রূপপুর প্রকল্পে ডেঙ্গুর হানা

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৭, ২০২২; সময়: ৪:৫৮ অপরাহ্ণ |
রূপপুর প্রকল্পে ডেঙ্গুর হানা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঈশ্বরদী : পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। আক্রান্ত রোগীর অধিকাংশই নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত দেশি-বিদেশি নাগরিক। এছাড়াও উপজেলার সাহাপুর ও পাকশীসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে রোগী আসছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।

আক্রান্তের হিসাব অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৬ জন রোগী ভর্তি আছেন। এ ছাড়া সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন এ পর্যন্ত ২০৬ বেশি রোগী। তবে আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার খুবই কম। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছাড়াও পাবনা, রাজশাহী, কুষ্টিয়া ও ঢাকায় প্রায় ৩০০ জনের অধিক রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।

ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, মেডিসিন ওয়ার্ডে পৃথকভাবে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা চলছে। তাঁদের সবাই মশারির ভেতরে। অনেকের হাতে স্যালাইন লাগানো। এ অবস্থায় স্বজনেরা কয়েকজনকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন।

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের তথ্য মতে, নির্মানাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ২০ সেপ্টেম্বর নির্মাণ শ্রমিক রকিবুল ইসলাম ও ২৯ সেপ্টেম্বর রবিন প্রামানিক নামে এক রোগীকে ঈশ্বরদী থেকে রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে পাঠানোর পর মারা যান এবং ২৮ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাব্বি সর্দার নামে এই শ্রমিক মারা যান।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। আক্রান্ত রোগীর ৯০ ভাগই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী। বাঙালি ছাড়াও আক্রান্তের তালিকায় রয়েছেন রূপপুরে কর্মরত রুশসহ বিদেশি নাগরিকেরা। প্রথমদিকে তারা জ্বরাক্রান্ত হয়ে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। কিন্তু সুস্থ না হওয়ায় অনেকে প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডেঙ্গুর বিষয় নিশ্চিত হয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভর্তি হতে আসেন। এছাড়াও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা সরাসরি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়ে তাদের পরীক্ষা নিরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ছে।

জেলা সদরের মালিগাছা গ্রামের আকাশ হোসেন রূপপুর প্রকল্পে ‘নিকিম’নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ফোরম্যান। তাঁর দলে ১২ জন কর্মী ছিলেন। পর্যায়ক্রমে ১২ জনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনিও নয় দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।

আকাশের দাবি, প্রকল্প এলাকার কিছু জায়গায় বৃষ্টির পানি জমে। সেখানে প্রচুর মশা আছে। মশার কামড়েই তাঁরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। কর্তৃপক্ষ প্রকল্প এলাকায় দু-এক দিন পরপর একবার করে স্প্রে করে। সেটা আরও বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক ও ডেঙ্গু ইউনিটের প্রধান শফিকুল ইসলাম শামীম বলেন, বিগত বছরের তুলনায় ঈশ্বরদীতে এবার ডেঙ্গু আক্রান্তের হার উদ্বেগজনক। এ কারণে হাসপাতালে ডেঙ্গুর আলাদা ইউনিট চালু করা হয়েছে। তিনি জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা ৯০ ভাগ রোগী আসছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। আমরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে তাদের জানিয়েছি। বাসাবাড়ি বা অফিস চত্বরে জমে থাকা পানিতে ডেঙ্গু মশা বিস্তার লাভ করে। এজন্য জমে থাকা পানি অপসারণ ও এলাকা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। তারা ইতিমধ্যে গ্রিনসিটি এলকায় নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।

রূপপুরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বেশি কেন? এমন এক প্রশ্নের জবাবে চিকিৎসক শফিকুল ইসলাম শামীম বলেন, আক্রান্ত রোগীর অনেকেই কিন্তু বাইরে থেকে এসেছেন। আবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর মাধ্যমে অন্য ব্যক্তির শরীরে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এর বাইরে বিশেষ কোনো কারণ আছে কিনা- সেটি বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন।

পাবনা সিভিল সার্জন মনিসর চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্তের খবর পেয়ে তাঁরা প্রকল্পের আবাসিক এলাকা গ্রিন সিটিসহ কয়েকটি জায়গা থেকে লার্ভা সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু কোথাও এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়নি। মূল প্রকল্প এলাকায় প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। কর্তৃপক্ষ চাইলে তাঁরা মূল প্রকল্প এলাকা থেকে লার্ভা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করতে পারেন।

রূপপুর প্রকল্পে একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের অভ্যন্তরে চিকিৎসা ইউনিট রয়েছে। এটি রূপপুর প্রকল্পের মূল ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান আছে দ্বারা পরিচালিত। কিন্তু আছের মেডিকেল ইউনিটে চিকিৎসক ফকরুল ইসলাম কিছুদিন যাবৎ অনুপস্থিতির কারণে অভ্যন্তরীণ চিকিৎসাসেবা ব্যহত হচ্ছ।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সাইট ইনচার্জ রুহুল কুদ্দুস বলেন, মূল প্রকল্পের দায়িত্বে আছে ‘এটমিস্টয় জয়েন স্টক কোম্পানি’ নামের রাশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের অনুমতি ছাড়া কেউ মূল প্রকল্পে ঢুকতে পারেন না। প্রকল্পের ভেতরে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের খবর জানার পরপরই তাঁরা প্রতিষ্ঠানটিকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। তাঁরা নিয়মিত স্প্রে করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী (সাইটডিরেক্টর) ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পের ভেতরে নিয়মিত জিবাণুনাশক ওষুধ স্প্রে করা হচ্ছে, যাতে কোনো লার্ভা বাড়তে না পারে। সম্পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করে স্বাস্থ্য বিধি মেনেই কাজ করছে প্রকল্পের শ্রমিকরা। করোনা মহামারির সময়েও রূপপুর প্রকল্পে স্বাস্থ্য বিধি মেনে কাজ পরিচালনা করায় কাজের কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি, এখন ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হলেও প্রকল্পের মূল কাজে বিঘ্ন ঘটছে না বলে জানান তিনি।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে