বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ৬ মসজিদ

প্রকাশিত: ১৩-১০-২০২২, সময়: ১৪:০৫ |

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : মুসলিম সভ্যতার প্রধান নিদর্শন মসজিদ। এক সহস্রাব্দেরও বেশি সময় ধরে সারা বিশ্বের মুসলমানদের ইবাদতের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে পবিত্র স্থানগুলো। এর সৌন্দর্য এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস, স্থাপত্য ও সংস্কৃতি আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। মসজিদগুলো বিশ্বের অন্যান্য ধর্মীয় স্মৃতিস্তম্ভের মতো প্রায়শই একটি শহরের সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং ভূগোলের প্রতীক হিসেবে কাজ করে। এখানে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর ৬টি মসজিদ নিয়ে আলোচনা করা হলো।

১) মক্কার মসজিদ আল-হারাম
মসজিদ আল হারাম বলতে পবিত্র কাবা শরীফের চারদিকে ঘিরে যে মসজিদ নির্মিত। মসজিদে হারামের ভেতর ও বাইরের নামাজের স্থানসহ এর আয়তন হলো ৪ লাখ ৮০০ বর্গমিটার। ৯টি সুন্দর ও সুউচ্চ মিনার মসজিদ আল-হারামকে অনন্য দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। এই মসজিদের ৮১টি দরজা রয়েছে। যার প্রত্যেকটি সবসময় উন্মুক্ত থাকে। ব্রিটেনের বিখ্যাত আবাসন কোম্পানি হোমস অ্যান্ড প্রোপার্টির তালিকায় এটিই বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ও দামি স্থাপনা। যার নির্মাণ ব্যয় ৭৫ বিলিয়ন ইউরো (১০০ বিলিয়ন ডলার)। যা মসজিদে হারামকে দামি স্থাপনাগুলোর শীর্ষে নিয়ে এসেছে। আবার এটি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থাপনা, যেখানে প্রতি বছর লাখ লাখ তীর্থযাত্রী হজ ও ওমরাহ পালনের জন্য যান। নির্মাণের পর থেকে, ক্রমবর্ধমান তীর্থযাত্রীকে ধারণ করার জন্য বেড়েছে এর আয়তন। বর্তমানে চার মিলিয়ন মুসল্লির মোট ধারণক্ষমতাসহ এটি বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদ।

২) মালির বিস্ময়কর মাটির মসজিদ ‘দ্য গ্রেট মস্ক অব ডিজেনি’
আফ্রিকার দেশ মালির ডিজেনি শহরে অবস্থিত ঐতিহাসিক মসজিদ ‘দ্য গ্রেট মস্ক অব ডিজেনি’। যা আমাদের এশিয়া বা আরব অঞ্চলের মসজিদের স্থাপত্য শৈলী থেকে একেবারে ভিন্ন। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাটির মসজিদ। অনিন্দ্যসুন্দর এ স্থাপনাটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বিবেচিত। মাটি, বালু ও পানির সাহায্যে নির্মাণ করা হয়েছে মসজিদটি। অবশ্য দেয়ালের গাঁথুনি শক্ত করতে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর তাল গাছের কাঠ ব্যবহার হয়েছে। ১২০০ থেকে ১৩০০ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে তৈরি হয় মসজিদটি। মালির সুলতান কনবরু ইসলাম গ্রহণের পর তার রাজপ্রাসাদ ভেঙে সেখানে এ মসজিদ নির্মাণ করেন। মাটি দিয়ে নির্মিত হওয়ায় প্রতি বছরই মসজিদটির কিছু অংশ অথবা পুরো অংশ সংস্কার করতে হয়। প্রচণ্ড গরমের দিনেও মসজিদের ভেতরে অত্যন্ত ঠাণ্ডা থাকে। মসজিদে একসঙ্গে প্রায় ৩ হাজার মানুষ নামাজ আদায় করতে পারেন। স্তম্ভের একেবারে শীর্ষে অবস্থিত উটপাখির ডিমগুলো মসজিদের বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে অন্যতম; যা মালিয়ান অঞ্চলে উর্বরতা এবং বিশুদ্ধতার প্রতীক।

৩) মালয়েশিয়ার ক্রিস্টাল মসজিদ
মালয়েশিয়ার উত্তর-পূর্ব কোণে কেলান্তান ঘেঁষে অবস্থিত তেরেঙ্গানু প্রদেশ। এখানে এমনই একটি মসজিদ আছে, যার নাম ক্রিস্টাল মসজিদ। মূল্যবান ক্রিস্টালের সঙ্গে স্বচ্ছ কাচ ও স্টিলের দণ্ড দিয়ে বানানো হয়েছে মসজিদটি। স্বচ্ছতার কারণেই এই মসজিদের এমন নামকরণ। মুসলিম স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শনটি দাঁড়িয়ে আছে মালয়েশিয়ার তেরেঙ্গানু এলাকার ‘পোলা ও ওয়ান ম্যান’ দ্বীপে। প্রাকৃতিক শোভা ও মননশীল নির্মাণশৈলীর অভূতপূর্ব সমন্বয়ে তৈরি এই মসজিদ কেবল মালয়েশিয়ায় নয়, পুরো বিশ্বের কাছে অতি আশ্চর্য ও মনোমুগ্ধকর একটি স্থাপনা। মসজিদের ভেতরে আরামদায়ক তাপমাত্রা বজায় থাকে। ক্রিস্টালের তৈরি বলে মসজিদের ভেতরের দৃশ্য বাইরে থেকে দেখা যায়। একসঙ্গে ১৫০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন মসজিদটিতে। মসজিদটি নির্মাণে সমন্বয় করা হয়েছে ইসলামী স্থাপত্য, মালয় ও চীনের শিল্প রীতি অনুসারে। সুলতান তেরেঙ্গানু মিজান জায়নুল আবেদিনের নির্দেশে তৈরি করা হয় মসজিদটি। ২০০৬ সালে তিনি এই মসজিদ নির্মাণের আদেশ দেন। ২০০৮ সালে মুসল্লিদের নামাজের জন্য মসজিদটি উন্মুক্ত করা হয়।

৪) তুরস্কের ইস্তাম্বুলের সুলতান আহমেদ মসজিদ
সুলতান আহমেদ মসজিদ। নীল মসজিদ নামে পরিচিত। বসফরাস প্রণালির তীর ঘেঁষে মুসলিম ঐতিহ্যের জানান দেয় সপ্তদশ শতকের অনিন্দ্যসুন্দর এই মসজিদ। ইস্তাম্বুলের বিস্ময়কর নীল মসজিদটি নির্মাণ করেন সুলতান প্রথম আহমেদ। মসজিদটির স্থপতি ছিলেন মাহমুদ আগা। ১৬০৯ সালে এ মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৬১৬ সালে। মসজিদের গেটের কেন্দ্রে ১১-১২ শতকের সেলজুক তুর্কি আমলের জ্যামিতিক নকশা ব্যবহার করা হয়েছে।
মসজিদের অভ্যন্তরভাগের দৃষ্টিনন্দন অলঙ্করণ এবং এর ঝুলন্ত বাতির ঝাড় মানুষকে অভিভূত করে। অভ্যন্তরভাগে ব্যবহৃত প্রচুর নীল টালি অসাধারণ। এ নীল টালিগুলোর কারণেই মসজিদের নাম হয়েছে নীল মসজিদ।

এ মসজিদ দালানের গঠন প্রায় চতুর্ভুজাকার, যাকে ঢেকে আছে একটি গম্বুজ। এ বড় গম্বুজ ছাড়াও দালানে রয়েছে কয়েকটি আধা গম্বুজ। দাঁড়িয়ে থাকা ১৬.৩ ফুট পরিধিবিশিষ্ট চারটি বিশাল স্তম্ভ মসজিদের ভার রক্ষা করার মূল হাতিয়ার।
নীল মসজিদে রয়েছে ২৬০টি জানালা। এগুলো দিয়ে অভ্যন্তরে সুন্দরভাবে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে। জানালার পাল্লায় ব্যবহার করা হয়েছে ১৭ শতকের স্বচ্ছ রঙ মিশ্রিত কাচ। অবশ্য পরবর্তীকালে এ সুন্দর জানালাগুলোর সংস্কার করা হয়েছে।

৫) চীনের জিয়ান গ্রেট মসজিদ
জিয়ানের গ্রেট মসজিদ বেইজিং শহরের মধ্যভাগে ৩০ হুয়াজুতে অবস্থিত। ঐতিহ্যবাহী চীনা নকশা এবং ইসলামিক ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে নির্মিত মসজিদটি। এই বিস্ময়কর স্থাপনা এখন চীনের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হিসেবেও স্বীকৃত। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কোর ইসলামিক ঐতিহ্যের অংশের তালিকায় এই মসজিদের নাম উঠে আসে। এটিই চিনের ইতিহাসে প্রথম মসজিদ, যা মহানবী (স.)-এর তিরোধানের এক শতাব্দী পরই খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে ৭৪২ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করা হয়েছিল। (তথ্যসূত্র: Liu, Zhiping (1985). Zhongguo Yisilanjiao jianzhu [Islamic architecture in China) ট্যাং সাম্রাজ্যের তিয়ানবো যুগের সম্রাট জুয়ানরং-এর প্রথম বছরে নির্মাণকাজ শুরু হয়। এরপর সং সাম্রাজ্য (৯৬০-১২৭৯), জুয়ান সাম্রাজ্য (১২৭১-১৬৩৮), মিং সাম্রাজ্য (১৩৬৮-১৬৪৪) এবং কিং সাম্রাজ্যের (১৬৪৪-১৯১১) সময় এই মসজিদের সঙ্গে আরও কিছু জায়গা সংযুক্ত করা হয়। বিভিন্ন সাম্রাজ্যের সময় নতুন নতুন অংশ যুক্ত হওয়ায় প্রতিবারই মসজিদটি নতুনরূপ পেয়েছে আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা ঐতিহাসিক সময়ের চিহ্ন। মসজিদটি ৬ হাজার বর্গমিটার এলাকার ওপর অবস্থিত। এখানে প্রায় হাজার সংখ্যক মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন। চীনা ধারার মতো মসজিদের চার আঙিনার মাঝে প্যাভিলিয়ন রয়েছে। মসজিদের দেয়ালগুলো বিভিন্ন ইসলামিক চিত্র দিয়ে সজ্জিত।

৬) ক্রোয়েশিয়ার রিজেকায় ইসলামিক সেন্টার মসজিদ
এই মসজিদটি সমসাময়িক ও ঐতিহ্যবাহী ইসলামি শিল্পের এক অত্যাশ্চর্য মিশ্রণ। মসজিদটি বিশ্বের অন্যতম সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি মসজিদ। দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদের নকশা করেছেন ক্রোয়েশিয়ান বিখ্যাত স্থপতি দসান দজমোঞ্জ (১৯২৮-২০০৯)। পরে স্থাপত্যবিদ ডার্কো ভ্লাও ভিও এবং ব্রংকো ভুনিভোইচ তার নকশায় কিছুটা পরিবর্তন করে নতুন ডিজাইন করেন। ছাই রঙের পিলারকে মেটালিকের পাত দ্বার মুড়িয়ে মিনারটি নির্মিত। মিনারে শিখরে প্রচলিত মিনারের মতো একটি সূক্ষ্ণফলা ও চাঁদের মতো দু’টো গোলাকার স্বর্ণালী পিণ্ড রয়েছে।

দূর থেকে দেখলে মনে হবে, মিনারটি আপনমনে খেলছে খোলা আকাশে। এটাই শিল্প, শিল্পের সৌন্দর্য। রিজেকার মুসলমানরা ১৯৬৮ সালে এখানে প্রথম মসজিদ স্থাপনের প্রস্তাব করেন। পরে তাদেরকে ১০ হাজার বর্গমিটার জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেখানে অস্থায়ী স্থাপনায় মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশেষে নানা ঘটনা-পরিক্রমা শেষে এই ডিজাইনে মসজিদ প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয় ২০০৮ সালে, আর তা শেষ হয় ২০১৩ সালে।

উপরে