রাজশাহী বাতিঘরে বাতি জ্বালালেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ
নিজস্ব প্রতিবেদক : সব অতিথিরা এসে বসে আছেন। অনুষ্ঠানের উদ্বোধক শুধু আসেননি। ঘড়িতে তখন বিকেল ৫টা বেজে ২৪ মিনিট। বিদ্যুৎ চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে প্রথম সারির তিনজন অতিথি উঠে বাইরে গেলেন। এক মিনিটের মাথায় উদ্বোধক বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে সঙ্গে নিয়ে তারা ভেতরে ফিরলেন। সঙ্গে সঙ্গে আলোও জ্বলে উঠল। তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি এটা পরিকল্পিত কি না। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক রহমান রাজু বলে উঠলেন সায়ীদ স্যার রাজশাহী বাতিঘরের বাতি জ্বাললেন।
আজ শনিবার বিকেলে বই বিক্রেতা ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘বাতিঘর’ এর রাজশাহীর আউটলেটের উদ্বোধন উপলক্ষে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। কথা বলতে উঠে রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার আনিসুর রহমান বললেন, ‘আমি স্যারের (আবু সায়ীদ) ছাত্র ছিলাম। ৯১-৯২ সালের দিকে তিনি ঢাকা কলেজে আমাদের হৈমন্তী পড়িয়েছিলেন।’ রাজশাহীর জেলা প্রশাসক মো. শামীম আহমেদ উঠে বললেন, ‘আমিও স্যারের ছাত্র ছিলাম।’ রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার জিএসএম জাফরউল্লাহ বললেন, ‘আমি নটরডেম কলেজের ছাত্র ছিলাম। চুরি করে ঢাকা কলেজে স্যারের ক্লাস শুনতে যেতাম।’
এরপর লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ উঠে বললেন, ‘রাজশাহীর পুলিশ কমিশনারকে স্যার ৯১-৯২ সালে হৈমন্তী পড়িয়েছেন। আমাকে পড়িয়েছেন ১৯৬৭-৬৮ সালে।’ এবার ঘরভর্তি দর্শকদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল। প্রশ্ন উঠল স্যারের বয়স নিয়ে। রাজশাহীর কবি ও কবিতার সংগঠন-কবিকুঞ্জের সভাপতি অধ্যাপক রুহুল আমিন প্রামাণিক উঠে বললেন, ‘অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বয়সের হিসাব আমি করব না। আমি তাঁর শতায়ুও কামনা করব না। তিনি শত জন্মের আয়ু নিয়ে এসেছেন। তাঁর কথা ও লেখা আমাদের চিরকাল জাগরিত করবে।’
এত কথার পরে কথা বলতে উঠে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বললেন, ‘অনুষ্ঠানের উপস্থাপক জাফর আহমদ (রাশেদ) সবাইকে অল্প কথায় বক্তব্য শেষ করতে বলছিলেন। এ জন্য আমি রাশেদকে দুঃখ প্রকাশ করতে বললাম। কারণ অল্প কথায় বলতে বলা তো অন্যায়। বক্তারা কি শুধু নিজের নাম বলে চলে আসবে। অন্তত সংক্ষেপে বলতে বলা উচিত।’ তাঁর কথায় সবাই হেসে উঠলেন। তিনি বেশ রসিয়ে বাংলাদেশের বই পড়ার আন্দোলনের গোড়ার কথা বললেন, তার মধ্যে কয়েক দফা হাসির রোল পড়েছে।
তিনি এবার বললেন, ‘বই থাকলে সভ্যতা থাকবে। আর বই না থাকলে সভ্যতাও থাকবে না। বই হচ্ছে রুচি। মানুষের সভ্যতার সৃষ্টি করেছে বই। যদি বই থাকে, তো সভ্যতা থাকবে। আর যদি বই চলে যায়, তাহলে সভ্যতা চলে যাবে পৃথিবী থেকে। আবার সেই জন্তু-জানোয়ারের সাথে বসবাসের যুগ আসবে একদিন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের ১৫ হাজার স্কুলে এখন বুক রিডিং প্রোগ্রাম চলছে। আর তিন মাস পরে এটা ৩০ হাজার হবে। প্রত্যেকটা স্কুলে বুক রিডিং প্রোগ্রাম থাকবে। ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির চেষ্টা সারা বাংলাদেশে করেছি। তারপর ভ্রাম্যমাণ বইমেলা এবং সেটাকেও এখন আমরা বড় করব আরও। প্রত্যেক জায়গায় বইমেলা হবে। এটা আমাদের করতে হবে।’
আলোকিত মানুষ গড়ার এই কারিগর বলেন, ‘আমাদের সমস্ত জাতির বই একটামাত্র মেলায় এসে জমা হয়। সেটা কোনটা? একুশের বইমেলা। এটা দিয়ে কি একটা জাতি চলতে পারে? একটা শহর, একটা গ্রাম চলতে পারে। একটা জাতির কি একটা জায়গায় মেলা দিয়ে চলতে পারে? চলতে পারে না। প্রত্যেক জায়গায় মেলা হতে হবে। গভমেন্ট একটা চেষ্টা মাঝেমধ্যে করে, কিন্তু সাকসেসফুল হয় না। কারণ, পাবলিশাররা আসতে পারেন না এত দূরে এত টাকা খরচ করে। এটা সম্ভব হয় না। ঢাকার বাইরে বইমেলা করে টাকা ওঠে না।’
স্কুলে স্কুলে বইপড়া কমে যাওয়ার কথা বলতে গিয়ে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘এরশাদ সরকার আসার পরে একটা কমিটি গঠিত হলো। কর্নেল এনাম কমিটি। সেই কমিটি এসে কি করল? মানে আমাদের শেষপর্যন্ত যা আশা-ভরাস ছিল, উনি সেটাকে শেষ করে দিলেন। উনি দেশের সমস্ত স্কুল থেকে লাইব্রেরিয়ানের পদ বিলুপ্ত করে দিলেন। এখন স্কুলে আর বই নাই। স্কুলে বই নাই মানে কি? ছাত্রের কাছে বই নাই মানে কি? সারা জাতির কাছে বই নাই।
তারপরও ছেলেপেলেরা যেন বই কাকে বলে তা চোখে দেখতে না পারে সেই জন্য বইগুলোকে সব ঢোকানো হলো কাঠের আলমারির মধ্যে। লোহা-কাঠের আলমারি এবং সামনে বাজারের সবচেয়ে ভয়াবহতম তালা এনে লাগানো হলো। স্কুলের মধ্যে যে শিক্ষক সবচেয়ে ভয়াবহ দর্শন, যাকে দেখলে ছাত্ররা দৌড় দেয় তাকে লাইব্রেরিয়ানের ভারপ্রাপ্ত করা হলো। বই দেওয়া হবে না, কিন্তু বইগুলোকে তো রাখতে হবে।’
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘এরপর আস্তে আস্তে লাইব্রেরি শেষ হয়ে গেল। শিক্ষা আরও নিচের দিকে নামলো। তখন আমরা এই এরশাদ আমলের শেষদিকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র করার কথা চিন্তা করলাম, যেহেতু একটা জাতি বইহীন হয়ে গেছে। এখন এই জাতির মধ্যে বই আনতে হবে। ব্রিটিশরা যে রকম আমাদের চা ধরিয়েছিল। আমরা তেমনি এই জাতিকে বই ধরাব। দেখা যাক, যেমন করে পারি বই আনব।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন না ৭ মার্চের ভাষণে? ভাষণের সময় আমি ঠিক বঙ্গবন্ধুর থেকে ৩০ হাত দূরে ছিলাম। আমি ওই তেজ দেখেছি। মাইক্রোফোন শুনেও বোঝা যায় না। আর ভিডিওতেও বোঝা যায় না। উনি বলেছিলেন যে “যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।” আমরা ঠিক করলাম যে যত দিক থেকে পারা যায় এই জাতির হাতে বই নিয়ে যেতে হবে আমাদের। কারণ বই হচ্ছে পরিশীলন।’
কথা বলতে বলতে তিনি বললেন, ‘আসল কাজই তো করা হয়নি। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন? এবার আমি রাজশাহী বাতিঘরের উদ্বোধন ঘোষণা করলাম।’ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আরও বক্তব্য রাখেন অর্থনীতিবিদ ও রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহা।
অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ঘোষণা দিলেন সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করতে শিক্ষানগরী রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার পেছনে খানসামার চকে এই আউটলেট করা সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। বছরের ঈদের একদিন শুধু বন্ধ থাকবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কবি-সাহিত্যিকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। হাজির হয়েছিলেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও। কথা বলেন, উপস্থিত ছিলেন বাতিঘরের স্বত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাস। অনুষ্ঠানে খালি গলায় একটি মাত্র গান আকাশ ভরা সূর্য তারা পরিবেশন করেন আনন্দময়ী মজুমদার।