ইসলামের সোনালি যুগে মুসলিম নারীদের পেশা

প্রকাশিত: জুন ২, ২০২২; সময়: ১:৫১ অপরাহ্ণ |
খবর > ধর্ম
ইসলামের সোনালি যুগে মুসলিম নারীদের পেশা

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : ইসলামী সমাজে নারীর অবস্থান ও মর্যাদা অনেক সুন্দর এবং নিরাপত্তার চাদরে আবৃত। কথিত অধুনা সমাজের অনেকেই তাদের সেই সুখময় অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার হীন চেষ্টা করে থাকে।

কিন্তু ইসলামের সোনালি যুগের ইতিহাসে নারীর ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান বিশ্লেষণ করলে তাদের এই দাবির সত্যতা মেলে না।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ থেকে সহস্র বছরের ইসলামী খিলাফতের যুগে নারী জ্ঞানচর্চা থেকে শুরু করে যে আর্থ-সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ভোগ করেছে, তা আধুনিক যুগেও অপ্রতুল।

এই সময় তারা বিভিন্ন পেশায় পুরুষের মতো যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দেয়। তবে হ্যাঁ, পর্দা-শালীনতা ও ইসলামের ধর্মীয় ও সামাজিক বিধান-রীতি মান্য করেই তারা তা করেছে।

জ্ঞানচর্চায় নারীর অবস্থান

হজরত মুহাম্মদ (সা.) নানাভাবে নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করেন। তিনি মদিনার আনসারি নারীদের প্রশংসা করে বলেন, ‘আনসারি নারীরা কতই না উত্তম! লজ্জা কখনোই তাদের ধর্মের বিষয়ে জ্ঞানান্বেষণে বিরত রাখতে পারে না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৭৭২)

মুসলিম নারীদের আবেদনের প্রেক্ষাপটে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের দ্বীন শেখানোর জন্য পৃথক দিন নির্ধারণ করেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নারীরা একবার নবী (সা.)-কে বললেন, ‘পুরুষরা আপনার কাছে আমাদের চেয়ে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে।

তাই আপনি আমাদের জন্য একটি দিন নির্ধারণ করে দিন। তিনি তাদের বিশেষ একটি দিনের অঙ্গীকার করেন; সেদিন তিনি তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং তাদের নসিহত করলেন ও নির্দেশ দিলেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১০১)

রাসুল (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদার যুগে নারীরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশেষ অবদান রাখেন। তাদের মধ্যে অন্তত ২২ জন নারী সাহাবি মুহাদ্দিস, ফকিহ (আইনজ্ঞ) ও মুফতি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।

সমাজসেবায় নারীর ভূমিকা

ইসলামের সোনালি যুগে নারীরা বিভিন্ন ধরনের সমাজসেবামূলক কাজেও অংশগ্রহণ করতেন। তারা অসংখ্য শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। খলিফা হারুনুর রশিদের স্ত্রী জোবায়দা দীর্ঘ খাল খনন করে হাজিদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেন।

সেলজুক শাসক সুলতান মালিক শাহর স্ত্রী তুরকান বিনতে তুরাজ বাগদাদে তিনটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং তা পরিচালনার জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পদ ওয়াক্ফ করেন। (তারিখু দাওলাতুল আব্বাসিয়া, পৃষ্ঠা ৯৭)

এছাড়া একাদশ শতাব্দীতে মামলুক শাসনামলে মুসলিম নারীরা দামেস্কে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১২টি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন, যা নারীদের দ্বারাই পরিচালিত হতো।

ব্যবসা-বাণিজ্যে নারী

হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগে নারীরা ব্যবসা-বাণিজ্যও করত। কায়লা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কোনো ওমরা আদায়কালে মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে আমি তার কাছে উপস্থিত হয়ে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি একজন নারী (ব্যবসায়ী)। আমি বেচাকেনা করি।

আমি কোনো জিনিস কিনতে চাইলে আমার ঈপ্সিত মূল্যের চেয়ে কম দাম বলি। এরপর দাম বাড়িয়ে বলতে বলতে আমার কাঙ্ক্ষিত মূল্যে গিয়ে পৌঁছি। আবার আমি কোনো জিনিস বিক্রয় করতে চাইলে কাঙ্ক্ষিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্য চাই। এরপর দাম কমাতে কমাতে অবশেষে আমার কাঙ্ক্ষিত মূল্যে নেমে আসি।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, হে কায়লা! এরূপ করো না। তুমি কিছু কিনতে চাইলে তোমার কাঙ্ক্ষিত মূল্যই বলো; হয় তোমাকে দেওয়া হবে, নয় দেওয়া হবে না। তিনি আরো বলেন, তুমি কোনো কিছু বিক্রয় করতে চাইলে তোমার কাঙ্ক্ষিত দামই চাও; হয় তুমি দেবে অথবা না দেবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২০৪)

নারী চিকিৎসক

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে নারীরা চিকিৎসক হিসেবেও দক্ষতা অর্জন করেন। যারা শৈল্যবিদ্যায়ও পারদর্শী ছিলেন। আয়েশা (রা.) নিজেও চিকিৎসাবিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করেন। উরওয়া (রহ.) বলেন, আমি চিকিৎসাবিজ্ঞানে আয়েশা (রা.) অপেক্ষা দক্ষ মানুষ দেখিনি।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, খালা! আপনি এই জ্ঞান কোথা থেকে অর্জন করলেন? তিনি বলেন, আমি মানুষকে রোগীর চিকিৎসা করতে দেখেছি এবং তা মনে রেখেছি। (সিয়ারু আলামুন নুবালা : ২/১৮২)

আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, উম্মে সুলাইম (রা.) ও তার সঙ্গের আনসার নারীদের নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তারা পানি পান করাতেন এবং আহতদের জখমে ওষুধ লাগিয়ে দিতেন। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৫৭৫)

মিসরে মুসলিম শাসক কর্তৃক প্রথম আবাসিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানে নারীরাও চিকিৎসক ও শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পান। তাদের কেউ কেউ ‘মাশিখাতুত-তিব’ (প্রধান অধ্যাপক) পদেও অধিষ্ঠিত হন।

বিখ্যাত চিকিৎসক শিহাবুদ্দিন আহমদের মেয়ে কায়রোর দারুশ-শিফা মানসুরিয়ার ‘মাশিখাতুত-তিব’ পদে দায়িত্ব পালন করেন। (আহমদ ঈসা বেগ, তারিখুল বিমারিস্তান ফিল ইসলাম)

হস্তশিল্প

হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগে নারীরা হস্তশিল্পের কাজ করেও অর্থ উপার্জন করতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বপ্রথম সে-ই আমার সঙ্গে মিলিত হবে যার হাত সর্বাধিক লম্বা’। সুতরাং তারা নিজ নিজ হাত মেপে দেখতে লাগলেন কার হাত বেশি লম্বা।

আয়েশা (রা.) বলেন, অবশেষে আমাদের মধ্যে জয়নবের হাতই সবচেয়ে লম্বা স্থির হলো। কেননা, তিনি হাত দিয়ে কাজ করতেন এবং দান-খয়রাত করতেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬০৯৪)

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর স্ত্রী রায়িতা (রা.) হস্তশিল্পে দক্ষ ছিলেন। তিনি বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে তা বিক্রি করতেন এবং উপার্জিত অর্থ দান করে দিতেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৬০৩০)

রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব

ইসলামের সোনালি যুগে নারীরা রাজনীতির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে না থাকলেও তারা বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং রাজনৈতিক সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আয়েশা (রা.) মুয়াবিয়া ও আলী (রা.)-এর মধ্যকার সংকট নিরসনে এগিয়ে আসেন।

তেমনি সাওদা বিনতে আম্মারা বিন আশতার হামদানি তার গোত্রের প্রতিনিধি হয়ে মুয়াবিয়া (রা.)-এর কাছে যান এবং দাবি ও প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন। মুয়াবিয়া (রা.) তাঁদের দাবি মেনে নেন এবং ইবনে আরতাকে বরখাস্ত করেন। (আকদুল ফারিদ, পৃষ্ঠা ৩৪৪-৪৬)

কৃষিকাজে নারী

মহানবী (সা.)-এর যুগে নারীরা কৃষিকাজেও অংশগ্রহণ করতেন। আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘যখন জোবায়ের আমাকে বিয়ে করেন, তখন তার কোনো ধন-সম্পদ ছিল না, এমনকি কোনো স্থাবর জমিজমা, দাস-দাসীও ছিল না; শুধু কুয়া থেকে পানি উত্তোলনকারী একটি উট ও একটি ঘোড়া ছিল।

আমি তার উট ও ঘোড়া চরাতাম, পানি পান করাতাম এবং পানি উত্তোলনকারী মশক ছিঁড়ে গেলে সেলাই করতাম, আটা পিষতাম, কিন্তু ভালো রুটি তৈরি করতে পারতাম না। রাসুল (সা.) জোবায়েরকে একখণ্ড জমি দিলেন। আমি সেখান থেকে মাথায় করে খেজুরের আঁটির বোঝা বহন করে আনতাম।

ওই জমির দূরত্ব ছিল প্রায় দুই মাইল। একদিন আমি মাথায় করে খেজুরের আঁটি বহন করে নিয়ে আসছিলাম। এমন সময় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো, তখন রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে কয়েকজন আনসারও ছিলেন।

নবী (সা.) আমাকে ডাকলেন এবং আমাকে তার উটের পিঠে বসার জন্য উটকে আখ্! আখ্! বললেন, যাতে উটটি বসে এবং আমি তার পিঠে আরোহণ করতে পারি। …’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫২২৪)

অন্যান্য পেশায় নারী

স্পেনের অধিবাসী আয়েশা বিনতে আহমদ বিন কাদিম ছিলেন ক্যালিগ্রাফিশিল্পী। লুবনি (রহ.) ছিলেন বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও আরবি ব্যাকরণশাস্ত্রে পারদর্শী। রাবিয়া কসিসাহ সুপ্রসিদ্ধ বক্তা ছিলেন। শিফা বিনতে আবদিল্লাহ ছিলেন প্রখ্যাত আইনজ্ঞ।

ওমর (রা.) তাকে ইসলামী আদালতের ‘কাজাউল হাসাবাহ’ (Accountability Court) ও ‘কাজাউস সুক’ (Market Administration) ইত্যাদির দায়িত্বভার অর্পণ করেন। (তাবকাতে ইবনে সাদ : ৮/৪৫-৪৮; দালায়িলুন নাবুওয়াহ : ৫/৪১৬; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৫/৭৮)

ইসলামের সোনালি যুগে নারীর প্রতি মুসলিম সমাজের মনোভাব স্পষ্ট করতে আল্লামা ইবনে কায়্যিম (রহ.)-এর বিখ্যাত উক্তিটি উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি বলেন, নারী সমাজের অর্ধেক। কিন্তু অবশিষ্ট অর্ধেকেরও জন্ম দেয় নারী। সুতরাং নারীরাই যেন পুরো সমাজ।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে