রাজশাহীতে ফের পুকুরখননের মহোৎসব

প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২২; সময়: ২:০১ অপরাহ্ণ |
রাজশাহীতে ফের পুকুরখননের মহোৎসব

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহীতে ফের ফসলি জমি ধ্বংস করে পুকুর খননের মহোৎসব শুরু হয়েছে। পবা ও গোদাগাড়ীসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় খনন করা হচ্ছে অপরিকল্পিত পুকুর। পুকুর খনন সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চালিয়ে যাচ্ছে এই খননযজ্ঞ।

অবিরাম পুকুর খনন করে মাটি বিক্রি করা হচ্ছে গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ি এলাকার গুসাইগাছি, ছয়ঘাটি এলাকায়। এ উপজেলায় বর্তমানে ১০/১২টি পুকুর খননের কাজ চলছে।

এছাড়াও পবা উপজেলার অনেক মাঠেই তিন ফসলি জমিতে শুরু হয়েছে সংস্কারের নামে মাটি বিক্রির জন্য পুকুর খনন। চোর-পুলিশ খেলায় বিভিন্ন কারণে হেরে যাচ্ছে পুলিশসহ প্রশাসন। তবে এবারে পবা উপজেলার কর্ণহার বিলে নতুন সংযোগ হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গোরস্থান, ঈদগাহ মাঠ ও রাস্তাঘাটের উন্নয়নের নামে পুকুরখনন। উপজেলার শুধু কর্ণহার বিলেই নয়, দারুসা, হুজুরিপাড়া, পারিলার ভবানীপুরেও দেদারসে চলছে পুকুরখনন। গতবছরের মত এবারের পারিলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নবীবুর রহমানের ছত্রছায়ায় এসব পুকুরখনন হচ্ছে বলে একটি বিশ্বস্তসুত্রে জানা গেছে।

এদিকে পুকুর খনন বন্ধে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনে আবেদন দিয়েও ফলাফল শূণ্যই থেকে যাচ্ছে। প্রেক্ষিতে একদিকে আবেদনকারিরা পড়ছে বিপাকে এবং অন্যদিকে খননকারিরা হচ্ছে উৎসাহিত।

পুকুরখননে জেলায় কমেছে খাদ্য উৎপাদন, হুমকিতে পড়েছে পরিবেশ। গত পাঁচ বছরে বাণিজ্যিক মাছের খামার বেড়েছে বহুগুণ। কমেছে চারণভূমি, সংকট বেড়েছে পশু খাদ্যের। কৃষি জমি কমেছে প্রায় হাজার হেক্টর (প্রায় ৭৫ হাজার বিঘা)। বর্ষায় জলাবদ্ধতায় ব্যাহত চাষাবাদ।

জানা গেছে, পানি শুকানোর পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় একদিকে জোরেশোরে এবং অন্যদিকে চুপিসারে আবারো শুরু হয়েছে অপরিকল্পিত পুকুরখননযজ্ঞ। প্রশাসনের কর্মকর্তারা দিনে খননকাজে ব্যবহৃত মেশিন অকেজো করলেও রাতে ঠিকই চলছে খনন। আর এ চিত্র জেলার প্রায় সবক’টি উপজেলাতেই। বিশেষ করে পবা, মোহনপুর, দুর্গাপুর, বাগমারা গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলায় পুকুরখনন এখন একেবারে খোলামেলা।

এরইমধ্যে পবা উপজেলার বাগধানি, কর্ণহার, পারিলা ও দর্শনপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে জোরেশোরে চলছে পুকুরখনন। প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙ্গিয়ে চলছে এসব পুকুরখনন। চলতি বছরের গত ৯ জানুয়ারী অবৈধ পুকুর খনন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন দর্শনপাড়া ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান শাহাদৎ হোসেন সাব্বির নিজেই। তবে এতেও কোন কাজ হয়নি। বর্তমানে তার ইউনিয়নেই বড় বড় পুকুরখনন হচ্ছে। ভূক্তভোগিরা আড়ালে তাকেও দোষারোপ করছেন।

পুকুরখননবন্ধে একটি আবেদন থেকে জানা গেছে, দারুশা এলাকার মৃত হারুনার রশিদ ওরফে হারানের ছেলে পুকুরখনন সিন্ডিকেটের প্রধান মিনারুল ইসলাম বিগত কয়েক বছর থেকে কর্ণহার ও এর আশেপাশের বিল এলাকায় পরিবেশ ও রাস্তাঘাট নষ্ট করে বেপরোয়াভাবে অবৈধ পুকুরখনন চালিয়ে যাচ্ছে। নতুনভাবে কর্ণহার গুচ্ছগ্রামের পাশে ১২৫ বিঘা পুকুরসহ আরো কয়েকটি পুকুরখনন করেছে। এবারে তিনি দারুশা সরিষাকুড়ি পশ্চিম পাড়ায় পুকুরখনন করছে। তবে এ কাজে উৎসাহ যোগাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে হুজুরীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। তিনি নাকি মিনারুলের পুকুরখননের জন্য উর্ধ্বতন মহলে তদবির করেছেন।

এদিকে রাজনৈতিক জবাবদিহিতা ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ছাড়া এই অপরিকল্পিত পুকুরখনন কখনোই সম্ভব নয়। এছাড়াও জনসচেতনতা বৃদ্ধি খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। পুকুর খননে মাছের লাভের চেয়ে অনেক বেশী ক্ষতি হচ্ছে কৃষিজীবী ও পরিবেশের। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের মদদেই অপরিকল্পিত পুকুর খননের মহোৎসব চলছে বলে জানিয়েছেন সচেতনমহল, পরিবেশবাদি ও ভুক্তভোগিরা।

শুধুমাত্র অপরিকল্পিত পুকুরখননের জন্যই রাজশাহী জেলার বিভিন্ন ফসলের মাঠে দেখা দিয়েছে জমির প্রকৃতি পরিবর্তন, দীর্ঘ মেয়াদি জলাবদ্ধতা, পুকুরখননে মাটি বহনে গ্রামীণ রাস্তা নষ্ট, ফসল উৎপাদন ব্যাহত, বিলের পানি বেরুনোর নালা (খাল, ড্রেনেজ) ব্যবস্থা না থাকায় গ্রামের বাড়ি-ঘরে জলাবদ্ধতা, কৃষিজীবীদের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্ঠনী নষ্ট, কৃষিকাজ না থাকায় যুব সমাজ মাদকে আসক্ত হচ্ছে এবং সর্বপুরি নগরীতে ভাসমান শ্রমিক বাড়ছে।

অপরিকল্পিত পুকুরখননের ফলে এসব না সূচক ও নেতিবাচক প্রভাব দেখেও অজানা কারণে নিশ্চুপ আছে প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। সচেতনমহল, পরিবেশবাদি ও ভুক্তভোগিরা পরোক্ষ ও প্রত্যেক্ষভাবেই দোষারোপ করে আসছে তাদের।

জেলার কৃষি দপ্তর বলছে, বাণিজ্যিকভাবে এসব পুকুর খনন হয়েছে আবাদি জমিতেই। অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খননে জলাবদ্ধতায় প্রতি বছরই ব্যাপক ফসলহানি হচ্ছে। ফসল হানির পরিমান প্রতিবছরই অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। পরিবেশের উপর বাড়ছে চাপ। এছাড়াও ফসল রোপনের আগেই ডুবে যাচ্ছে খনন এলাকা।

রাজশাহীতে আবাদযোগ্য জমির একটি বড় অংশ চলে গেছে বাণিজ্যিক পুকুর খননে। পরের বছরগুলো চিত্র আরো ভয়াবহ। জ্যামিতিক হারে কমছে জেলার কৃষি জমি। সচেতন মহল ও বিশেষজ্ঞদের মতে সঠিক হিসাব করলে প্রায় পুকুর ঘেরের জন্য কষি জমি নষ্টে ১০ হাজার হেক্টর ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রেণি পরিবর্তন করে আবাদযোগ্য জমিতে পুকুর খননের সুযোগ নেই। তারপরও এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি নানান কৌশলে পুকুর খনন করে যাচ্ছে। বিশেষ করে বিল ও নিচু এলাকাগুলোতে অনাবাদি কিংবা এক ফসলি দেখিয়ে পুকুর খনন করছেন। মুনাফালোভীরা সেই সুযোগটিই নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, মৎস্য খামারিরা সাধারণত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের জমি বছর মেয়াদি লিজ নিচ্ছেন কাউকে জমি বিক্রি করতে বাধ্যও করছেন। তাছাড়া জলাবদ্ধতার কারণে চাষাবাদ না হওয়ায় চাষিরাও জমি লিজ অথবা বিক্রি করছেন। পুকুর খনন করে পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা রাখছেন না খামারিরা। ফলে বর্ষায় জলাবদ্ধতায় ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ।

কৃষকরা বলছেন, ফসলি জমি কেটে আসলে পুকুর হচ্ছে না, বরং ঘের হচ্ছে। মাত্র চার থেকে পাঁচ ফুট খনন করা হচ্ছে। কিন্তু পুকুর করতে হলে অন্তত ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীর করে খনন করতে হয়। কিন্তু খামারে খনন হচ্ছে মাত্র ৫-৮ ফুট। ক্ষুদ্র চাষিরা অনেক সময় প্রভাবশালীদের ভয়ে, সাময়িক বেশী লাভের আশায় এবং শ্রম থেকে রেহাই পেতে পুকুর খনন করতে দিচ্ছে। কিন্তু প্রশাসন এই অপরিকল্পিত পুকুর খনন রোধে বরাবরই জেগে জেগে ঘুমাচ্ছেন। যা এ অঞ্চলে ভবিষ্যতে কৃষিতে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।

বর্তমানে জেলার যে উপজেলাতেই পুকুরখনন হচ্ছে-তা আওয়ামী লীগ নেতাসহ ইউপি চেয়ারম্যানের ছত্রছায়াই হচ্ছে। এর ব্যতিক্রম হয়নি হুজুরীপাড়া ইউনিয়নে। তার অধিনে মিনারুল আবারো পুকুরখননে নেমেছেন। এরআগে তার অন্যপুকুরে অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় হলেও এবারে প্রশাসন একেবারে নীরব। কর্ণহার থানা পুলিশ জানান, ইউপি চেয়ারম্যান বিভিন্ন জনকল্যাণ কাজে পুকুরটি খনন করছে বলে অলিখিতভাবে ছাড় দেয়া হচ্ছে। তবে এলাকাবাসি জানান, এই এলাকায় বেশীরভাগ পুকুরই মিনারুল কেটেছে।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত মিনারুল বলেন, এলাকায় পুকুরখনন হলেই আমার নাম হয়। এছাড়াও এর আগে এই জমিতে পুকুর কাঁটার সময় সহকারী কমিশনার ভূমি শেখ এহসান উদ্দীন স্যার আমাকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করেছিলেন। তাই এবারে পুকুরখনন করবো না বলেই ছিলাম। কিন্তু চেয়ারম্যানের সহযোগিতার জন্যই এবং এলাকার রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, ঈদগাহ ও গোরস্থানের উন্নয়নের জন্যই গতবারের খননকৃত পুকুর থেকে বিনামূল্যে মাটি সরবরাহ করা হচ্ছে। অন্যান্য বছরে মাটি বিক্রি করলেও এবারে জনগণের উপকারের জন্যই পুকুরখনন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

তিন ফসলি জমি ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের সামনে পুকুর কাঁটার বিষয়ে মিনারুল আরো জানান, পুকুর কাঁটা যাবে না, এমন কোন আইন বাংলাদেশে নাই। আর পুকুরে মাছ চাষ করে ফসল চাষের তুলনায় দ্রুত লাভবান হওয়া যায় এবং আমি পুকুরের ব্যবসা করে অনেক লাভবান হয়েছি। এর আগে পুকুর কেটেছিলাম টাকার জন্য আর এখন এলাকার উন্নয়নের জন্য পুকুর কাঁটছি। আশ্রয়ণ প্রকল্পের সামনে পুকুর কাঁটলে কোন ক্ষতি হবে না। কারণ এই প্রকল্পে তিন শো গাড়ি মাটি দিব।

রাজশাহী জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুম আল রশীদ সাংবাদিকদের জানান, যথাযথ আইনি পদক্ষেপের অভাবে প্রতিবছর দারুশা এলাকার বড়বিলসহ আশেপাশের বিলে অসংখ্য অবৈধ পুকুর খনন হচ্ছে। ফলে কৃষি জমি, বড়বিলের জীব বৈচিত্র্য ও রাস্তাঘাট নষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যে মিনারুল ও তার ঘনিষ্ঠরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে সর্বাধিক পুকুর খনন করে থাকে এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ মানুষকে জিম্মি করে জমি নিয়ে পুকুর খননের অনেক অভিযোগ রয়েছে।

তারা টাকার বিনিময়ে প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মচারী ও নেতাকে ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন যাবৎ অবৈধভাবে পুকুর খনন করছে। গত কিছু দিন প্রশাসন বেশ কয়েক বার পুকুর খনন বন্ধ করলেও পরবর্তীতে সে গোপনে পুকুর খনন করে ফেলছে। এলাকার স্বার্থে প্রশাসনের কাছে তার পুকুর খনন বন্ধে আবেদন করায় আমাকেসহ অন্য আবেদনকারীদেরও বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে। আমি তার এই ঐদ্ধত ও বেপরোওয়া অবৈধ কর্মকান্ড বন্ধে কার্যকর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

সরেজমিনে ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অভিযোগ ও মিনারুলের ভয় ভীতি প্রদর্শনে তথ্য। স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি লুৎফর রহমানের ছেলে সুমন পারভেজ জানান, মিনারুল ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে জমির মালিকদের কাছে থেকে জমি নিয়ে পুকুর খনন করে। জোর পূর্বক পুকুর খননের জমি দিতে রাজি না হলে সে চাকু ও হাসুয়ার ভয় দেখাই।

এছাড়াও সেই খননকৃত পুকুরের পার্শ্ববর্তী জমির মালিকদের জিম্মি করে পুকুর খনন করে থাকে। এই কাজটি আমার বাপ-চাচার সাথে করার চেষ্টা করছে। আমরা জমি দিতে রাজি না হওয়ায়, আমাদের জমির চারপাশে পুকুর খনন করে জিম্মি করার চেষ্টা করছে মিনারুল। কর্ণহার থানা পুলিশ ও চেয়ারম্যানকে বিষয়টি জানালেও তারা কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। মিনারুল অবৈধভাবে পুকুর খনন করে কৃষি জমি, পরিবেশ ও সরকারি রাস্তাঘাট নষ্ট করছে বলে জানান তিনি।

মিনারুলকে পুকুর খননে সহযোগিতার কথা স্বীকার করেছেন হুজরীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা। তিনি সাংবাদিকদের জানান, মূলত: রাস্তা সংস্কারের জন্যই এবারে মিনারুলের কাছে থেকে বিনামূল্যে মাটি নেওয়া হচ্ছে।

এছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান কবরস্থান ও ঈহগাহ মাঠ সংস্কার করা হচ্ছে। এতে যদি দশ ভাগ ক্ষতি হয়ে থাকে তবে ৯০ ভাগই জনগণের উপকারে করা হচ্ছে বলে জানান।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে