ঈদে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা তাঁতপল্লীর

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৪, ২০২২; সময়: ৩:৪৬ অপরাহ্ণ |
ঈদে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা তাঁতপল্লীর

রাজিউর রহমান রুমী, পাবনা : পাবনার তাঁতশিল্প ঈদকে সামনে রেখে নিজের অস্তিত্ব জানান দেবার চেষ্টা করছে। করোনা বিপর্যয়ের পর হারিয়ে যাওয়া কর্ম চাঞ্চল্য আবারও তাাঁতপল্লীকে উজ্জিবিত করেছে। ঈদের বাজার ধরতে জেলার তাঁতপল্লীগুলো নুতন উদ্যোমে এখন দিনরাত কাপড় তৈরিতে ব্যস্ত। গত ২ বছর করোনার বিধিনিষেধের কারণে তাঁতমালিকদের ব্যবসা না থাকলেও এবার বাজার চাঙ্গা বলে শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।

দেশের এবং ভারতের ব্যবসায়ীরা ঈদ, পূজাসহ বিভিন্ন উৎসব সামনে রেখে পাবনা জেলার বিভিন্ন পাইকারি হাটে এসে শাড়ি-লুঙ্গি কিনে নিচ্ছেন। অনেকের বন্ধ তাঁত কারখানা আবার চালু করেছেন।পাবনা জেলা তাঁত বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জেলায় হ্যান্ডলুম (খটখটি), পাওয়ারলুম (চিত্তরঞ্জন) ও আধুনিক প্রযুক্তির ৬৪ হাজার তাঁত রয়েছে। এই শিল্পের সঙ্গে প্রায় দুই লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত।

তাঁতপ্রধান উপজেলা পাবনার ঈশ্বরদী, সুজানগর,আটঘরিয়া, বেড়া, সাঁথিয়ায় ঘুরে দেখা গেছে,কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের কোলাহলে সরব হয়ে উঠেছে তাঁত পল্লী। পুরুষের সাথে হাত মিলিয়ে নারীরাও নলীভরা, সুতাপারি করা, মাড়দেয়া ও রঙ-তুলিতে নকশা আঁকাসহ কাপড় বুনুনিতে সহযোগিতা করছেন ।

এ অঞ্চলের তাঁত পল¬¬ীতে উন্নতমানের জামদানী, সুতী কাতান, চোষা, সুতী জামদানী, বেনারশী ও শেট শাড়ির পাশাপাশি মোটা শাড়ি, লুঙ্গী, থ্রী-পিচ ও থান কাপড় তৈরি হচ্ছে। মান ভেদে প্রতি পিস লুঙ্গি ২৮০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।

আটঘরিয়ার তাঁতি একরাম হোসেন বলেন, ‘করোনার দুই বছর আমাদের কারখানার উৎপাদিত লুঙ্গির চাহিদা কমে গিয়েছিল। কারখানার ২২ টি তাঁতের মধ্যে ১৪টিই বন্ধ ছিলো। এখন করোনার সংকট কেটে যাওয়ায় তাঁতগুলো পুড়োনো আমলের উৎপাদন কৌশল পরিবর্তন করে আধুনিকায়নের মাধ্যমে উৎপাদন শুরু করেছি। গ্রাফিকস ডিজাইনের মাধ্যমে প্রতিদিন নতুন নতুন নকশার শাড়ি-লুঙ্গি নিয়ে বাজারে হাজির হচ্ছি। এতে করে ভালো দামে শাড়ি-লুঙ্গি বিক্রি করতে পেরে আশার আলো দেখছি।’

সদর উপজেলার নতুনপাড়া গ্রামের তাঁতি মতিন মিয়া বলেন, ‘এখানে বছর দুই আগেও হাজার তিনেক তাঁত চালু ছিল। এখনও অর্ধেকের বেশি তাঁত বন্ধ। আমিও দীর্ঘদিন তাঁত বন্ধ রাখছিলাম। ঈদ উপলক্ষে টাকা ঋণ নিয়ে দশটা তাঁত চালু করেছি। এখন যে লুঙ্গিগুলো তৈরি হচ্ছে, সেগুলোর চাহিদা থাকায় তিনি বেজায় খুশি।’

আতাইকুলায় সপ্তাহে রবি-বুধবার দুইদিন(দিনরাত মিলে) কাপড়ের হাট বসে। হাটে পশ্চিমবাংলা থেকে আসা কয়েক কাপড় ব্যবসায়ীর সাথে কথা হয়। তারা জানান, এখানকার জামদানী নকশা, সেড ও থান কাপড় পশ্চিমবঙ্গে তরুণ তরুণীদের মধ্যে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। এ থানকাপড় দিয়ে তারা পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ তৈরি করছে।

পাইকারী কাপড় ব্যবসায়ী মসলে উদ্দিন জানান, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা আতাইকুলা হাট থেকে এবার প্রতি সপ্তাহে ৬ থেকে ৭ কোটি টাকার কাপড় কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এতে এ অঞ্চলের তাঁত শিল্প প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। দামও গত বছরের তুলনায় অনেক ভালো। ভারতের কলকাতার কাপড় ব্যবসায়ী গোপাল চন্দ্র সেন জানান, পাবনা অঞ্চলের তৈরি কাপড় ভারতের কলকাতা শুভরাজ, গঙ্গা রামপুর ও পাটনাসহ বড় বড় শহরে বিক্রি হচ্ছে । তিনি জানান, ভারতের রফতানিকারকদের কাছে বাংলাদেশের লুঙ্গীর চাহিদা রয়েছে সব চেয়ে বেশী। তারা বাংলাদেশী লুঙ্গী কিনে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রফতানি করছেন।

ব্যবসায়ী সুমেন্দ্র তরফদার বরলেন, বিবিআনা, রঙ, কে-ক্রাফট ও নগরদোলা সহ দেশের শীর্ষ স্থানীয় বুটিক প্রতিষ্ঠানের কাপড় এখন পাবনা অঞ্চলে তৈরি হচ্ছে। বুটিক হাউজগুলোর নিজস্ব ডিজাইনে রেশম সুতা, খাদি, নয়েল, ডুপিয়ান ও এন্ডি সুতা ব্যবহার করে তাতে প্যালেস ও জরি মিশ্রত করে কাপড় তৈরি করা হচ্ছে। বুটিক হাউজের ওড়না থান কাপড় ও এন্ডি থান কাপড়ের ফ্রেবিক্স তৈরি করা হচ্ছে তাঁত পল্লীগুলোতে।

পাইকারি বিক্রেতা আব্দুস সামাদ জানান, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, ঢাকা, চিটাগাংসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আতাইকুলা হাটে পাইকাররা আসছে। প্রতিদিনই অর্ডার আসছে। করোনার দুই বছর মন্দার পর ঈদকে সামনে রেখে কাপড়ের বাজার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। তাঁতীদের পিছে পিছে ঘুরে চাহিদা অনুযায়ী কাপড় মিলছে না। ব্যবসায়ীরা অগ্রিম টাকা দিয়ে তাঁতীদের বাড়ি থেকে কাপড় কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। অনেক তাঁতিই তার কারখানার কাপড় আগাম বিক্রি করে দিয়েছেন। আব্দুস সামাদ আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন,এ বছর রেকর্ড পরিমাণ তাঁতপণ্য বিক্রি হবে। মনিরামপুর গ্রামের তাঁতী শফিকুজ্জামান শফি বলেন, বাজারে কাপড়ের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে তারা কাপড়ের উৎপাদন বাড়াতে পারছেন না।

তাঁত শ্রমিক আব্দুস ছালাম, আফজাল হোসেন, লোকমান, সালেক, রতন সাহা, রায়হান, গাজীউর রহমান, আব্দুস সালাম, রাঙ্গা, তোরাব আলী ও আব্দুর রহিম জানান, করোনার দুই বছর কারখানা বন্ধ ছিল। খেয়ে না খেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে দিন কাটিয়েছি। আবার কারখানা চালু হয়েছে, দিন-রাত পরিশ্রম করছি। কাজ করে সপ্তাহে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরী মিলছে। এবার অন্তত পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালভাবে ঈদ করা যাবে।

পাবনা জেলা তাঁতি সমবায় সমিতির সভাপতি কামরুল আনান রিপন জানান, ‘ঐতিহ্যবাহী পাবনার তাঁতশিল্পের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকার বাংলাদেশ তাঁত বোর্র্ডের মাধ্যমে তাঁতিদের স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করলে বন্ধ হওয়া তাঁতগুলো আবার সচল হবে।’

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে