রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক নেতা মাহাতাবের বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ

প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২৩; সময়: ৮:৪৪ অপরাহ্ণ |
রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক নেতা মাহাতাবের বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক : মাহাতাবের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে কিংবা নির্বাচনে দাঁড়ালে, তার আর রক্ষা নেই। হয় পঙ্গু। না হয় মৃত্যু। অথবা চাকরিচ্যুত, কর্মহীন। মাহাতাবের কথাই আইন। তিনি কাউকেই মানেন না। কারো কথা শোনেনও না। তার অন্যায় ও বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করলেই নির্যাতন নেমে আসে। টিকাপাড়ায় তার ব্যক্তিগত অফিসটা হলো টর্চার সেল। সেখানেই মারধর করে। আনিসুর নামে এক ড্রাইভার ছিল, সে মাহাতাবের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ২০১৬ সালে সাধারণ সম্পাদক পদে ভোটে দাঁড়িয়েছিল। নির্বাচনে সে জিতেছিল। কিন্তু ফল ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তারপর আনিসুরকে শিরোইলে পিটিয়ে নিজের গাড়ির ব্যাকডালায় তুলে নওদাপাড়ায় নিয়ে যায় মাহাতাব। এটা আমি দেখেছি। নির্যাতনের পর অসুস্থ হয়ে লোকটা মারা গেছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজশাহী শিরোইল বাস টার্মিনাল এলাকায় এ রকম ভয়ঙ্কর নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন কার্তিক ঘোষ। রাজশাহীতে প্রায় ৪০ বছর ধরে পরিবহন সেক্টরে কাজ করেন তিনি। খুব কাছ থেকে দেখেছেন, মাহতাবের ভয়ঙ্কর নিপীড়ক হয়ে ওঠা।

শ্রমিকরা জানান, রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহাতাব হোসেন কখনো শ্রমিক ছিলেন না। তবে টোকাই থেকে দিনে দিনে হয়ে ওঠেন ছিঁচকে মাস্তান। এরপর বসেন ইউনিয়নের শীর্ষ চেয়ারে। ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হয়েও ধার ধারেন না কোনো নিয়ম কানুনের। তার কথাই আইন। তার অন্যায়ের কেউ বিরোধিতা করলে রেহাই নেই। ফলে শ্রমিকদের আছে রীতিমতো আতঙ্কের আরেক নাম মাহাতাব। অনেকেই তার নাম দিয়েছেন এরশাদ শিকদার।

শ্রমিক নেতা মাহাতাব রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদকও ছিলেন। তবে অনৈতিক ও দলবিরোধী কর্মকাণ্ডের দায়ে ২০১৬ সালেই তাকে বহিষ্কার করা হয়। মাহাতাব ক্ষমা চেয়ে অঙ্গীকার করেন, আর সংগঠনবিরোধী কোনো কাজ করবেন না। পরে তাকে ক্ষমা করা হয়। এর পরের বছর ২০১৭ সালে আবার বহিষ্কার হন মাহাতাব। এখন তিনি একেবারেই বেপরোয়া।

শ্রমিক কার্তিক ঘোষ বলছিলেন, ১৯৯৬ সালে আমি যখন ঢাকার গাড়ি চালাতাম তখন বাস ও ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন আলাদা হলো। তখন দুই সংগঠনের মধ্যে বিরোধ চলছিল। ওই সময় টোকাই হয়ে বাস শ্রমিকের পক্ষে আসে মাহাতাব। ২০০২ সাল থেকে তিনি (মাহাতাব) শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা হয়ে যায়। এরপর সে বিপুল টাকার মালিক। মাহাতাব ইউনিয়নের কোনো অনুদানই শ্রমিকদের দেয় না। বহু টাকা মেরে দিয়েছে। মৃত্যুকালীন অনুদানের টাকা পাবে ১২০ জন শ্রমিকের পরিবার। একেকজন ৮০ হাজার টাকা করে পাওয়ার কথা। কন্যাদায়গ্রস্ত ২০০ জন পিতা পাবেন ৫০ হাজার টাকা করে। শিক্ষাভাতাও দেন না। এসব অনুদানের দুই-তিন কোটি টাকার খোঁজ নেই।

সর্বশেষ সাধারণ সভায় ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে টাকা লেনদেনের কথা বলা হয়েছে। সেটাও করে না। প্রতিদিন গাড়ি থেকে তোলা চাঁদার বিপুল টাকা লুটপাট হচ্ছে বলে অভিযোগ শ্রমিক কার্তিক ঘোষের।

নির্যাতিত হয়ে রাজশাহী থেকে বিতাড়িত বাসচালক কাজিরুল ইসলাম সেলিম। তিনি এখন ঢাকায় বাস চালান। যোগাযোগ করা হলে সেলিম জানান, মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নানা অনিয়মের প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। এ জন্য ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহাতাব হোসেন তার ওপর ক্ষুব্ধ হন। গত বছর রমজানের পর ঈদের আগের দিন সেমাই-চিনি দেওয়ার নাম করে তাকে নগরীর টিকাপাড়ায় তার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে ডাকেন। এরপর সেখানে তাকে বেধড়ক পেটানো হয়। মাহাতাব নির্দেশ দেন, এখন থেকে তার শ্রমিক কার্ডের প্রতিমাসের চাঁদা নেওয়া হবে না। এই চাঁদা বকেয়া থাকলে সংগঠনের সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়। তারপর আর তার চাঁদা নেওয়া হয়নি। মাহাতাব বাস মালিককে চাপ দেন, তাকে যেন গাড়ি চালাতে না দেওয়া হয়। তাই রাজশাহীতে তিনি কোন গাড়ি পাননি চালানোর জন্য। বাধ্য হয়ে ঢাকায় চলে গেছেন।

মাহাতাবের নির্দেশে কর্মহীন শ্রমিক মিজানুর রহমান মেরাজ। তিনি জানান, তিনি মাহাতাবের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। তাই মাহাতাব তাকেও নির্যাতন করেছেন। মেরাজ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগ নামে আরেকটি সংগঠনের মহানগরের সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার কারণে ক্ষুব্ধ হন মাহাতাব। তিনি তাকে ডেকে নিয়ে নির্যাতন করেছেন। মেরাজ আগে একটি টিকিট কাউন্টারের মাস্টার ছিলেন। মাহাতাব তাকে বাদ দিয়ে ওই পদে তার ঘনিষ্ঠ লোককে বসিয়েছেন।

মেরাজকে পেটানোর সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন হারুন-অর-রশিদ নামে আরেক শ্রমিক। তিনি মাহাতাবের নৃশংস নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বলেন, জরুরি কথা আছে বলে মেরাজ ভাইকে ডেকে নেন মাহাতাব। চেম্বারে যাওয়া মাত্রই নিজের দুই পায়ের ভেতর মেরাজের মাথা ঢুকিয়ে নিয়ে পিঠে লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকে। তাকে পেটানোর পর সিদ্দিক নামের আরেক শ্রমিককেও পেটানো হয়। তখন আমি বলি, ভাই, ঈদের আগের দিন চোরকেও মানুষ এভাবে মারে না। একথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকেও মারতে উদ্যত হয় মাহাতাব। পরিস্থিতি দেখে আমি জাতীয় শ্রমিক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নূর কুতুব উদ্দিন মান্নানকে ফোন করি। তিনি মাহাতাবের সঙ্গে কথা বলেন। তারপর সেদিন দুই শ্রমিক পেটানো বন্ধ হয়।

হারুন আরও বলেন, আমি মোটর শ্রমিক ইউনিয়নে ভোট করেছিলাম সহসভাপতি পদে। তাই মাহাতাব আমার কার্ডের চাঁদা নেয় না। আমার কর্মও বন্ধ। ২০১৯ সাল থেকে আমাকে গাড়িতেও উঠতে দেয় না। দুই শ্রমিককে মারধরের ঘটনায় তারা থানায় অভিযোগ করেছিলেন। ওই অভিযোগ টাকার কাছে অন্ধ হয়ে গেছে। শ্রমিকেরা এখন ভয়ে মুখ খোলে না।

এদিকে মাহাতাবের বর্বর নির্যাতনের শিকার সাধারণ শ্রমিকরা বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর শিরোইল ঢাকা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় যখন কয়েকজন সাংবাদিকদের সামনে কথা বলছিলেন তখন শুভ নামে এক যুবক তার মোবাইল ফোনে ভিডিও করছিলেন। সাংবাদিকরা জানতে জানতে চাইলে তিনি নিজেকে বোয়ালিয়া থানা শিক্ষা অফিসের স্টাফ বলে পরিচয় দেন। পরে তিনি মোটর শ্রমিক পরিচয় দিয়ে সাংবাদিকদের পেশাগত কাজে বাধা দেন। তার সঙ্গে যোগ দেন শ্রমিক নেতা সজিবসহ বেশ কয়েকজন। তারা এসে হট্টগোল শুরু করে এবং সাংবাদিকদের বাধা দেয়।

সাধারণ শ্রমিকরা জানান, এরা মাহাতাবের ক্যাডার বাহিনীর সদস্য। মাহাতাবের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই তারা শ্রমিকদের মারধর করেন।

তবে এ ঘটনা নিয়ে জানতে চাইলে মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহাতাব গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, আমার বিরুদ্ধে কথা বলবে আর আমার লোকেরা প্রতিবাদ করবে না? করবে তো। কিন্তু যারা আমার বিরুদ্ধে কথা বলছিল, ওরা শ্রমিক না। ওদের দেখামাত্রই অ্যাকশনের কথা বলা আছে। তবে আমার লোকেরা যদি সাংবাদিকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, তাহলে যে শাস্তি চাইবেন তা দেওয়া হবে।

আর নির্যাতিত শ্রমিকদের নাম ধরে ধরে নির্যাতনের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘কাউকে আমি নির্যাতন করিনি। এদের সঙ্গে চার-পাঁচ বছর ধরে আমার দেখা হয় না। মারলাম কখন? সূত্র: যুগান্তর

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে