আদালতের ভুয়া রায় তৈরী করে জমি দখলের চেষ্টা

প্রকাশিত: মে ২৯, ২০২২; সময়: ২:১১ অপরাহ্ণ |
আদালতের ভুয়া রায় তৈরী করে জমি দখলের চেষ্টা

রাজিউর রহমান রুমী, পাবনা : পাবনার সাঁথিয়ায় বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক ও তার ভাই এর বিরুদ্ধে আদালতের ভুয়া রায় বানিয়ে জমি খারিজ করে দখলের অপচেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ তদন্ত করে ঘটনার প্রমাণও পেয়েছেন সাঁথিয়া উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ্ম পরিচালকের নাম মনসুর আলম ও তার ভাইয়ের নাম মাহমুদ এ হাসান। তারা প্রতারণা করে সাড়ে আঠারো বিঘা জমি নিজেদের দখলে নেয়ার চেষ্টা করে। তাদের বাড়ি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার গোপালপুর গ্রামে। জালিয়াতির ঘটনা প্রমাণিত হলেও তিনি চাকুরীতে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

জালিয়াতির ঘটনায় অভিযুক্ত মনসুর আলমের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী এলাকাবাসী। জালিয়াতি প্রমাণিত হওয়ার পরেও, সব অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন মনসুর আলম। মামলার আইনজীবি বলছেন, যেহেতু আদালতের রায় জালিয়াতি করার ঘটনা প্রমাণিত হয়েছে, সেক্ষেত্রে তার সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত।

অভিযোগ, তদন্ত প্রতিবেদন, এলাকাবাসী ও পারিবারিক সুত্রে জানা যায়, পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা মৃত রিয়াজ উদ্দিন শেখের ছেলে মনসুর আলম বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক হিসেবে কর্মরত।

১৯৯৭ সালে তিনি চাকুরীতে যোগদান করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ও তার ভাই আদালতের রায় জালিয়াতি করে গ্রামের অন্তত দশ ব্যক্তির সাড়ে ১৮ বিঘা জমি দখলের অপচেষ্টা করেছেন।

মামলা সুত্রে জানা যায়, ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর পাবনা যুগ্ম জজ-২য় আদালতে গোপালপুর গ্রামের কয়েকজন সহ সরকারি বেশকিছু জমিতে নিজের স্বত্ত দাবি করে মামলা করেন মনসুর আলমের পিতা রিয়াজ উদ্দিন শেখ।

২০১৬ সালের শেষদিকে মারা যান রিয়াজ উদ্দিন। তদবিরের অভাবে ২০১৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মামলাটি খারিজ করে দেন আদালত। অথচ একই মামলার বিষয়ে ২০০৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মনসুর আলমদের পক্ষে আদালত ডিগ্রি দিয়েছেন উল্লেখ করে মিথ্যার আশ্রয় নেন এই ভূমিদস্যুরা।

তারা একটি ভুয়া রায় তৈরী করেন। সেই ভূয়া ২০২১ সালের ২০ জুন সাঁথিয়া উপজেলা ভূমি অফিসে দাখিল করে জমি খারিজের আবেদন করেন মনসুর আলম গং। সেখানে বিবাদীদের অনেকের নাম মামলায় ছিল না, তাদের নামও ওই ভুয়া রায়ে বিবাদী হিসেবে উল্লেখ করেন। আদালতের ভুয়া রায় যাচাই বাছাই না করেই ২০২১ সালের ৩১ মে মনসুর আলম ও মাহমুদ এ হাসান গংদের পক্ষে জমি খারিজের নির্দেশ দেন তৎকালীন অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত এসি ল্যান্ড ও সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম জামাল আহমেদ।

এমন পরিস্থিতিতে জালিয়াতির ঘটনা জানতে পেরে জমির মালিকরা ভূমি কর্মকর্তার কাছে মনসুর আলমের খারিজ বাতিলের আবেদন করেন। আবেদন পেয়ে সাঁথিয়া উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মনিরুজ্জামান চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি পাবনা আদালতের সরকারি কৌশুলীর কাছে রায়ের বিষয়ে মতামত চেয়ে চিঠি দেন।

১৪ মার্চ সরকারি কৌশুলী চিঠির জবাবে জানান ২০০৮ সালে এমন কোনো মামলার রায় হয় নাই। বরং ওই মামলাটি ২০১৩ সালে তদ্বিরের অভাবে খারিজ হয়ে যায় মনসুর গংদের বিপক্ষে। আদালতের নথি যাচাই বাছাই ও তদন্তে মনুসর আলমদের দাখিল করা আদালতের রায়টি ভুয়া বলে নিশ্চিত হন এসি ল্যান্ড।

তিনি মূলত জমি দখল করতে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ৩০ মার্চ মনসুর গংদের খারিজ বাতিল করে প্রতিবেদন দেন ভূমি কর্মকর্তা। সম্প্রতি সরেজমিনে সাঁথিয়ার গোপালপুর গ্রামে গেলে মনসুর আলমের এমন জালিয়াতিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় এলাকাবাসী।

গ্রামের মৃত আছাব আলীর স্ত্রী তহুরা বেগম বলেন, মনসুররা ছোট থাকতে আমার স্বামী তাদের বসবাস করার জন্য জমি দিয়েছিল। কিন্তু এখন সে আমাদের জমি জালিয়াতি করে নিতে চাচ্ছে। আমি এর বিচার চাই। তহুরা বেগমের দুই ছেলে শাহাদৎ হোসেন ও সাখাওয়াত হোসেন বলেন, শুধু আমাদের জমি না, এই গ্রামের অন্তত দশ থেকে এগারোজনের সবমিলিয়ে সাড়ে ১৮ বিঘা জমি দখল করতে অপচেষ্টা করছেন মনসুর ও তার ভাই মাহমুদ এ হাসান। আদালতের ভুয়া রায় তৈরী করেও ধরা পড়েছেন। সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছেন।

একই গ্রামের আজিজ ফকিরের ৩৪ শতক, নজরুল ইসলামের ৬৩ শতক, আজাহারুল ইসলামের ১৬ শতক, আব্দুল কাদেরের ১২ শত জমি নেয়ার অপচেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।

তারা বলেন, তিনি সরকারি চাকুরী করে এলাকার সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছেন। রায় জালিয়াতি করে আদালতের সাথেও প্রতারনা করে আদালত অবমাননা করেছেন। তার দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি করেন ভুক্তভোগীরা।

এদিকে, ঘটনা তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুদক ঢাকার প্রধান কার্যালয়ের চেয়ারম্যান ও পাবনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে মনসুর আলমের বাড়িতে গিয়ে তাকে ও তার ভাই মাহমুদ এ হাসানকে পাওয়া যায়নি। তার মা ফাতেমা বেগম বলেন, তার শ্বশুড় এ বাড়িতে তাদের রেখে গেছেন। তারপরও ছেলে ভুল করে থাকতে পারে। মানুষেরই তো ভুল হয়। ভুল হলে মাফ করা লাগবে।

মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক মনসুর আলমের সাথে। তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে আদালতের রায় জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে তারপরও কেন অস্বীকার করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব মিথ্যা কথা, আমি কোনো ভুয়া রায় তৈরী করিনি।

কে করেছে তাও জানি না। এখানে একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে। তিনি ক্ষমতাসীন দলের জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন নেতাদের নাম উল্লেখ করে বলেন, তাদের সাথে তার সুসম্পর্ক রয়েছে। সবাই তাকে চেনেন। এক পর্যায়ে সংবাদ প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন।

মামলার আইনজীবি অ্যাডভোকেট সাজাদ ইকবাল লিটন বলেন, মনসুর আলম ও মাহমুদ এ হাসান গং একটি চক্র। তারা জালিয়াতি করে এলাকার নিরীহ মানুষদের হয়রানী করেছেন। ইতিমধ্যে আদালত থেকে প্রমাণিত হয়েছে পুরো ঘটনা। আদালতের রায় জালিয়াতি সবচেয়ে মারাত্বক অপরাধ।

তিনি আরো বলেন, জালিয়াতির ঘটনা ধরা পরার পর মনসুর আলম ও তার ভাই মাহমুদ এ হাসানের বিরুদ্ধে পাবনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী আদাল-৫ এ একটি মামলা করেছেন সাখাওয়াত হোসেন নামের একজন ভুক্তভোগী। এ মামলায় তার সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদন্ড হবে বলে মনে করেন এই আইনজীবি।

সাঁথিয়া উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, মনুসর আলী গংদের খারিজ বাতিলের আবেদন পাওয়ার পর আমরা তদন্ত করতে গিয়ে দেখতে পাই তার মধ্যে সরকারি বেশকিছু জমিও রয়েছে। আদালতে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় মনসুর পক্ষ ২০০৮ সালের একটি ভুয়া রায় দাখিল করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন।

আদালতের রায় জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ার পর তার খারিজ বাতিল করা হয়েছে। চূড়ান্ত শুনানীর দিন মনসুর পক্ষ উপস্থিত ছিলেন না। তহুরা বেগম পক্ষের দাবি সঠিক প্রমাণিত হয়। পরে মনসুর, মাহমুদ গংদের বিরুদ্ধে তহুরা বেগমের পক্ষে তার ছেলে সাখাওয়াত হোসেন একটি প্রতারণার মামলা করেছেন। সে কারণে সরকার পক্ষে মামলা করা হয়নি।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে