একটি ‘ভালো কাজ’ করলেই মিলে একবেলা খাবার

প্রকাশিত: মে ৯, ২০২৩; সময়: ১০:২৭ পূর্বাহ্ণ |
একটি ‘ভালো কাজ’ করলেই মিলে একবেলা খাবার

পদ্মাটাইমস ডেস্ক: ‘বুকে অপারেশন হয়েছে, তাই ভারী কাজ করতে পারি না। এ জন্য তেমন কাজ পাই না, আর কাজ না করতে পারলে খাবার জুটে না। তবে যেদিন থেকে ভালো কাজের হোটেলের সন্ধান পেয়েছি, সেদিন থেকে কোনোদিন আর না খেয়ে থাকতে হয়নি।’

কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর কাওরানবাজারের পান্থকুঞ্জ পার্কে স্থাপিত ‘ভালো কাজের হোটেলে’ খেতে আসা দিনমজুর রফিক মিয়া।

তিনি বলেন, ভালো কাজের হোটেলে প্রতিদিন একবার এসে খেয়ে যাই। এই একবেলা খাবারটাই দুইবেলা না খেয়ে খাওয়া হয়। প্রতিদিন এসে একটা ভালো কাজের কথা বললেই খেতে পারি। তা-নাহলে পুরোদিনই না খেয়ে থাকা লাগত।

রফিক মিয়ার মতো অসংখ্য দিনমজুর, ভিক্ষুক ও অসহায়ের ভরসার জায়গায় পরিণত হয়েছে ভালো কাজের হোটেল নামে ব্যতিক্রমী এ হোটেলটি। স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মানুষকে ভালো কাজের দিকে উৎসাহ জুগাতেই তাদের ‘ভালো কাজের হোটেলে’র কার্যক্রম। অস্থায়ী এই হোটেলে যারাই এসে খাবার খান, তারা প্রতিদিনই কোনো না কোনো একটি ভালো কাজ করে আসেন। আবার কেউ কোনো ভালো কাজ করতে না পারলেও প্রতিশ্রুতি দিলে তিনিও খাবার পান।

জানা গেছে, প্রতিদিন ১২টা বাজতেই কাওরানবাজারের পান্থকুঞ্জে এসে জড়ো হন শত শত মানুষ। এর আগেই স্বেচ্ছাসেবকরা খাবার, পানিসহ থালাবাসন প্রস্তুত রাখেন। ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত সারিবদ্ধ হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকেই ভালো কাজের বর্ণনা দেন, পরে তাদের সবাই নিজ চাহিদামত তৃপ্তি সহকারে খাবার খান।

‘অনেকেই খাবার না পেয়ে চুরি করত, এখন ভালো কাজের চেষ্টা করে’

দিনমজুর রফিক মিয়া বলেন, আমার চেনাজানা অনেকেই খাবার না পেয়ে আগে গিয়ে চুরি করত, কিন্তু এখানে দৈনিক একবেলা খেতে পেরে তাদের আর সেটি করা লাগছে না। তারা এখন দিনে অন্তত একটি ভালো কাজের চেষ্টা করে। এমন উদ্যোগ আমার মতো গরিবের জন্য কতটুকু যে উপকার, ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। যারাই আমাদের এভাবে প্রতিনিয়ত খাওয়াচ্ছে, এ কাজের পেছনে যারা আছে, আমার অন্তর থেকে তাদের জন্য দোয়া করি।

আজকের দিনে কী ভালো কাজ করেছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, একজন অসুস্থ মানুষকে রাস্তা পারাপারে সহযোগিতা করেছি। নিয়মিতই কিছু ভালো কাজ করার চেষ্টা করি। আর যদি না পারি সেদিন নিজেই এসে বলি যে, আজকে কিছু করতে পারিনি, বাকি দিনে পারলে করব।

কারওয়ানবাজারের কাঁঠালবাগান ঢালে এক ব্যক্তিকে পথ চিনিয়ে দিয়েছেন বৃদ্ধ মো. সেলিম উদ্দিন। ভলান্টিয়ারকে এমনটি জানিয়ে খাবার প্লেট নিয়ে টেবিলে খেতে বসেছেন তিনি। কথা বলে জানা যায়, পেশায় দিনমজুর হলেও বয়স বাড়ায় তেমন কাজ-কর্ম করতে পারেন না তিনি। খেয়ে না খেয়ে ফুটপাতেই রাত্রি যাপন করেন। প্রতিদিন দুপুরে এসে ভালো কাজের বিনিময়ে একবেলা খাবার খান সেলিম উদ্দিন।

তিনি বলেন, শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিনই এই হোটেলে খেতে আসি। খাবার-দাবারও ভালো হয়। যারা নিয়মিত আয়োজন করে আমাদের খাওয়ান, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করি।

‘এক বেলা খেতে পারলে বাকি দিনের জন্য আর চিন্তা করা লাগে না’

মজনু মিয়া নামে আরেকজনের সঙ্গে কথা বললে হোটেল সম্পর্কে তিনি বলেন, ভালো কাজ আমাদের সমাজে খুব বেশি হয় না। কিন্তু এখানে যারা নিয়মিত খেতে আসেন, প্রত্যেকে কোনো না কোনো ভালো কাজ করে এসেছেন।

তিনি আরও বলেন, ফুটপাতে যারা থাকে, তারা খাবারের জন্য অনেক কষ্ট করে। কিন্তু এখানে এই হোটেলটি হওয়ার ফলে আশেপাশে যত মানুষ থাকে সবাই খেতে আসেন। কিন্তু এর আগে আমাদের অনেককেই না খেয়ে থাকতে হত। এখন দিনে অন্তত এক বেলা কয়টা ভাত খেতে পারলে বাকি দিনের জন্য আর চিন্তা করা লাগে না। যারা এই কাজটি পরিচালনা করছেন, তাদের জন্য অন্তর থেকে দোয়া।

ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করে মানসিক প্রশান্তি পাই : জাকারিয়া

গত প্রায় চার মাস ধরে ভালো কাজের হোটেলে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করছেন শিক্ষার্থী মো. জাকারিয়া সরদার। তিনি বলেন, শুরুতে এই কার্যক্রমটি সম্পর্কে যখন আমি জানতে পারি, তখন থেকেই অবসর সময়ে আমিও কিছুটা সময় দেওয়ার মনস্থির করি। তাদের সঙ্গে কাজ করার প্রায় চার মাস হয়ে গেল। কাজ করতে কিছুটা কষ্ট হলেও কাজে বেশ আনন্দ পাই। আমার খুবই ভালো লাগে।

জাকারিয়া বলেন, অসহায় গরিব মানুষের মুখে আমাদের চেষ্টায় দুমুঠো খাবার তুলে দেওয়া হয়, বিষয়টি আমাকে মানসিকভাবে খুবই প্রশান্তি দেয়। প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ মানুষ এসে খায়। যারা আসে তাদের বেশিরভাগই গরিব, ভিক্ষুক, দিনমজুর আর রিকশাচালক। মাঝেমধ্যে খাবার দেখে কিছু পথচারীও এসে বসেন।

কী ধরনের ভালো কাজের বিনিময়ে খাবার দেওয়া হয়? এমন প্রশ্নের জবাবে এ ভলান্টিয়ার বলেন, আমাদের এখানে খাবার খাওয়ার শর্তই হলো মানুষের উপকার করতে হবে। যারাই খাবার খেতে আসেন দৈনিক কিছু-না-কিছু ভালো কাজ করে আসেন। কেউ একজন অন্ধ মানুষকে রাস্তা পারাপারে সহযোগিতা করে, কেউ রাস্তা পরিষ্কার করে দেন, একটা রিকশা গর্ত থেকে উঠতে পারছে না কেউ গিয়ে সেটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে দেন। তবে প্রতিদিন এমন কিছু মানুষও পাই নিজ মুখেই ভালো কাজ করতে না পারার বিষয়টি স্বীকার করেন। তাদের কাছ থেকে আমরা দিনের বাকি সময়টাতে যেকোনো একটি ভালো কাজের প্রতিশ্রুতি নিয়ে খাবার দেই।

‘প্রতিদিন ১৮০ জনের খাবারের আয়োজন, যার যতটুকু প্রয়োজন নিয়ে খায়’

নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজে মাস্টার্সের শিক্ষার্থী বোরহান উদ্দিন। ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ নামে সেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য হওয়ার সুবাদে ভালো কাজের হোটেল কার্যক্রমের সঙ্গে তিনি যুক্ত। হোটেল প্রসঙ্গে বোরহান উদ্দিন বলেন, আমাদের এখানে যেই খেতে আসে, আমরা তাদেরকে বলি আপনারা কে, কী ভালো কাজ করেছেন। তারপর আমরা তাদের নাম বয়স এবং ভালো কাজের বর্ণনা লিখে তারপর ভেতরে ঢুকতে দিই। টেবিলে খাবার সাজানো থাকে, সেখান থেকে যার যতটুকু প্রয়োজন নিজ হাতেই নিয়ে খায়।

প্রতিদিন কী পরিমাণ মানুষ খেতে আসে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিদিন অন্তত ১৮০ জন মানুষের খাবারের আয়োজন আমরা রাখি। মানুষ ১৬০ থেকে ১৮০ জনের মধ্যেই থাকে। তবে কোনোদিন একটু বেশিও হয়, আবার

বোরহান উদ্দিন বলেন, ২০০৯ সাল থেকে আমাদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে ২০১৮ সাল থেকে নিয়মিত এই ভালো কাজের হোটেলটি পরিচালিত হচ্ছে। এর আগে আমরা বিভিন্ন দিবসে, সপ্তাহে একদিন বা ১৫ দিনে একদিন অসহায়-ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণ করতাম। তবে ২০১৮ সাল থেকে আমরা প্রতিদিনই এই কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি। আমাদের মূল কার্যক্রম পরিচালিত হয় কমলাপুরে। এছাড়াও কারওয়ানবাজার, সাতরাস্তা, বনানী এবং খিলগাঁও এই পাঁচটি জায়গায় প্রতিদিন প্রায় ১২০০ থেকে ১৩০০ মানুষের খাবারের আয়োজন করি।

অর্থায়ন কোথায় থেকে আসে?

‘প্রায় সময়েই অনেকে এসে জিজ্ঞেস করে দৈনিক এতো সংখ্যক মানুষের খাবারের অর্থায়ন কোথায় থেকে আসে। তাদের জন্য বলি যে, আমাদের এই কার্যক্রম পরিচালিত হয় ‘ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে। সংগঠনের সর্বমোট যে সদস্য আছে, তারা তাদের পকেট খরচ থেকে দৈনিক ১০ টাকা করে একমাসে ৩০০ টাকা করে আমাদের দেন। আমাদের বেশ কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন, তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে নানা কাজে আমাদের সহযোগিতা করেন। মূলত সদস্য ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের যৌথ আয়োজনেই আমরা আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি, বলেন স্বেচ্ছাসেবী বোরহান উদ্দিন।

একজন ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করতে কেমন লাগে, জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে যারা খাবার খেতে আসে, তাদের অধিকাংশই অসহায় ছিন্নমূল মানুষ। খাওয়ার পর দেখা যায় অনেকেই এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দেয়, অনেকেই খাওয়ার পর সুন্দর একটা হাসি দেয়, এগুলোই আমাদের কাছে ভালো লাগে।

জানা গেছে, এ হোটেল পরিচালনার জন্য দেড় হাজারেরও অধিক সদস্য প্রতিদিন ১০ টাকা জমা দেন। এছাড়াও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী ভালো কাজের হোটেলের জন্য অর্থ অনুদান দিয়ে থাকেন। যে কেউ চাইলে নিবন্ধনের মাধ্যমে সহজেই এই উদ্যোগের অংশ হতে পারেন। এ উদ্যোগের রেজিস্ট্রেশন ফি ২০০ টাকা।

সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবা সংক্রান্ত তথ্যের জন্য যোগাযোগ নম্বর- ০১৭১৩২২২৩৪৩ এবং ০১৮৭৩৭০৮০০। সংগঠন সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য ভালো কাজের খাবার ওয়েবসাইটে (https://vkhbd.org) পাওয়া যাবে। এছাড়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাদের অফিসিয়াল পেজ থেকেও বিভিন্ন তথ্য জানা যাবে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে