কালের সাক্ষী ঐতিহাসিক লালবাগ কেল্লা
আদিবা বাসারাত তিমা : বাংলাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের এক অনন্য সুন্দর স্থাপত্য লালবাগ কেল্লা। লালবাগ কেল্লা ঢাকার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। এটি রাজধানী ঢাকার দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বংশাল থানার লালবাগ নামক জায়গায় অবস্থিত।
লালবাগ কেল্লার প্রাচীন নাম ছিলো ‘কিল্লা আওরঙ্গবাদ’। সেদিন লালবাগ কেল্লা দেখার জন্য রওনা হলাম মিরপুর থেকে। মিরপুর ১০ গোলচত্বর থেকে বাসে উঠে সোজা চলে গেলাম নিউ মার্কেট।
নিউ মার্কেট থেকে রিক্সাযোগে চলে গেলাম লালবাগ কেল্লার গেটে। প্রবেশ পথেই দেখলাম টিকেট কাউন্টারে লম্বা ভির লেগে আছে। ভিড় ঠেলে টিকেট কেটে প্রবেশ করলাম লালবাগ কেল্লায়। প্রতি টিকিটের মূল্য ১০ টাকা। ভিতরে ঢুকেই লক্ষ্য করলাম প্রচন্ড ভীর।
তবে এখানে আসা দর্শনার্থীদের বেশির ভাগই তরুণ-তরুণী। দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য জানতে এখানে ঘুরতে এসেছে দেখে ভালো লাগলো। আমিও আপন মনে ঘুরছি আর ছবি তুলছি।
লালবাগ কেল্লায় ঢোকার পরেই লক্ষ্য করলাম সরু রাস্তার দুইপাশে নানান রকম ঝাউগাছ আর পাতাবাহারের সারি। গোলাপ, গাদা, রঙ্গনসহ রয়েছে আরও নানান রকম ফুলের গাছ।
জানা যায়, মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর তৃতীয় পুত্র যুবরাজ আজম শাহ বাংলার সুবেদার হয়ে ১৬৭৮ সালে ঢাকায় আসেন এবং তিনি কিল্লা আওরাঙ্গবাদ নামে একটি প্রাসাদ দুর্গ নির্মাণের কাজ হাতে নেয়।
কিন্তু তিনি এই দুর্গটি নির্মাণের কাজ শেষ করতে পারেনি। কারণ মারাঠাদের মোকাবেলার জন্য সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লী ডেকে পাঠান। ফলে তিনি দুর্গটির নির্মাণ কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই ঢাকা ত্যাগ করেন।
পরে ১৬৮০ সালে শায়েস্তা খান দ্বিতীয়বার বাংলার সুবেদার হয়ে ঢাকায় আসেন এবং তিনি কিল্লা আওরাঙ্গবাদের কাজটি পুনরায় শুরু করেন। তখন তিনি এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন লালবাগ কেল্লা।
কিন্তু এই কেল্লাটির কাজ শেষ না করতেই সুবেদার শায়েস্তা খানের প্রিয় কন্যা পরিবিবি মারা যায় এবং তাকে সেখানেই সমাধি করা হয়। আর এজন্য তিনিও এই কাজ শেষ করতে পারেনি।
লালবাগ কেল্লাটি দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। এর আয়তন ১৯ একর। লালবাগ কেল্লার যে ছবিটি বেশী ব্যবহৃত হয় তা পরীবিবির সমাধি। এটি চতুষ্কোণ আকৃতির। বিশাল আকৃতির তিনটি দরজা আছে।
এর ভিতর একটি দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত। পরীবিবির সমাধীকে অনেকে আবার পরীবিবির মাজার বলে। এর ভিতর নয়টি কক্ষ আছে।
ভিতরে একটি গম্বুজ আছে যা আগে সোনার ছিলো, এখন তা তামা দিয়ে মোড়ানো। এছাড়াও দুর্গটির ভিতরে একটি বিশাল পুকুর আছে। যা এখন পানি শূন্য।
এখানে ঘুরতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আনিকার সাথে কথা বললে তিনি জানান, এখানে এসেছি মোঘল স্থাপত্যরীতির ইতিহাস জানতে। এসে ভালোই লাগলো।
আমার মতো অনেকেই এখানে ঘুরতে এসেছে। আমি এখানে কয়েকবার এসেছি। তবে আজ এখানে একটু বেশি ভিড় লক্ষ্য করলাম।
রাজশাহী থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা আশরাফুল মিয়া নামের এক দর্শনার্থী জানান, আমি ভ্রমণপিপাসু মানুষ। সুযোগ পেলেই বের হয়ে যাই ঘুরতে।
তবে লালবাগ কেল্লায় আজই প্রথম আসা। মোঘল স্থাপত্য যে এতো সুন্দর আজ জানলাম। এর আগে কখনও একই স্থাপনায় এতো কারুকার্যের ব্যবহার লক্ষ্য করিনি।
লালবাগ কেল্লার টিকিট মাস্টার জানান, প্রতিদিন প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার লোক আসে এখানে ঘুরতে। বিশেষ বিশেষ দিনে এর সংখ্যা ছাড়ায় ১৪ থেকে ১৫ হাজারে।
লালবাগ কেল্লায় ব্যবহার করা হয়েছে কষ্টিপাথর, মার্বেল পাথর আর নানান রঙ-বেরঙের টালি। লালবাগ কেল্লা ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো মোঘল ঐতিহাসিক নিদর্শনে এমন বৈচিত্র্যময় সংমিশ্রণ পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত।
লালবাগ কেল্লার শায়েস্তা খাঁর বাসভবন ও দরবার হল বর্তমানে লালবাগ কেল্লা জাদুঘর হিসেবে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। এই দরবার হল থেকেই তিনি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। জাদুঘরে অনেক কিছুই রয়েছে দেখার মতো।
মোঘল আমলের পাণ্ডুলিপি, মৃৎশিল্প, কার্পেট, হস্তলিপি ও রাজকীয় ফরমানসহ রয়েছে মোঘল আমলের বিভিন্ন সময়ের হাতে আকা ছবি যা আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
শায়েস্তা খাঁর ব্যবহার্য নানান জিনিসপত্রও সযত্নে রয়েছে সেখানে। এছাড়াও তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র, পোশাক, সে সময়কার প্রচলিত মুদ্রাও রয়েছে জাদুঘরে।
ইতিহাসের নানান ঘটনার সাক্ষী হয়ে এখনো ঢাকার কেন্দ্রস্থলে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের জানান দিচ্ছে এই লালবাগ কেল্লা।