রাজশাহীতে বনভোজনে নিয়ে শিশুদের শিবিরের তালিম

প্রকাশিত: মার্চ ৯, ২০২২; সময়: ২:০৪ অপরাহ্ণ |
রাজশাহীতে বনভোজনে নিয়ে শিশুদের শিবিরের তালিম

নিজস্ব প্রতিবেদক : কোচিং সেন্টারের বনভোজন বলে ২০০ টাকা করে চাঁদা নেয়া হয়। রাজশাহী নগরের ভদ্রা থেকে বাসে উঠায়। দুপুরের আগেই তানোরের নাইস গার্ডেনে নিয়ে যায়। তাদের বাসের সামনে-পেছনে পাঁচ-ছয়টি মোটর সাইকেলে ছিল কয়েকজন।

নাইস গার্ডেনে আগে থেকে পাতা ছিল কয়েকশো চেয়ার। অল্প সময়ের মধ্যে পাঞ্জাবি-টুপি পরা কয়েকজন এলেন। একটা ব্যানার টানানো হলো। তাতে লেখা, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। সেখানে ইসলামি বয়ান রাখেন কয়েকজন।

শিশু-কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে দলে টানতে বনভোজনের নামে নিয়ে গিয়ে এভাবেই নির্জন পার্কে ছাত্রশিবিরের তালিম দেয়ার চেষ্টা চালানো হয়। খবর পেয়ে পুলিশ দেড়শো শিশু-কিশোরকে উদ্ধার করে। গ্রেপ্তার করেছে ৫৩ তরুণকে।

এ সময় দুটি বাস থেকে পুলিশ জিহাদি লিফলেট, কলম, বই, হ্যান্ডনোট ও ২৬০টি টি-শার্ট জব্দ করে। কলমে ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির’ -এর নাম লেখা আছে। গোলাম আযমের লেখা বইও পাওয়া যাছে সেখানে।

গত রোববার রাজশাহীর তানোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের দুটি পার্কে কথিত বনভোজনের আয়োজন করা হয়েছিল। জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা শিশুদের নির্জন পার্ক দুটিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। উদ্ধার হওয়া শিশুদের পরে অভিভাবকদের জিম্মায় দেয়া হয়েছে। আর ৫৩ তরুণকে নাশকতার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে সোমবার আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।

পুলিশ জানায়, রাজশাহীর ‘ইউনিটেক কোচিং সেন্টার’ থেকে বনভোজনের নামে শিশু-কিশোরদের তানোর ও নাচোলের দুটি নির্জন পার্কে নেয়া হয়েছিল। রোববার কথিত বনভোজন চলার সময় পুলিশ ওই তরুণদের গ্রেপ্তার করে। আর সোমবার ভোররাতের দিকে শিশু-কিশোরদের তাদের অভিভাবকের জিম্মায় দেওয়া হয়।

তানোরের পার্কটির নাম ‘নাইস গার্ডেন’। এর আগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি এই পার্কে জামায়াতে ইসলামীর ২০০ নেতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। তাঁদের সাংগঠনিক কাজে প্রায়ই তাঁরা এই নির্জন পার্ক ব্যবহার করেন বলে নাইস গার্ডেনের একটি নির্ভযোগ্য সূত্র দাবি করছে।

এছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের ‘স্বপ্নপল্লী’ নামে পার্কটিও একই কাজে ব্যবহার করা হয়। এই পার্কের অবস্থান আরও নির্জন এলাকায়। ২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর এই পার্কে নাশকতার বৈঠকে অভিযান চালিয়ে জামায়াত-শিবিরের ব্যানার ও রান্না করা খাবার জব্দ করেছিল পুলিশ।

নাইস গার্ডেনের ব্যবস্থাপক মো. রেন্টু বলেন, ইউনিটেক কোচিং সেন্টারের দুজন শিক্ষার্থী পরিচয়ে ৬ মার্চের জন্য তাঁদের পার্কটি বুকিং দিয়েছিলেন। ঘটনার দিন রোববার সকাল সাতটায় তাঁদের বাবুর্চি এসে রান্না শুরু করেন। পরে তাঁদের বাস আসে। কিছুক্ষণ পর তাঁরা নাচোলে স্বপ্নপল্লীতে চলে যান। ফিরে এসে খাওয়ার কথা ছিল। পরে আর আসেননি।

কথিত বনভোজনে যোগ দেয়া রাজশাহীর দুই শিক্ষার্থীর কাছ থেকে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। তারা জানিয়েছে, এটা যে রাজনৈতিক কোনো সফর, তারা আগে বুঝতে পারেনি। কোচিং সেন্টারের বনভোজন বলে ২০০ টাকা করে চাঁদা দিয়ে তারা গিয়েছিল। নগরের ভদ্রা থেকে বাসে ওঠে। দুপুরের আগেই তারা নাইস গার্ডেনে পৌঁছায়। তাদের বাসের সামনে-পেছনে পাঁচ-ছয়টি মোটরসাইকেলে বড় ভাইয়েরা ছিলেন।

নাইস গার্ডেনে গিয়েই তারা বুঝতে পারে, কোনো রাজনৈতিক সফর এটি। সেখানে গিয়ে দেখে, কয়েকশো চেয়ার পাতা। অল্প সময়ের মধ্যে পাঞ্জাবি-টুপি পরা কয়েকজন এলেন। একটা ব্যানার টানানো হলো। তাতে লেখা, ইসলামী ছাত্রশিবির। সেখানে ইসলামি বয়ান রাখেন কয়েকজন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাদের নিয়ে সেখানে কুইজের আয়োজনও করা হয়। পাশে রান্নাবান্না চলছিল। হঠাৎ সেখানে খাবার না দিয়েই সবাইকে বাসে উঠতে বলা হয়।

শিক্ষার্থীদের বলা হয়, তাদের নিয়ে এবার বাস চলে যাবে নাচোলে। বিকেলের আগেই নাচোলের স্বপ্নপল্লী রিসোর্ট সেন্টারে নেয়া হয় তাদের। সেখানে খিচুড়ি খেতে দেয়া হয়। এরপরই তাড়াতাড়ি বাসে উঠতে বলা হয়।

বলা হয়, পার্কের চারপাশ পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। বাস বেরোতে না বেরোতেই স্থানীয় কিছু যুবক লাঠিসোঁটা নিয়ে সামনে চলে আসেন। তাদের ছাত্রলীগের কর্মী বলে মনে হয়েছে। তারা কয়েকজনকে মারধরও করেন। আর তাদের বলতে শোনা গেছে, ‘আজকে ২০ হাত মাটির নিচে গেলেও তোদের ধরা হবে।’

ওই দুই শিক্ষার্থী তাদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলে, নাচোলের পার্ক থেকে তাদের বাস দুটি একটা কলেজ মাঠে নেয়া হয়। সেখানে ১৮ বছরের বেশি ও নিচের শিক্ষার্থীদের আলাদা করা হয়। বিকেল চারটার দিকে নাচোল থানায় নেয়া হয় তাদের।

তবে শিক্ষার্থীদের বাস থেকে নামানো হয়নি। সন্ধ্যার দিকে পুলিশের পক্ষ থেকে একটি করে পাউরুটি দেয়া হয়। এ সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘তোমাদের কোনো ভয় নেই। সবার অভিভাবককে থানায় আসতে বলা হয়েছে।’

এক শিক্ষার্থী বলে, তারা ভাবতেও পারেনি যে বনভোজনের কথা বলে এমন একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে নেওয়া হবে। তাদের সঙ্গে চতুর্থ শ্রেণি থেকে শুরু করে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীও ছিল। তারা সোমবার ভোরে অন্য বাসে করে সকাল আটটার দিকে রাজশাহীতে আসে।

আটক শিক্ষার্থীর এক অভিভাবক বলেন, ছেলেকে কোচিং থেকে বলা হয়েছে, তাদের বনভোজনে নিয়ে যাওয়া হবে। তাঁরা সরল বিশ্বাসে ছেলেকে পাঠালেন। কিন্তু সন্ধ্যায় খবর এল, পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গেছে। তার ছেলে তো কোনো রাজনীতিতে নেই। তাদের নিয়ে যাঁরা প্রতারণা করেছেন, তাঁদের পুলিশ আটক করুক। এই বাচ্চাদের কেন হয়রানি করা হচ্ছে?

ইউনিটেক কোচিং সেন্টার নামে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান রাজশাহী নগরের কাদিরগঞ্জ এলাকায় বলে উল্লেখ রয়েছে নাইস গার্ডেনে দেয়া বুকিং মোমোতে। কাদিরগঞ্জ এলাকায় গেলে স্থানীয় কয়েকজন কোচিং সেন্টারটি যে ভবনে চলত, সেটি দেখিয়ে দেন। কিন্তু সেই ভবনে কোচিং সেন্টারের কোনো সাইনবোর্ড পাওয়া যায়নি। স্থানীয় লোকজন বলছেন, ওই ঘটনার পরপর সাইনবোর্ডটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

নাইস গার্ডেনে সশরীর গিয়ে বুকিং দিয়েছিলেন মো. মারুফ মুর্তজা নামের এক ব্যক্তি। সেখানে দেওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে মারুফ মুর্তজা বলেন, তিনি ওই গার্ডেনে বুকিং দিয়েছিলেন। তিনি ওই কোচিং সেন্টারে কাজ করেন। কিন্তু নিজের পরিচয় না দিয়ে ফোন কেটে দেন।

নাচোল থানার ওসি মিন্টু রহমান বলেন, কোচিংয়ের নামে শিশুদের শিবির নেতারা এসব পার্কে এনে ‘মগজ ধোলাই’ করেন। সেখানে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীও ছিল। এসব শিশু-কিশোরের পরিবার অসচ্ছল। এ সুযোগ তারা নিয়ে থাকেন।

ওসি বলেন, দুই বাসের সঙ্গে মোটরসাইকেলে আরও অনেকেই ছিলেন। তারা পালিয়ে গেছেন। বাসের ৫৩ জনকে নাশকতার পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের সোমবার বিকেলে আদালতে সোপর্দ করা হয়। আর অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪৯ শিশুকে অভিভাবকদের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

ওসি আরও বলেন, অভিযানে বাস থেকে জিহাদি লিফলেট, হ্যান্ডনোট ও ২৬০টি টি-শার্ট উদ্ধার করা গেছে। আরও অনেক কিছু ছিল হয়তো। শিবিরের বড় নেতারা আগেই পালিয়েছেন।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে