৫ টাকা কেজির টমেটো ঢাকায় ৫০

প্রকাশিত: মার্চ ১৩, ২০২২; সময়: ১১:৪২ পূর্বাহ্ণ |
৫ টাকা কেজির টমেটো ঢাকায় ৫০

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : এবার ভরা মৌসুমেও চড়া সবজির বাজার। অথচ সবজি উৎপাদন ও বিক্রির বৃহৎ পাইকারি বাজার রংপুরে পাঁচ টাকার নিচে নেমেছে টমেটোর কেজি। একই সঙ্গে আলু, পেঁয়াজ, শিম, পেঁপে, লাউ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শসা, গাজর, পালংশাক, লালশাক, পুঁইশাক ও কাঁচা মরিচের দাম কমেছে। কষকরা বলছেন, বাজারে সবজি বিক্রি করে খরচই উঠছে না। অনেকেই লোকসান গুনছেন।

এদিকে কৃষকের কাছ থেকে কম দামে এসব সবজি কিনে লাভবান হচ্ছেন পাইকার, আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। মূলত হাতবদল আর চাঁদাবাজির কারণে কৃষকের কম দামের সবজি চার-পাঁচ গুণ বেশি দামে কিনতে হয় ভোক্তাদের।

গত দুই দিন ধরে রংপুরের বৃহৎ পাইকারি মোকাম, সদর উপজেলার পালিচড়া, মিঠাপুকুরের বলদিপুকুর, জায়গিরহাট, শঠিবাড়ি, বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন পাইকারি বাজারে ঘুরে সবজির দামের আকাশ-পাতাল তফাৎ দেখা গেছে। স্থানীয় কৃষক, পাইকার, আড়তদার, খুচরা ব্যবসায়ী ও ঢাকার কারওয়ান বাজারের পাইকারদের সঙ্গে কথা বলে শাক-সবজির দাম বাড়ার কারণ জানা গেছে।

মিঠাপুকুরের বলদিপুকুর ও জায়গিরহাটে সবচেয়ে বেশি শাক-সবজি পাইকারি বিক্রি হয়। ভোর থেকে শুরু হয় কেনাবেচা। দুপুরের আগেই কেনাবেচা শেষ হয়ে যায়। জেলা এবং আশপাশের জেলা ও ঢাকার আড়তদার, পাইকারি ব্যবসায়ীরা এখান থেকে সবজি কেনেন।

বলদিপুকুর ও জায়গিরহাট পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পাইকারিতে ২০০-২২০ টাকা বড় টমেটোর মণ বিক্রি করছেন কৃষকরা। ছোট সাইজের টমেটোর মণ ১৫০-১৮০ টাকা। হিসাবে চার থেকে সাড়ে পাঁচ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে টমেটোর কেজি।

যেভাবে হয় কেনাবেচা ও হাতবদল

কৃষকরা ক্ষেত থেকে সবজি তুলে বলদিপুকুর ও জায়গিরহাট পাইকারি বাজারে আনেন। এরপর ২০০-২২০ টাকা টমেটোর মণ কিনছেন পাইকাররা। তারা টমেটো কিনে স্তূপ করে রাখেন। তাদের কাছ থেকে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা মণ কেনেন আড়তদাররা। তারা শ্রমিক ও পরিবহন খরচ দিয়ে বিভিন্ন স্থানে টমেটো নিয়ে যান। এরপর ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা মণ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। ব্যবসায়ীরা ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। এরপর খুচরা ব্যবসায়ীরা ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করেন। এই দাম সবসময় ওঠানামা করে কেনার ওপর। মূলত হাতবদলে দাম চার-পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। তবে আড়তদাররা বলছেন, পরিবহন খরচ ও পথে পথে চাঁদাবাজির কারণে দাম বেড়ে যায়।

মিঠাপুকুর উপজেলার ভক্তিপুর থেকে ১০ মণ টমেটো নিয়ে বলদিপুকুর বাজারে এসেছেন কৃষক সাদেক আলী। তিনি বলেন, ১০ মণ টমেটো বিক্রি করলাম দুই হাজার টাকা। এতে জমি চাষ, উৎপাদন, সার ও শ্রমিক খরচসহ সবমিলে খরচই ওঠেনি। তবে আমাদের কাছ থেকে টমেটো কিনে চার-পাঁচ বেশি দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ী ও পাইকাররা।

একই কথা জানালেন বলদিপুকুর, দমদমা, মনোহরপুর, পালিচড়া থেকে ফুলকপি, বাঁধাকপি বিক্রি করতে আসা কৃষকরা। বলদিপুকুর এলাকার কৃষক মো. সাহাবুল, দমদমার মো. সোলায়মান, মনোহরপুরের শওকত আলী জানান, ফুলকপি ও বাঁধাকপির পিস পাঁচ টাকা দরে বিক্রি করছি। আমরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছি না।

লাউয়ের দামেরও অবস্থা একই। ১০০ লাউ বিক্রি সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা বিক্রি করছেন কৃষকরা। হিসাবে প্রতি পিস লাউ ৩০ টাকা। সেই লাউ আড়তদার নিয়ে প্রতি পিস বিক্রি করছেন ৬০-৭০ টাকা।

একই অবস্থা শিমেরও। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা। সেই শিম আড়তদারদের কাছ থেকে কিনে ৬০-৭০ টাকা বিক্রি করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।

মনোহরপুরের কৃষক মমতাজ উদ্দীন বলেন, কাঁচা পেঁপের পাল্লা (পাঁচ কেজি) বিক্রি করছি ৬০-৭০ টাকা। অথচ খুচরা বাজারে পেঁপের কেজি ৪০-৫০ টাকা।

পালিচড়ার কৃষক আমজাদ আলী বলেন, ২০-২৫ কেজি দরে বেগুন বিক্রি করছি। আমাদের খরচই উঠছে না। অথচ খুচরা বাজারে বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকা কেজি।

বলদিপুকুরের কৃষক হাছান আলী বলেন, কাঁচা মরিচ পাইকারি বাজারে ৩০-৩৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করছি। ওই মরিচ আড়তদারদের কাছ থেকে কিনে ৮০-১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। চাষাবাদ করে আমরা লোকসান গুনছি, আয় করছেন আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা।

নবদীগঞ্জের কৃষক মো. রহমান মিয়া বলেন, পাইকারিতে ২৫-৩০ টাকা পেঁয়াজের কেজি বিক্রি করছি। অথচ বাজারে ৬০ টাকার নিচে কোনও পেঁয়াজ নেই।

আড়তদার আর পাইকাররা যা বললেন

ঢাকা থেকে বলদিপুকুর ও জায়গিরহাটে সবজি কিনতে আসা ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান ও শাহানশাহ জানান, প্রথমত পাইকারি বাজার থেকে সবজি কিনে বস্তাভর্তি করা হয়। এরপর শ্রমিক খরচ, ট্রাক ভাড়া, রংপুর থেকে ঢাকায় নিতে রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি, হাইওয়ে পুলিশকেও চাঁদা দিতে হয়। ফলে আমাদের অনেক টাকা খরচ হয়। সব খরচ ধরে এরপর সবজির দাম নির্ধারণ করে বিক্রি করতে হয়। সেই সঙ্গে লাভও করতে হয়। অনেক সময় সবজি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমাদের লোকসান গুনতে হয়। তবে আমাদের সিন্ডিকেট আছে; এই কথা সত্য নয়। রাস্তায় চাঁদাবাজি, হাইওয়ে পুলিশের হয়রানি বন্ধ, ট্রাক ভাড়া কমানোসহ কয়েকটি বিষয় মনিটরিং করলে সবজির মানুষের নাগালে আসবে।

কারওয়ান বাজারের আড়তদার যা বললেন

কারওয়ান বাজারের সবজির আড়তদার সফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ওসব পাইকারি বাজার থেকে শাক-সবজি কেনার পর আড়তে আনা হয়। সব খরচ হিসাব করে আড়তদাররা একটা দাম নির্ধারণ করে বিক্রি করেন। ওই দামে কিনে নিয়ে যান পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তাদের কাছ থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে বিক্রি করেন। ফলে একটা সবজি চার-পাঁচ হাতবদলে পাঁচবার দাম বাড়ে। এজন্য বাজার মনিটরিং করে দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সংশ্লিষ্টদের। আর খুচরা ব্যবসায়ীদেরও বেশি লাভের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। তা না হলে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে না। আমাদের লাভ সীমিত। আমরা তো ৫০ টাকা টমোটোর কেজি বিক্রি করি না। ৫০-৬০ টাকা বিক্রি করেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।

এ ব্যাপারে রংপুরের কৃষকনেতা আনোয়ার হোসেন বাবলু বলেন, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার। কৃষকরা উৎপাদিত সবজির দাম পাচ্ছেন না। এভাবে চলতে পারে না। সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে রমজানে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে সাধারণ মানুষ।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বাজার মনিটরিং করেন। তারা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। তবে এটা সত্য, কৃষকরা শাক-সবজির ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর রংপুরের সহকারী পরিচালক আফসানা পারভীন বলেন, আমরা এখন তেল, গ্যাস ও অন্যান্য পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজারে অভিযান চালাচ্ছি। অধিদফতরে আমি একা মানুষ, একদিকে গেলে অন্যদিকে অনিয়মের খবর পাই। এই অভিযান শেষ হলে শাক-সবজির বাজারেও অভিযান চালাবো। কৃষকরা যাতে ন্যায্যমূল্য পান, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবো।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে