেলে; যা ৩১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বাবা-মা অথবা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া ২৭ দশমিক ৩২ শতাংশের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।

সংবাদ সম্মেলনে আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, জরিপে অংশ নেওয়া ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ তরুণী নিজেদের সম্মতি না থাকার পরও পরিবার থেকে বিয়ের চাপের সম্মুখীন হন।

এদের মধ্যে ১০৯ জনের পরিবার পরে বিয়ে না হওয়ার ভয় থেকে এমন চাপ সৃষ্টি করেন। ‘কমবয়সী মেয়েদের ভালো বর হয়’ এমন ধারণার কারণে ৮৬ জনের উপর পারিবারিকভাবে বিয়ের চাপ আসে।

জরিপে অংশ নেওয়া ৮৫ জন তরুণীকে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে শিক্ষাবর্ষ দীর্ঘায়িত হওয়ায় বিয়ের চাপ মোকাবেলা করতে হয়েছে।

এছাড়া ২২ দশমিক ২৯ শতাংশ তরুণীর মতামতকে পরিবারে মূল্যায়ন করা হয় না। শুধুমাত্র নারী হবার কারণে মতামত প্রকাশে বাধার মুখে পড়তে হয় ৪৬ দশমিক ২৫ শতাংশকে।

যৌন হয়রানির শিকার ৬৫.৫৮ শতাংশ তরুণী

সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ৬৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ তরুণী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ তরুণী বলছেন, তারা বিকৃত যৌন ইচ্ছার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বা কুদৃষ্টির মাধ্যমে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন।

২৯ দশমিক ৬২ শতাংশ তরুণীকে আপত্তিকর স্পর্শের ভুক্তভোগী হতে হয়েছে। আর বিভিন্ন স্থানে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছেন ২২ দশমিক ২৬ শতাংশ।

সমীক্ষা বলছে, ৪৫ দশমিক ২৭ শতাংশ তরুণী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। গণপরিবহণে আপত্তিকর স্পর্শের শিকার হন ৬৪ দশমিক ৯২ শতাংশ তরুণী। ২০ দশমিক ৪ শতাংশ কুদৃষ্টি এবং অনুসরণের শিকার হয়েছেন।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বাস এবং বাসস্ট্যান্ডে যৌন হয়রানির সম্মুখীন হন ৮৪ দশমিক ১০ শতাংশ তরুণী।এছাড়া রেল যাত্রায় বা রেল স্টেশনে ৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ তরুণী যৌন হয়রানির শিকার হন।

জরিপে বলা হয়, তরুণীরা সবচেয়ে বেশি আপত্তিকর স্পর্শের শিকার হন একা চলার সময়; যা ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।তবে ২১ দশমিক ৫৭ শতাংশ জানিয়েছেন, সঙ্গে মা-বোন, বান্ধবী কিংবা অন্য নারী সঙ্গী থাকা অবস্থাতেও তাদের এমন অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয়েছে। ২ দশমিক ৮৩ শতাংশ তরুণী এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন যখন সঙ্গে বাবা, স্বামী, ভাই অথববা অন্য পুরুষ সঙ্গী ছিল।

শৈশবে যৌন নিপীড়ন

৩৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ তরুণী তাদের শৈশবে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন বলে জরিপে উঠে এসেছে। এর মধ্যে আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে ৩৫ দশমিক ২৮ শতাংশ, অপরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে ২৮ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রতিবেশীদের কাছে যৌন হয়রানির শিকার হন।

শৈশবের এসব ঘটনা ২৮ দশমিক ৪৩ শতাংশের মনে সবার প্রতি অবিশ্বাসের জন্ম দেয় এবং ২৮ দশমিক ১৭ শতাংশের ভেতর পুরুষ বিদ্বেষী মনোভাব সৃষ্টি হয়।

জরিপ বলছে, শৈশবের এসব অভিজ্ঞতার জেরে বড় হওয়ার পরও ১৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ তরুণী একা থাকতে ভয় পান।এছাড়া অনেকেই পরে বিয়ে করতে বা শারীরিক সম্পর্কে জড়াতেও ভয় পান বলে জরিপের তথ্যে বলা হয়।

জরিপে অংশ নেওয়া তরুণীদের ৪৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ অনলাইনে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন বলে জানানো হয়। এর মধ্যে অবান্তর এবং কুরুচিপূর্ণ মেসেজ পাঠিয়ে এবং মন্তব্য করে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছে ৬১ দশমিক ১২ শতাংশ তরুণীকে।

সোশাল মিডিয়ার আইডি হ্যাক হয়েছে ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ তরুণীর। ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল ছবি নিয়ে দুর্ভোগ পোহান। ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ তরুণী জানান, তাদের আইডি স্টক করা হয়।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে