মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিতে রাবি ছাত্রলীগ বেপরোয়া

প্রকাশিত: আগস্ট ২৩, ২০২২; সময়: ৯:৪৮ অপরাহ্ণ |
মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিতে রাবি ছাত্রলীগ বেপরোয়া

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগের এক বছরের কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। এতে চরম বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। শোকাবহ আগস্ট মাসেই পাঁচটি অঘটনে জড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, চলতি বছরে শিক্ষার্থী নির্যাতন, চাঁদাবাজি, সিট বাণিজ্যসহ অন্তত ৪০টি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৬ আগস্ট রাবির শহিদ হবিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের সভাপতি মোমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ তলা নির্মাণাধীন বিজ্ঞান ভবনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে ৩০ হাজার টাকা দাবি করে শোকাবহ মাসের শুরুতেই আলোচনায় উঠে আসেন ছাত্রলীগের ওই নেতা। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ১১ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ হবিবুর রহমান হলসংলগ্ন এক দোকানের ক্যাশবাক্স থেকে নগদ ৫০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে শহিদ জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রাশেদ খানের বিরুদ্ধে।

ভুক্তভোগীর অভিযোগ, জিম্মি করে টাকা নেন ওই ছাত্রলীগ নেতা। এরপর ১৭ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ হবিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রেজোয়ান গাজী মহারাজকে ডেকে নিয়ে লাঠি ও রড দিয়ে মারধরের অভিযোগ ওঠে একই দলের অন্য নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। বেধড়ক মারধরের পর মহারাজের কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ ওঠে। পরে এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক মুশফিকুর রহমান প্রান্ত, মতিহার হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহফুজ আলম সাকিব, শাহমখদুম হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি শামীম শিকদার, সৈয়দ আমীর আলী হলের জুয়েল হোসেন ও শহিদ হবিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাজেদ মিয়ার বিরুদ্ধে প্রক্টর দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেন ভুক্তভোগী।

১৮ আগস্ট হলের সামনে থেকে প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা নেন জিয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রাশেদ মিয়া এবং সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রাকিব। শুধু তাই নয়, নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রতিদিন ওই হোটেল থেকে জোরপূর্বক খাবার খেয়ে কোনো বিল দেন না তারা। হোটেলের মালিক অভিযোগ করেন, এর বাইরেও হল কমিটি হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সময় হুমকি ও ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করেন ওই দুই নেতা। সর্বশেষ ১৯ আগস্ট শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার হলের আবাসিক ছাত্র সামসুল ইসলামকে হলে তিন ঘণ্টা আটকে রেখে বেধড়ক মারধর ও গলায় ছুরি ধরে ২০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহার বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীর অভিযোগ, ক্যাম্পাসে তিনি মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ করেন বলে চাঁদা চেয়েছিলেন ছাত্রলীগ নেতা ভাস্কর সাহা। কিন্তু চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে তিন ঘণ্টা নির্যাতন করা হয় তাকে। পরে গলায় ছুরি ধরে তার কাছে থাকা ২০ হাজার টাকা কেড়ে নেওয়া হয়। ভুক্তভোগীর অভিযোগ আমলে নিয়ে ঘটনা খতিয়ে দেখতে রাতেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে।

শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরাও শাখা ছাত্রলীগের চাঁদাবাজির হাত থেকে রেহাই পাননি। ময়মনসিংহ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের ব্যবহৃত বাসগুলো আটকিয়ে চাঁদা নেন রাবির বঙ্গবন্ধু ও জিয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আলফাত সায়েম জেমস ও রাকিবুল ইসলাম, আইবিএ ইনস্টিটিউটের ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক অমিত সাহা এবং তামিমসহ আরও দুজন ছাত্রলীগ কর্মী।

শাখা ছাত্রলীগের একাধিক সিনিয়র নেতারা জানান, ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর রাবি শাখা ছাত্রলীগের কমিটি হয়। সে সময় যারা কমিটিতে আসেন তাদের পড়ালেখা শেষের দিকে ছিল। এখন বর্তমান কমিটির অধিকাংশেরই ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে বছর তিন-চারেক আগে। বর্তমানে তারা চাঁদাবাজি ও সিটবাণিজ্য করার জন্যই ক্যাম্পাসে থাকছে। এগুলো করেই তারা নিজেদের খরচ জোগাড় করে। চাঁদাবাজিমুক্ত ক্যাম্পাস গড়তে হলে আগে নতুন কমিটি দিয়ে অছাত্রদের ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করতে হবে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু জানান, শাখা ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে আমরা তো ব্যবস্থা নিতে পারি না। কোনো অভিযোগের সত্যতা মিললে তার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে সুপারিশ করতে পারি। সম্প্রতি প্রক্সিকান্ডে জড়িত থাকা সত্যতা পাওয়ায় কেন্দ্রীয় কমিটি রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুশফিক তাহমিদ তন্ময়কে বহিষ্কার করেছে। অন্যদের বিরুদ্ধে সত্যতা মিললে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে সুপারিশ করব।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাবি ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক মেহেদী হাসান তাপস বলেন, রাবি ছাত্রলীগের বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ড পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি এবং পর্যপেক্ষণ করছি। বিশেষ করে চাঁদাবাজির ঘটনাগুলো কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অবগত করা হয়েছে। রাবিতে যেকোনো শিক্ষার্থী হয়রানি ও নির্যাতন প্রতিরোধে সোচ্চার থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ড. ফরিদ উদ্দিন খান। ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, বর্তমানে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সম্প্রতি আমার বিভাগের সামসুল ইসলাম নামের শিক্ষার্থীর ওপর যে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে এবং টাকা ছিনতাই করা হয়েছে তা সভ্য প্রতিষ্ঠানে কাম্য নয়।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর প্রফেসর ড. আসাবুল হক জানান, কোনো লিখিত অভিযোগ পেলেই সত্যতা যাচাই করতে আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করে থাকি। তদন্ত প্রতিবেদন সিন্ডিকেটে যাবে তার আগেই ভুক্তভোগী ও অভিযুক্তরা এসে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কিছু করার থাকে না। আমরাও চাই এসব ঘটনার দৃশ্যমান শাস্তি হলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কমে আসবে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে