স্বপ্নেও ভাবিনি আমি মা হব : মাসুরা

প্রকাশিত: মে ১৪, ২০২৩; সময়: ১২:৩১ অপরাহ্ণ |
স্বপ্নেও ভাবিনি আমি মা হব : মাসুরা

নিজস্ব প্রতিবেদক : মাসুরা বেগমের (৩৯) উচ্চতা মাত্র ৩৮ ইঞ্চি। আর ওজন মাত্র সাড়ে ১২ কেজি। খর্বকায় হওয়া সত্ত্বেও ৩৩ বছর বয়সে জন্ম দিয়েছেন কন্যা সন্তানের। এখন স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার মাসুরার।

তবে মাসুরার মতো মা হওয়া দেশে তো বটেই, বিশ্বের চিকিৎসার ইতিহাসেই খুবই বিরল ঘটনা। চিকিৎসকরা বলছেন, এশিয়ার মধ্যে শারীরিক উচ্চতায় সব থেকে ক্ষুদ্র মা মাসুরা বেগম।

রাজশাহী পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের বজ্ররাপুরের বাসিন্দা মাসুরা। মাসুরার স্বামী মনিরুল ইসলাম পেশায় ভ্যান চালক। তাদের ১০ বছর বয়সী মেয়ে মরিয়াম খাতুন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। মনিরুল ইসলাম ও মাসুরা বেগম ২০০৩ সালে নিজেরা একে অন্যকে পছন্দ করে বিয়ে করেন। তবে মজার বিষয় হলো, মাসুরা বেগম, মনিরুল ইসলাম ও তাদের মেয়ে মরিয়াম খাতুন একজন আরেকজনকে ‘ময়না’ বলে ডাকেন। কেউ কারো নাম ধরে ডাকে না বলে জানান প্রতিবেশীরা।

মাসুরা বেগম বলেন, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি আমার বিয়ে হবে। সংসার হবে, আমি মা হব। বিয়ের পরে ১০-১১ বছর ধরে সন্তান নেওয়ার জন্য চিকিৎসা শুরু করি। আমার স্বামীর কথা, আমি চেষ্টা করবো। টাকা, পয়সা খরচ করবো। যদি আল্লাহ আমাদের একটা সন্তান দেয়। চিকিৎসার এক পর্যায়ে ডাক্তারকে আমার স্বামী (মনিরুল) জিজ্ঞাসা করে, সন্তান নেওয়া যাবে কি না। ডাক্তার বলেছেন, সন্তান নেওয়া যাবে। তবে দীর্ঘদিন বেড রেস্টে (বিশ্রাম) থাকতে হবে মাসুরাকে। বেড রেস্টে থাকাকালীন আমার স্বামী আমার সব কাজ করে দিয়েছে। এমনকি এক গ্লাস পানিও ঢেলে খেতে দেয়নি।

তিনি আরও বলেন, আমার পেটে যখন বাচ্চার বয়স সাত মাস তখন আমাকে মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। তার পরে আমার মেয়ে সন্তান হয়। যেদিন আমার সিজার হবে সকাল ১০টায়। কিন্তু আমি ডাক্তার দেখে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই। ভয়তো পাওয়ারই কথা, আমি এমন (খর্বকায়) মানুষ। অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে কী হবে, না হবে তাই। আল্লাহর রহমতে কিছুই হয়নি। আমার মেয়ে মরিয়াম জন্ম নেয় ভালো মতোই।

খর্বকায় মা হয়ে কষ্টের কথা বলতে গিয়ে মাসুরা বেগম বলেন, আমার এলাকার মানুষও ভাবেনি যে আমার বিয়ে হবে। আমরা ছয় ভাইবোন। সবার মধ্যে আমি চার নম্বর। আমার মতো কোনো ভাইবোন হয়নি। আমি খাটো হওয়ার কারণে মানুষে নানান কথা বলে। তবে আমার স্বামী আমার সব সময় পাশে আছে। রাস্তাঘাটে মেয়েকে দেখিয়ে মানুষে জিজ্ঞাসা করে এটা কার বাচ্চা। আমি বলি আমার বাচ্চা। তারা বলে না, এটা আপনার বাচ্চা হতে পারে না। তখন আমার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে এটা কে? আমার মেয়ে বলে এটা আমার আম্মু। কেউ তো আল্লার উপর দিয়ে হাত খেলাতে পারবে না।

তিনি আরও বলেন, আমি মা। মা যে রকম, আমি সেই রকমই মা। মায়ের সঙ্গে সবার তুলনা হয় না। আমার বাচ্চাকে আমি ভালোবাসবো, শাসনও করবো। আমি এই রকম হয়েছি বলে সন্তানকে বেয়াদবি করতে দেব? দেব না। মেয়েকে আমি মনের মতো করে লেখাপড়া করাবো। আপনাদের সবারই সহযোগিতা চাই।

মাসুরা ও মনিরুল ইসলাম দম্পতির মেয়ে মরিয়াম ঢাকা পোস্টকে বলে, আমার আম্মুকে আমি ‘ময়না’ বলে ডাকি। আমার আম্মুকে অনেক ভালোবাসি। আমার আম্মু ভালো। আমার আম্মু সেরা মা। আমাকে অনেক ভালোবাসে।

স্বামী মনিরুল ইসলাম বলেন, আমি প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম মাসুরাকে। বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে প্রথমে রাজশাহী কোর্টে, তারপরে ঢাকা কোর্টে এবং শেষে বগুড়া কোর্টে গিয়ে বিয়ে করি। আমরা যখন মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাই তখন মানুষ অনেক হাসা হাসি করে। তখন খারপ লাগে।

রামেক হাসপাতালের গাইনি বিভাগের চিকিৎসক বলেন, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে খর্বকায় নারী মাসুরা। তার সিজারিয়ানের মাধ্যমে কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছে। সর্বোচ্চ দিয়ে মাসুরার মেডিকেল সাপোর্ট দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষাও বিনামূল্যে করা হয়।

প্রতিবেশী নাহিদা বেগম বলেন, মাসুরা বেগম, মনিরুল ইসলাম ও তাদের মেয়ে মরিয়াম খাতুনের মধ্যে অনেক মিল। তারা একে অপরকে ‘ময়না’ বলে ডাকে। তারা কেউ কারো নাম ধরে ডাকে না। অনেকেই মাসুরাকে দেখে কটু কথা বলে। কিন্তু তারা কোনো পাত্তা দেয় না। তারা নিজেদের সংসার জীবনে অনেক ভালো আছে। মেয়েটা স্কুলে পড়াশোনা করে।

পবার উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সায়েদ আলী মোর্শেদ বলেন, শুনেছি তিনি এশিয়ার ক্ষুদ্র মানুষ। তিনি ক্ষুদ্র মা। তার একটা মেয়ে রয়েছে। তিনি যে শারিরিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে মা হয়েছেন এটাই অনেক। আমরা প্রত্যাশা করি, মাসুরা স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে থাকুক। আমি মাসুরাকে নিজ অর্থায়নে দোকান করে দেওয়ার কথা বলেছি। অতি দ্রুতই দোকান করে দেব।

পবা উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা (ভূমি) অভিজিৎ সরকার বলেন, মাসুরা মা হিসেবে সফল। পৃথিবীতে মা হওয়া সবচেয়ে কষ্টের। তিনি শারিরিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও মা হয়েছেন। তিনি ও তার মেয়ে সুস্থ রয়েছেন এখন পর্যন্ত। মা দিবস উপলক্ষ্যে উপজেলায় অনুষ্ঠান হবে। সবচেয়ে ক্ষুদ্র মা ক্যাটাগরিতে তাকে সংর্বধনা দেওয়া হবে। আমরাও তাকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে কাজ করছি। সূত্র- ঢাকা পোস্ট

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে