হারিয়ে যাচ্ছে শৈশবের খেলনা লাটিম
আদিবা বাসারাত তিমা : শূন্যে ঘুরতে থাকে লাটিম। লাটিমের ঘূর্ণনে ঘোরে শিশুর চোখ, মাথা, পুরো শরীর। বাতাসে ঘোরা লাটিমের দিকে তীক্ষ্ণ নজর, ঘুরতে ঘুরতেই চলে আসে হাতের তালুতে। তালুতেও ঘুরতে থাকে রঙিন লাটিম। শৈশবও যেন ঘুরতে থাকে লাটিমের সাথে।
এক সময় শিশু-কিশোরদের জনপ্রিয় খেলাধুলার মধ্যে অন্যতম খেলা ছিল লাটিম। অথচ সময়ের সাথে সাথে অন্যান্য গ্রামীণ খেলাধুলার পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী লাটিম খেলাটি যেন আজ সময়ের পথপরিক্রমায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
গ্রাম কিংবা শহর সব জায়গায় প্রচলন ছিল এই লাটিম খেলার। সকাল, বিকেল খেলার মাঠে বা বাড়ির উঠানে দড়ি পেঁচিয়ে লাটিম ঘোরাতে দুরন্তপনায় মেতে থাকতো একদল কিশোর।
তাদের সময় ভিডিও গেমের চাহিদা ছিল না। ছিল না পাবজি কিংবা ফ্রি ফায়ার। তাদের শখ ছিল টাকা জমিয়ে অথবা বাবার কাছে বায়না ধরে লাটিম কিনবে। কারণ লাটিম ছিল তাদের কাছে নেশার মতো।
সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে সেই লাটিম। উঠানে কিংবা স্কুলের মাঠে দেখা যায় না কিশোরদের লাটিম খেলা। নতুন প্রজন্ম ব্যস্ত অনলাইন গেমসের নেশায়। লাটিম কিংবা অন্যান্য খেলাধুলার বাইরে স্মার্টফোন, ওয়াইফাইতেই আগ্রহ বেশি তাদের।
তবে লাটিম খেলায় ছিল ভিন্ন রকম আনন্দ। চাইলে একা যেমন খেলা যায় তেমনি দলগতভাবেও খেলা যায়। সবাই মিলে খেললে লাটিমে লাটিমে লাগে প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী খেলোয়াড় হেরে যাওয়া খেলোয়াড়ের লাটিমের মালিক হয়।
দুপুর গড়াতেই চোখে পড়তো তিন ধরনের লাটিম খেলা। এক. ‘ঘুরতি কোপ’। ঘুরতি কোপ খেলায় একজন ব্যক্তিকে চোর নির্ধারণ করা হবে এবং তার লাটিমটি ঘোরাতে বলা হবে।
নির্ধারিত সীমানার ভেতর ঘুরতে থাকা লাটিমটিকে অন্যান্য প্রতিযোগিরা নিজেদের লাটিম ঘুরিয়ে, কোপ মেরে সীমানার বাইরে আনতে পারলেই লাটিমটি তার হয়ে যাবে।
দুই. ‘ঘর কোপ’। ঘর কোপ খেলায় প্রতিযোগী সবার একটি করে লাটিম নির্দিষ্ট একটি সীমানা বা ঘরের ভেতর রাখা হবে। নিজেদের ঘুরতে থাকা লাটিমের আঘাতে যে যতটি পারে লাটিম বাইরে আনতে পারবে এবং সবগুলো তার হয়ে যাবে।
তিন. ‘বেল্লা পার’। বেল্লা পার খেলায় প্রতিযোগী সবাই নিজেদের লাটিম একসাঙ্গে ঘোরাতে থাকবে। যার লাটিম পরাজিত হবে, তার লাটিমটিকে দাগ কেটে একটি গণ্ডিতে আটকে রাখা হবে। তারপর স্বাধীনভাবে অন্যরা লাটিম ঘুরিয়ে যদি গণ্ডি থেকে লাটিমটি বের করতে পারে, তাহলে সেটি তার হয়ে যাবে।
সচরাচর কাঠমিস্ত্রিরা লাটিম বানিয়ে বিক্রি করতেন। সাধারণত পেয়ারা ও গাব গাছের ডাল দিয়ে এ লাটিম তৈরি করা হতো। তবে এখন আর বাজারে লাটিমের বিক্রিও তেমন নেই। এই লাটিম বর্তমান বাজারে খুঁজে পেতেও কষ্ট হয়।
দিন বদলেছে। বইপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ লাটিম খেলার ছবি। কয়েক বছর আগেও লাটিম ছিল মানুষের খেলার অন্যতম সামগ্রী। তবে গ্রামীণ মেলা বা মফস্বল বাজারে দেখা মেলে এই রংবেরঙের লাটিমের। যা দেখলেই ফিরতে মন চাইবে শৈশবে।
বর্তমানে ঘরবন্দি জীবন আর স্মার্টফোনই শিশু-কিশোরদের কাছে সব। আর এভাবেই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে শৈশবের খেলা লাটিম।
গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ও দেশীয় সংস্কৃতি ধরে রাখতে হলে শিশু-কিশোরদের উদ্বূদ্ধ করতে হবে এসব খেলাধুলার প্রতি। তা না হলে এক সময় বিলীন হয়ে যাবে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সব খেলা।