পাকা বাড়ির মালিক পেয়েছেন গৃহহীনের ঘর

প্রকাশিত: মে ২৯, ২০২২; সময়: ২:২৪ অপরাহ্ণ |
পাকা বাড়ির মালিক পেয়েছেন গৃহহীনের ঘর

নিজস্ব প্রতিবেদক, বদলগাছী : তাঁর আছে ছাদের পাকা বাড়ি, সেই বাড়ির গোয়ালঘরে তিনি দেশী-বিদেশী জাতের পাঁচটি গরু লালন-পালন করছেন। তাঁর আরও আছে হালচাষের জন্য পাওয়ার টিলার মেশিন। তিনি ১০-১২ বিঘা জমি চাষবাদ করেন। অথচ তিনি ভূমিহীন ও গৃহহীন। তিনি মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় দুর্যোগ সহনীয় গৃহ বরাদ্দ পেয়েছেন। সেই গৃহটিও নির্মিত হচ্ছে তাঁরই ছাদের পাকার বাড়ির পাশেই। আর সেই ছাদের বাড়ি পশে বাড়ি নির্মাণ করে দিচ্ছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার।

গৃহহীন সেজে সরকারি গৃহ বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তি হলেন, বেলাল হোসেন বাবু (৪৫)। তিনি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার আধাইপুর ইউনিয়নের সাদিশপুর গ্রামের বাসিন্দা তিনি। সাদিশপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে তাঁর নামে গৃহ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তিনি সাদিশপুর আশ্রয়ণ প্রকল্প সমিতির সভাপতির পদেও আছেন। তিনি শুধু নিজের নামে একা আশ্রয়ণ প্রকল্পের দুর্যোগ সহনীয় গৃহ বরাদ্দ পাননি। তাঁর অবিবাহিত বড় ছেলের ও তাঁর আরেক স্ত্রীর নামেও আরও দুইটি সরকারি গৃহ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে গৃহ বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের সর্ম্পকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, পরিবারের বাবা-ছেলে- জামাই- মেয়ে- নাতি সবাই গৃহ বরাদ্দ পেয়েছেন। চার জন অবিবাহিত ছেলের নামেও গৃহ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের গৃহে বাসবাসকারীদের সবার সমস্যা একটাই। সেই সমস্যাটি হচ্ছে, ঝড়-বৃষ্টি হলে তাঁদের সবার গৃহে বৃষ্টির পানি পড়ে। তখন তাঁদের গৃহের আসবাবপত্র পলেথিন কাগজে ঢেকে রাখতে হয়। ঝড়-বৃষ্টির রাতে সবাইকে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। আশ্রয়ণ প্রকল্পের গৃহগুলোর ছাউনিতে নিম্নমানের টিন ও কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এখনো ১২ টি গৃহ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। সেই গৃহগুলোও সুবিধাভোগীদের কাছে আগেই হস্তান্তর করে জমির কাগজ পত্র বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। একারণে গৃহ বরাদ্দ পেয়েও তাঁরা কেউই গৃহে উঠতে পারেননি। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গৃহ নির্মাণ ও গৃহ বরাদ্ধে কোনো অনিয়ম হয়নি। তাঁরা সবকিছুই নিয়ম মেনেই করেছেন।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই উপজেলায় ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভুমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের জন্য ৩য় পর্যায়ে ৪৬ টি গৃহ নির্মাণে টিআর ও কাবিটা প্রকল্পের আওতায় মোট ১ কোটি ২১ লাখ ৬৭ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এই ৪৬ টি গৃহের মধ্য আধাইপুর ইউনিয়নের সাদিশপুর মৌজায় সাদিশপুরে ৪০ টি, একই ইউনিয়নের জগন্নাথপুরে তিনটি ও বালুভরায় তিনটি ঘর। প্রতিটি গৃহ নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৪ হাজার ৫০০ টাকা ।

সুবিধাভোগীরা জানান, সাদিশপুর মৌজায় ৪০ টি গৃহ নির্মাণের বরাদ্দ দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে ২৮ টি গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে। আরও ১২ টি গৃহ নিমাণের কাজ চলছে। গত এপ্রিল মাসে তাঁদের সবাইকে গৃহে মালিকানার দলিল হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন ২৮ টি গৃহে লোকজন বসবাস করছেন। সুবিধাভোগী মিনা বেগম ও তাঁর স্বামী আজিজ বলেন, ঝড়-বৃষ্টিতে আমাদের সবার গৃহ বৃষ্টির পানি পড়ে। একারণে আমরা সবাই পলিথিন কাগজ কিনে রেখেছি। ঝড়-বৃষ্টির সময় পলিথিন কাগজে আসবাবপত্র ঢেকে রাখি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছ, সাদিশপুর নির্মিত দুর্যোগ সহনীয় গৃহগুলোর বেশিভাগই আপনজনদের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্য ছাদের পাকা বাড়ির মালিকও রয়েছেন। বৃদ্ধ আব্দুল জব্বারে নিজের নামে একটি তাঁর তিন ছেলে আসিদুল, পেন্টু ও রফিকুল, জামাই রেজাউল, নাতি জামাই নাজমুল ও তার অবিবাহিত নাতি আসিদুলের ছেলের নামেও ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। মোট ৭টি ঘর বরাদ্ধ দিয়েছেন তাঁকে।

মৃত আলিমুদ্দিনের দুই ছেলে লিটন ও মিঠুন ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। আবার তাঁদের দুই ছেলে রুহুল আমিন ও মুরশিদের নামেও গৃহ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মিঠুনের ছেলে রুহুল আমিন অবিবাহিত।

বৃদ্ধ জিল্লুর রহমান নিজে তাঁর ছেলে বাবু, ছেলের বউ, মেয়ে জামাই , নাতি পলাশ, নাতনি রেবেকা পারভিন ও তাঁর ছেলের দ্বিতীয় স্ত্রীর নামেও ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। বাবু সাদিশপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের সভাপতি। তিনি অনেক আগেই ছাদের পাকা বাড়িতে বসবাস করছেন। তাঁর বাড়ির গোয়ালঘরে তাঁর পাঁচটি দেশী-বিদেশী জাতে গরু রয়েছে। এই পাঁচটি গরুর দাম ছয় থেকে ৭ লাখ টাকা হবে। একটি পাওয়ার টিলার মেশিনও রয়েছে। তিনি নিজেও ১০-১২ বিঘা জমি আবাদ করেন। সেখাকার মধ্য বাবু সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তাঁর ছাদের পাকা বাড়ি সংলগ্ন আশ্রয়ণ প্রকল্পের সরকারি টাকায় গৃহ নির্মাণ করা হচ্ছে।

বাবুর বাড়ির পাশে শহিদুলেরও রয়েছে একটি পাকা বাড়ি। তাঁকেও দেওয়া হয়েছে সরকারি ঘর।
মঙ্গলবার দুপুরে যখন বাবুর বাড়িতে যাওয়া হয়েছিল তখন বাবু তাঁর বাড়ির সামনে আশ্রয়ণ প্রকল্পের সরকারিভাবে বরাদ্দ পাওয়া টিওবয়েল বসানোর কাজের তদারকি করছিলেন । বাবুর স্ত্রী পলি আরা তখন ছাদের পাকা বাড়িতে সাংসারিক কাজ করছিলেন।

পলি আরা বলেন, আমার স্বামী বাবু অনেক কষ্ট করে অনেক আগে ছাদের পাকা বাড়িটি নির্মাণ করেছেন। তাঁরা আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে দুটি ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। এরমধ্য একটি বড় ছেলে পলাশের নামে। পলাশ গৃহটিতে থাকছে। স্বামী -স্ত্রীর নামে বরাদ্দ দেওয়া গৃহটি তাঁদের ছাদের পাকা বাড়ি সংলগ্ন জায়গায় নির্মাণকাজ চলছে। ঘোয়াল ঘরের ৫টি গরুই আমাদের। তাঁদের দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে পলাশ ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছে। ছোট ছেলে পিয়াস অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে বলে তিনি জানান।

সাদিশপুর আশ্রয়ন প্রকল্প সমিতির সভাপতি বেলাল হোসেন বাবু বলেন, সাদিশপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৪০ টি ঘর বরাদ্দ রয়েছে। এরমধ্যে ২৮ গৃহ নির্মাণকাজ শেষে সুবিধাভোগীরা বসবাস করছেন। ১২ টি ঘর নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। তবে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৪০ টি গৃহই সুবিধাভোগীদের হস্তান্তর করা হয়েছে। আপনারতো ছাদের পাকা বাড়ি রয়েছে তারপরও কিভাবে নিজের ও অবিবাহিত ছেলে ও আপনার আরেক স্ত্রীর নামে সরকারি গৃহ বরাদ্দ পেলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার দিয়েছে তাই পেয়েছি। এতে আপনাদের সমস্যা হচ্ছে কেন?।

একই গ্রামে ঘর না থাকায় উঠানে চৌকি ফেলে বসবাস করছেন হাফিজুল ইসলাম ও তাঁর পরিবার লোকজনেরা। তিনি আশ্রয়ণ প্রকল্পের গৃহ বরাদ্দ চেয়ে পাননি বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বাবুর ছাদের পাকা বাড়ি, রয়েছে গরুর খামার, পাওয়ার টিলার মেশিনও আছে। ১০-১২ বিঘা জমিও চাষাবাদ করেন। অথচ ভূমিহীন-গৃহহীন হিসেবে বাবু নিজে, তাঁর ছেলে ও তাঁর আরেক স্ত্রীর নামে আশ্রয়ণ প্রকল্পে তিনটি গৃহ বরাদ্দ পেয়েছেন। আমার মতো সত্যিকারের ভুমিহীন ও গৃহহীন ব্যক্তিরা গৃহ বরাদ্দ পাননি।

ঘর না পাওয়া শাহিন হোসেন সহ আরো কয়েকজন ব্যক্তি বলেন, আমাদের জরাজীর্ণ বাড়ি। আমরা ঘরের অভাবে ঘুমাতে পারি না। অথচ একই পরিবারের সবাই আশ্রয়ন প্রকল্পের গৃহ পেয়েছেন। আমরা প্রকৃত ভূমিহীন ও গৃহহীনেরা সরকারি গৃহ বরাদ্দ পাইনি।

বদলগাছী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মোঃ ময়নুল ইসলাম বলেন, আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। মুজিববর্ষ উপলক্ষে বদলগাছী উপজেলায় মোট ৪৬ টি গৃহ নির্মাণ করা হচ্ছে। এরমধ্য সাদিশপুর মৌজায় ৪০ টি গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে। গৃহ বরাদ্দ কারা পেয়েছেন সেটি ইউএনও স্যার ভালো বলতে পারবেন।

বদলগাছী উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলপনা ইয়াসমিন বলেন, সাদিশপুরে ৪০ টি গৃহ সুবিধাভোগীদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ও তাঁদেরকে জমির কাগজ পত্র বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে কয়েকটি গৃহের নির্মাণ কাজ চলছে। সভাপতি বাবু দুই স্ত্রী। তাঁরা আলাদা থাকেন। তাঁর বড় ছেলে বিবাহযোগ্য। একারণে বাবুর পরিবারে গৃহ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গৃহ বরাদ্দে কোনো অনিয়ম হয়নি বলে তিনি দাবি করেছেন।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে