রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়িতে একদিন
ইন্দ্রাণী সান্যাল : বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য খুবই সমৃদ্ধ। এখানে যুগে যুগে কালে কালে পদধূলি দিয়েছেন কত মনীষী। তাঁদের পদধূলিতে যেমন বাংলাদেশের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে, তেমনি আমরা পেয়েছি ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার সৃষ্টি।
শিলাইদহ কুঠিবাড়ি রবীন্দ্রস্মৃতি-বিজড়িত একটি ঐতিহাসিক স্থান ও পর্যটনকেন্দ্র। বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলাধীন পদ্মার দক্ষিণ তীরে সদর থেকে পাঁচ মাইল উত্তরে গড়াই নদী পেরিয়ে এবং আরও উত্তরে পদ্মা নদীর অপর পাড়ে এর অবস্থান। বিরাহিমপুর জমিদারির সদর কাচারি ও জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের ঐতিহাসিক কুঠিবাড়ির জন্য শিলাইদহ বিখ্যাত।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জমিদারির দাপ্তরিক কাজ পরিচালনা করতেই এখানে এসেছিলেন। এরপর থেকেছেন বহুদিন। কুষ্টিয়ার মাটি এবং নদীর প্রতি কবির মমতার কথা ফুটে উঠেছে তাঁর বহু সৃষ্টিতে। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়ি এখনো বহন করে চলেছে কবিগুরুর বহু স্মৃতি।
শিলাইদহ কুঠিবাড়ি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী ইউনিয়নে অবস্থিত। দোতলা এই বাড়ির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, একসময় এর দোতলার বারান্দায় বসলে একদিকে পদ্মা, অন্যদিকে গড়াই নদী দেখা যেত।
ধারণা করা হয়, কবিগুরুর বিখ্যাত কবিতা ছোট নদী কুষ্টিয়ার গড়াই নদীকে কেন্দ্র করে লেখা। কেউ যদি কখনো কুষ্টিয়ায় বেড়াতে যায়, তাহলে এই নদী দেখলে তারও সেই কথায় মনে হবে-
‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’
শিলাইদহ কুঠিবাড়িটি চিরসবুজ বৃক্ষের বাগান, একটি পুষ্পোদ্যান এবং দুটি পুকুরসহ প্রায় ১১ একর মনোরম এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। শিলাইদহে রয়েছে গ্রামীণ পরিবেশ আর মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
কুঠিবাড়ি ভবনটি একটি বেষ্টনী প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। দক্ষিণ দিকে অবস্থিত একটি সাধারণ অথচ আকর্ষণীয় প্রবেশ তোরণ পেরিয়ে এতে প্রবেশ করা যায়। নিচতলা ও দোতলায় বিশাল কেন্দ্রীয় হলকক্ষসহ এতে বিভিন্ন আকারের মোট ১৫টি কক্ষ রয়েছে।
নিচতলা ও দোতলার উন্মুক্ত ব্যালকনিগুলি রানীগঞ্জ টালি দিয়ে তৈরি। নিচতলার উপরের মধ্যবর্তী অংশে রয়েছে ত্রিকোণ প্রান্ত বিশিষ্ট একটি ঢালু ছাদ। দোতলার ওপরের পিরামিড আকৃতির ছাদ ভবনটিকে আরও বৈচিত্র্য এনে দিয়েছে।
বিশাল আয়তন এই বাড়ির মধ্যে দোতলা ভবনের পাশে আছে একটি বিশাল দীঘি। পুরো বাড়ির আঙিনাজুড়ে আছে অনেক গাছ। এই গাছগুলোর গঠন তাদের বয়সের সাক্ষী দিচ্ছে।
এক একটা বৃক্ষ যেন দাঁড়িয়ে আছে এক একজন জাতিস্মরের ভূমিকায়। এই গাছগুলোর মধ্যে আম ও পাইনের সংখ্যাই বেশি। পাশাপাশি আছে কাঁঠাল, নিম কাঠবাদামসহ আরও অনেক প্রজাতির গাছ।
দীঘির দুই পাড়ে আছে দুটো শান বাঁধানো ঘাট। সেখানে বসে যে কেই বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারবেন। অনেকেই এই শানের ওপর শুয়ে তার শীতল পরশে শরীরের ক্লান্তি জুড়িয়ে নেন। আর দামাল ছেলেরা দল বেঁধে লাফিয়ে নেমে পড়ে স্নান করতে। আরও আছে প্রায় লুপ্ত হওয়া একটা পাতকুয়া।
দোতলা ভবনের বিভিন্ন কক্ষে রাখা আছে কবিগুরুর ব্যবহৃত বিভিন্ন আসবাব। আছে ইতিহাসের সাক্ষী অনেক আলোকচিত্র। পালকি, সিন্দুক, খাটের পাশাপাশি আছে কবিগুরু ব্যবহৃত বজরা।
এগুলো দেখলে মনে হবে আপনি যেন আজ থেকে শত বছর আগে কবিগুরুর সময়ে চলে গেছেন। যেখানে কবি বাড়ির মেয়েরা পালকিতে করে নৌকা থেকে এই কুঠিবাড়িতে এসে নামছে।
সিন্দুকে রাখা আছে তাঁদের ব্যবহৃত তৈজসাদি। আর কবিগুরু খাটে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। কখনো বা বজরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন পদ্মার বুকে।
১৮০৭ সালে রামলোচন ঠাকুরের উইলসূত্রে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর এ জমিদারির মালিক হন। রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে প্রথম শিলাইদহে আসেন ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে।
জমিদারির দেখাশোনা করতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৈশোরে এবং তার পরবর্তীকালেও মাঝে মাঝে এখানে আসতেন এবং এই কুঠিবাড়িতেই থাকতেন।
তবে পরবর্তীকালে বন্যার সময় পদ্মার ভাঙ্গনে পুরানো কুঠিবাড়ির নিকটবর্তী এলাকা পর্যন্ত বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে এই পুরানো কুঠিবাড়িটি ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং পুরানো ভবন সামগ্রী দিয়েই নতুন কুঠিবাড়িটি নির্মাণ করা হয়।
১৮৯১ থেকে ১৯০১ সালের মধ্যে একদশকেরও বেশি সময় রবীন্দ্রনাথ অনিয়মিত বিরতিতে এখানে অবস্থান করেছেন।
বর্তমানে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি সংরক্ষিত একটি জাতীয় ইমারত। সরকারি উদ্যোগে এখানে ‘ঠাকুর স্মৃতি জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভ্রমণপিপাসু যে কারও কাছে কুঠিবাড়িটি এক আরাধ্য বস্তু। কুঠিবাড়ির দেয়াল থেকে শুরু করে সবকিছুই আপনার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করবে।