দুই ঘণ্টা কোথায় ছিলেন জেসমিন

প্রকাশিত: এপ্রিল ৬, ২০২৩; সময়: ১১:৫৫ পূর্বাহ্ণ |
দুই ঘণ্টা কোথায় ছিলেন জেসমিন

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : র‌্যাবের ভাষ্য অনুযায়ী, নওগাঁর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের অফিস সহকারী সুলতানা জেসমিনকে ২২ মার্চ বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে আটক করা হয়েছিল। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

অপরদিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, আটকের সময়টা হচ্ছে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে পৌনে ১০টার মধ্যে। আটক নিয়ে যে দুই রকম ভাষ্য পাওয়া গেল, তাতে সময়ের ব্যবধান দুই ঘণ্টা। এই দুই ঘণ্টা জেসমিন কোথায় ছিলেন, সেটা জানতে চান তাঁর স্বজনেরা। খবর- প্রথম আলো

আটকের পরদিন জেসমিনের বিরুদ্ধে রাজশাহীর কমিশনার কার্যালয়ের যুগ্ম সচিব এনামুল হক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। সেই মামলায় বলা হয়, বাদীর তাৎক্ষণিক তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাবের টহল দল রাস্তা থেকে জেসমিনকে আটক করেছে।

তবে জেসমিনের স্বজনদের দাবি, পূর্বপ্রস্তুতি নিয়েই র‍্যাব অভিযান চালিয়ে তাঁকে আটক করেছে এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া ওই দিন বেলা সোয়া একটায় নওগাঁর হাসপাতালে ভর্তি করার আগ পর্যন্ত জেসমিনের অবস্থান সম্পর্কে তাঁর পরিবার কোনো তথ্য পায়নি। হাসপাতালে নেওয়ার আগ পর্যন্ত জেসমিনকে কোথায় রাখা হয়েছিল, এখন সেটা জানতে চান তাঁর স্বজনেরা।

র‌্যাবের ভাষ্য অনুযায়ী, জেসমিনকে আটকের পর থানায় নেওয়ার পথে অসুস্থবোধ করলে তাঁকে নওগাঁ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে পরদিন তিনি মারা যান।

জেসমিনকে আটকের সময় প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে একজন আবু হায়াত, যাঁকে অভিযানের সময় জব্দতালিকার সাক্ষী করেছে র‌্যাব। এর পরদিন (২৩ মার্চ) প্রতারণার অভিযোগে জেসমিনের বিরুদ্ধে যুগ্ম সচিব এনামুল হক রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় যে মামলা করেন, তাতেও আবু হায়াতকে সাক্ষী করা হয়েছে।

আবু হায়াত নওগাঁ শহরের কল্পনা হার্ডওয়্যার নামের একটি দোকানের কর্মী। তিনি বলেন, (২২ মার্চ) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শহরের জনকল্যাণ মোড়ের দিক থেকে মুক্তির মোড়ে তাঁর দোকানের সামনের রাস্তায় এক ব্যক্তি একটি রিকশা থামান। ওই রিকশার আরোহী একজন নারী, তিনি মুঠোফোনে কথা বলছিলেন। রিকশাটা থামানোর কয়েক মিনিটের মধ্যে র‍্যাবের একটি মাইক্রোবাস সেখানে পৌঁছায় এবং তাঁরা ওই নারীকে (জেসমিন) গাড়িতে তুলে নিয়ে যান। পুরো ঘটনা ঘটেছে ১০ থেকে ১২ মিনিটের মধ্যে। তখন র‍্যাবের একজন সদস্য একটি কাগজে আবু হায়াতকে স্বাক্ষর করতে বলেন। স্বাক্ষর করার পর র‌্যাব সদস্যরা ওই নারীকে নিয়ে চলে যান।

কল্পনা হার্ডওয়্যারের ব্যবস্থাপক আবুল বাশারও একই রকম বর্ণনা দিয়েছেন। মুক্তির মোড়ে অবস্থিত মেসার্স রেহেনা মেডিকেল স্টোরের মালিক শফিকুল ইসলামও ঘটনাস্থলে ছিলেন। তিনি জেসমিনকে আগে থেকে চিনতেন। তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তাঁর মামা নাজমুল হককে দ্রুত মুঠোফোনে জানিয়েছিলেন শফিকুল। গত মঙ্গলবার শফিকুল বলেন, জেসমিন র‌্যাব সদস্যদের পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন। তাঁরা জেসমিনকে পরিচয়পত্র দেখিয়েছিলেন। জেসমিনকে যে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে আটক করে মাইক্রোবাসে করে নিয়ে গেছে, তা এই তিনজন প্রত্যক্ষদর্শীই সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন।

দুই ঘণ্টা হেফাজতে রাখার কথা অস্বীকার

মামলায় যুগ্ম সচিব এনামুল হক দাবি করেন, তিনি রাজশাহী থেকে দাপ্তরিক কাজের উদ্দেশ্যে ২২ মার্চ নওগাঁয় যান। ওই দিন বেলা ১১টা ১০ মিনিটে নওগাঁ বাসস্ট্যান্ডে র‍্যাবের টহল দলকে প্রতারণার শিকার হওয়ার বিষয়টি জানান।

তাৎক্ষণিকভাবে র‍্যাবের ওই দল জেসমিনকে আটক করতে মুক্তির মোড়ে আসে। ১১টা ৫০ মিনিটে জেসমিনকে র‌্যাব আটক করে। সাক্ষীদের সামনে জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জব্দতালিকা করে র‍্যাব। পরে আবার জিজ্ঞাসাবাদের সময় জেসমিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে নওগাঁর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

র‍্যাব ঘটনার দিন যে জব্দতালিকা করেছে, সেখানেও তালিকার সময় উল্লেখ করা হয়েছে দুপুর সাড়ে ১২টা। তবে জব্দতালিকার সাক্ষী আবু হায়াত প্রথম আলোকে বলেছেন, জেসমিনকে আটকের পর নিয়ম রক্ষার কথা বলে র‌্যাব সকাল পৌনে ১০টার দিকে একটি কাগজে তাঁর স্বাক্ষর নিয়েছে। কিন্তু সকাল পৌনে ১০টা থেকে দুপুর পৌনে ১২টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা জেসমিন র‌্যাবের হেফাজতে ছিলেন, সেটা র‍্যাব স্বীকার করছে না।

জেসমিনকে তুলে নেওয়ার সময় অভিযানে থাকা সদস্যরা র‌্যাব-৫ এর জয়পুরহাট ক্যাম্পের। বিষয়টি জানতে গত দুই দিন র‌্যাব-৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ারের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সেটি সম্ভব হয়নি। পরে গতকাল বুধবার দুপুরে রাজশাহীতে র‌্যাব-৫ এর অধিনায়কের কার্যালয়ে গিয়েও তাঁর সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হয়নি।

এরপর র‌্যাব সদর দপ্তরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, সুলতানা জেসমিনকে আটকের সময় সাক্ষী ছিল। সাক্ষীর সামনেই তাঁকে আটক করা হয়েছে। আটকের পর কম্পিউটারের দোকানে নথি প্রিন্ট করা এবং অন্যান্য কার্যক্রম শেষে থানায় নিয়ে যাওয়ার সময় জেসমিন অসুস্থ হয়ে পড়েন।

র‌্যাবের এই মুখপাত্র বলেন, এজাহারে আটকের বিষয়ে যে সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সবই আনুমানিক সময়। এজাহারের সময় অনুযায়ী সাক্ষীর সামনে থেকেই জেসমিনকে আটক করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে মামলার বাদী এনামুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন আছে উল্লেখ করে কথা বলতে রাজি হননি।

জেসমিনের মামা নওগাঁ সদর পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নাজমুল হকের সঙ্গে মঙ্গলবার দুপুরে নওগাঁ আদালত চত্বরে কথা হয়। তিনি বলেন, জেসমিন সাধারণত ৯টার পর অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন। ওই দিনও জেসমিন একই সময়ে বের হয়েছিলেন। সাড়ে ৯টা থেকে পৌনে ১০টার মধ্যে তাঁকে র‌্যাব তুলে নিয়ে যায়।

নাজমুল হক বলেন, ‘জেসমিনকে আটকের যে সময়ের কথা মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, তার আগের দুই ঘণ্টা জেসমিন কোথায় ছিলেন, ওই সময়ে তাঁর সঙ্গে কী হয়েছে, সেটা জানতে চাই।’

গত মঙ্গলবার দুপুরে নওগাঁর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জাহিদ নজরুল চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে কথা হয়। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, ২২ মার্চ বেলা ১টা ১৫ মিনিটে র‍্যাব সদস্যরা জেসমিনকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তখন তাঁর শরীর দুর্বল ছিল। কপালে আঘাতের চিহ্ন ছিল। তার নিম্ন রক্তচাপ ছিল। সন্ধ্যায় তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

জাহিদ নজরুল চৌধুরী আরও বলেন, গত সোমবার র‍্যাবের তদন্ত কমিটি হাসপাতালে এসেছিল। তাঁদেরও একই কথা বলেছেন তিনি। তদন্ত কমিটির সদস্যরা তাঁকে জানিয়েছেন, অভিযানের প্রক্রিয়া নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। সেটিই তাঁরা তদন্ত করে দেখছেন।

এদিকে গত সোমবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ পুলিশের কাছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মাথায় যে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে, তা মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট নয়। মস্তিষ্কের রক্তনালি ফেটে রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার সূত্র ধরেই জেসমিনের ময়নাতদন্ত করা হয়।

মামলার বাদী এনামুল হক এজাহারে দাবি করেছেন, জেসমিনের বিরুদ্ধে তিনি আকস্মিকভাবে মৌখিক অভিযোগ দিয়েছিলেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে জেসমিনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল র‌্যাব।

জেসমিনের মামা নাজমুল হক বলেন, এই অভিযান পুরোপুরি পরিকল্পিত ছিল। জেসমিন বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকেই তাঁকে অনুসরণ করা হচ্ছিল। এজাহারে যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, এত ত্বরিত গতিতে অভিযান চালানোর বিষয়টি অস্বাভাবিক। তা ছাড়া ঘটনার আগের দিনও জেসমিনের জনকল্যাণ মোড়ের বাসার আশপাশে অচেনা ব্যক্তিদের আনাগোনা ছিল। অর্থাৎ আগে থেকে ‘রেকি’ করে জেসমিনকে তুলে নেওয়া হয়।

এ বিষয়ে র‌্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘র‌্যাবের কোনো সদস্য আগে থেকে জেসমিনকে অনুসরণ করেননি। যুগ্ম সচিব (মামলার বাদী এনামুল হক) যদি আর কাউকে অভিযোগ দিয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে অন্য কেউ জেসমিনকে অনুসরণ করতে পারে।’

মামলার বাদী এনামুল হক এজাহারে র‌্যাবকে আকস্মিকভাবে মৌখিক অভিযোগ করার কথা উল্লেখ করলেও, তিনি গত ২৮ মার্চ বলেছিলেন, গত নভেম্বরে র‌্যাব-৫ এর কাছে তিনি লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন যে ডিজিটাল মাধ্যমে তিনি প্রতারিত হয়েছেন।

এর আগে র‌্যাবের এক ব্যাখ্যায় অভিযোগ সম্পর্কে বলা হয়েছিল, যুগ্ম সচিব এনামুল হকের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারকেরা মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করে। গত ১৯ ও ২০ মার্চ প্রতারকেরা এনামুল হকের অফিসের সামনে তার নাম ব্যবহার করে টাকা আত্মসাৎ করে। খবর পেয়ে এনামুল হক খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, আল আমিন নামের একজন এই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। তিনি আরও জানতে পারেন যে সুলতানা জেসমিন নামের এক নারীও এর সঙ্গে জড়িত।

জেসমিনের মৃত্যুর চার দিন পর ২৮ মার্চ আল আমিনকে ঢাকা থেকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করে। তবে তাঁকে গতকাল পর্যন্ত রাজশাহীতে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেনি থানা-পুলিশ।

তদন্তই শুরু করেনি থানা-পুলিশ

জেসমিনের বিরুদ্ধে করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাজপাড়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সুবাস চন্দ্র বর্মণ এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে রাজশাহী পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কাগজে-কলমেই এই মামলার তদন্তভার পুলিশের কাছে। কিন্তু তদন্ত এখনো শুরু করা সম্ভব হয়নি।

অবশ্য রাজশাহী মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) রফিকুল আলম বলেন, তদন্ত শুরু হয়েছে। অগ্রগতির বিষয়ে তিনি এখনই কিছু বলতে চান না।

এদিকে র‌্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে র‌্যাবের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সদস্যরা গত সোমবার জেসমিনের ছেলে শাহেদ হোসেন ও ভগ্নিপতি আমিনুল ইসলামের লিখিত বক্তব্য নিয়েছে। এই দুজন এ নিয়ে প্রথম আলোকে কিছু বলতে চাননি।

জেসমিনের মামা নাজমুল হক বলেন, জেসমিনের বিষয়ে তারা যা জানে, সব লিখে দিতে বলেছে র‍্যাবের তদন্ত কমিটি। আর কিছু জানতে চায়নি।

এসব অসংগতির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, যদি মৌখিক অভিযোগ হয় ১১টার পর, আর র‌্যাব সাড়ে ৯টা নাগাদ আটক করে, তবে ঘটনাপ্রবাহের ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। তাঁর মতে, এভাবে আটক বা গ্রেপ্তারের আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। এটার পেছনে স্পষ্টত অন্য কোনো উদ্দেশ্য বা ইন্ধন কাজ করেছিল। এ ঘটনায় অভিযুক্ত র‌্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া বাঞ্ছনীয়।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে