পানি সংকটে নানা সমস্যায় ভুগছেন উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের নারীরা

প্রকাশিত: জুলাই ২২, ২০২৩; সময়: ৪:১২ অপরাহ্ণ |
পানি সংকটে নানা সমস্যায় ভুগছেন উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের নারীরা

সবনাজ মোস্তারী স্মৃতি : বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমের অঞ্চল প্রাচীন পুন্ড্র রাজ্যের অন্তর্গত এই এলাকা হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে।

প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারের এই অঞ্চল অবস্থানগত কারণে তুলনামূলক উচু, বৃষ্টিপাত কম, অধিক তাপমাত্রা প্রবণ।

পুরো কাঁদামাটির উপস্থিতির কারণে ভূগর্ভে সহজেই পানি প্রবেশ করতে পারে না। এলাকার জনগণ প্রতিনিয়ত পানি সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

গত দুই দশক ধরে অতিরিক্ত বোরো ধান চাষের ফলে বরেন্দ্র এলাকায় পানি সংকট দেখা দিয়েছে।খরা ও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব পড়েছে এই অঞ্চলের মানুষের উপর।

বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত নারী ও আদিবাসি জনগোষ্ঠী। পানি নেই, তো কাজ নেই।কাজের জন্য তারা স্থানান্তরিত হচ্ছে।রয়েছে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীও প্রতিবন্ধকতা।

এলাকাবাসী বলেন, আমাদের গ্রামে কোনো নলকূপ নেই। নলকূপ না থাকার কারণে অনেক দূর থেকে পানি নিয়ে আসতে হয়। পানি নিয়ে আসতে গিয়ে অনেক ক্লান্তি হয়। কষ্ট হয়।

পানি না থাকার কারণে মাঝে মধ্যে পুকুরের পানি খেতে হয়।পুকুরের পানি খাওয়ার ফলে আমাদের পরিবারে লোকেরা অসুস্থ হয়ে পড়ে।

স্ত্রী আয়শো বেগম (২৪) কোলে শিশু কন্যা নিতু খাতুন, আরেক কাঁধে খাবার পানির ভার। এক কিলোমিটার দূর থেকে পানি কিনে আনছেন কখনো বা দূরের কোনো গ্রাম থেকে কলসে করে পায়ে হেঁটে পানি আনছেন গ্রামের আলপথ বেয়ে। আর এভাবেই পানি নিয়ে বাড়ি ফিরতে দেখা যায় বরেন্দ্র অঞ্চলের অধিকাংশ নারীদের।

শুধু আয়েশা খাতুন নয়, এই অঞ্চলের আরেক নারী হেতি সরেন(২৫)। দূর থেকে ভারি কলসে পানি নিয়ে আসার কারণে চার মাসের গর্ভপাত হয় এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। পরবর্তী আর গর্ভধারণ করতে পারেন না।

এতে সংসারে অশান্তি লেগেই থাকে। অন্যদিকে তেরেসা টুডুর (৩০) একই অবস্থা।সংসারে কাজ এবং দূর থেকে পানি নিয়ে আসার কাজ করতে গিয়ে গর্ভপাতের শিকার হন।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খরা প্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিম্নগামী।ফলে টিউবওয়েলগুলো দিয়ে পানি উঠছে না এই বিশাল এলাকায়। খাবার পানি না পাবার কারণে গ্রামের নারীদের পরিবারের অন্নান্য কাজের পাশাপাশি দূর থেকে পানি নিয়ে আসাও অন্যতম কাজের মাঝে পড়ছে।

আর নারীরা পানি সংগ্রহ এবং পারিবারিক কাজে পানির ব্যবহার নিয়ে আরও বেশি সংকটে পড়েন। পানির কারণে নারীরা পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন। পানির সংকট হওয়া এলাকায় সামাজিক সংঘাতও বাড়ে।

অন্যদিকে কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে পানি আনার সমস্যায় নারীরা কম পানি পান করে থাকেন। পর্যাপ্ত পরিমানে পানি পান না করার কারণে পানিশূন্যতা, গর্ভপাত ও ইউরিনসহ বিভিন্ন প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলছে।

এক জরিপে এই অঞ্চলের পাঁচটি ইউনিয়নে দেড় হাজার ফুট মাটির নিচেও পানির সন্ধান মেলেনি। সরকারি প্রতিষ্ঠান পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো) এই জরিপ চালিয়েছিল।

জানতে চাইলে ওয়ারপো মহাপরিচালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলায় এই জরিপ চালানো হয়েছে। জরিপের কাজ হচ্ছে পানি আহরণযোগ্য সীমা নির্ধারণ করা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ মাটির গঠনের কারণে ভূগর্ভে পানি রিচার্জ ঠিকমতো হচ্ছে না। কিন্তু সেচসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য ক্রমাগত ভূগর্ভের পানি ওঠানো হচ্ছে।

এই কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাচ্ছে। এটার সমাধানের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার কমিয়ে ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহারের দিকে আমাদের মনোযোগী হতে হবে।

সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের গবেষকেরা দেখেছেন, বোরো ধানের মৌসুমে যান্ত্রিক ত্রুটি কিংবা বিদ্যুতের গোলযোগ না হলে সব সময়ই বরেন্দ্র অঞ্চলে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ চলে।

এর ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিনিয়ত নিচে নেমে যায়। প্রতিবছর যে পরিমাণ পানি নিচে নেমে যাচ্ছে, তা আর পুনর্ভরণ হচ্ছে না।

গত বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হাইড্রোলজিক্যাল মডেলিংয়ের মাধ্যমে উত্তর পশ্চিমের অঞ্চলের ৫০টি স্থানে প্রায় দেড় হাজার ফুট পর্যন্ত গভীরে যায়। এতে উত্তর পশ্চিমের অঞ্চলের মোট পাঁচটি স্থানে পানির স্তরই পাওয়া যায়নি।

সাধারণত ১৫০ থেকে ২০০ ফুট মাটির গভীরে পানির স্তর পাওয়ার কথা। কিন্তু উঁচু বরেন্দ্র এলাকার কয়েকটি জায়গায় তা পাওয়া যায়নি। তবে এই এলাকাগুলোর আশপাশে ছোট ছোট পকেট স্তর পাওয়া গেছে।

সেখানে থেকে এখনো খাবার ও সেচের জন্য পানি তোলা হচ্ছে। আর যে এলাকায় পকেট স্তরে পানি নেই, সেখানকার মানুষকে অন্তত এক কিলোমিটার দূর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।

পানি নিয়ে নারীদের পারিবারিক জীবনের সংকটের অন্যতম কারণ বরেন্দ্র এলাকার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নারীবান্ধব নয়।

কেননা, বেশির ভাগ পানির সরবরাহ লাইন কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছে, যা ঘরবাড়ি থেকে বেশ দূরে। ফলে তার ব্যবহার স্বাভাবিকভাবেই পুরুষেরা বেশি করেন। নারীরা গৃহে অবস্থানের কারণেই ওই পানির সুবিধা পান না।

নারীরা পানি সংগ্রহ করতে যাচ্ছেন এতে তাদের বাড়তি পরিশ্রম হচ্ছে। পরিবারে তাঁদের দেওয়া সময়ের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে পানি আনতে গিয়ে অন্য নারীদের সঙ্গে তাঁদের সংঘাত তৈরি হচ্ছে।

রান্না করতে দেরি হওয়া, গোসল ও টয়লেটের পানি সরবরাহে দেরি হওয়াসহ নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। পরিবারের মধ্যেও পানির এই সংকট নারীর ওপর সহিংসতার পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

চিকিৎকেরা বলছেন, দীর্ঘদিন পর্যাপ্ত পরিমানে পানি না খেলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। কিডনি ও লিভারে দেখা দেয় একাধিক রোগ।

এছাড়াও পানি কম খেলে স্মৃতিবিলোপ ও মস্তিষেকর রোগ, মাথা ব্যাথা, কোষ্ঠকাঠিন্য, পাইলস, শারীরিক শক্তির মাত্রা হ্রাস পাওয়া, বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ, এমনকি প্রজনন স্বাস্থ্যের সমস্যা হতে পারে।

তাই চিসিৎকেরা সবাইকে পর্যাপ্ত পরিমানে পানি খেতে বলছেন। তারা বলছেন, পুরুষের কমপক্ষে দৈনিক ১০-১২ গ্লাস এবং নারীদের ৮-১০ গ্লাস পানি খাওয়া উচিত। আর বরেন্দ্র অঞ্চলের নারীরা পানি কম পান করার কারণে এই সব রোগে বেশি ভুগছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের খনিজ পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক চৌধুরী সারোয়ার জাহান বলেন, ‘দিন দিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে, কারণ ভূগর্ভস্থ পানিতে সব মানুষের অধিকার থাকলেও অল্প কিছু লোক তা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে তুলে নিচ্ছে।’

তিনি জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রায় ২৩ বর্গকিলোমিটার এলাকার ঝিলিম ইউনিয়নে কমপক্ষে ৩৫টি অটো রাইস মিল আছে যেগুলো প্রতিনিয়ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করছে। এর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে মাটির নিচের পানির স্তরে।

তিনি আরও জানান, ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাত বছরে এই অঞ্চলের বার্ষিক বৃষ্টিপাত কখনও ১,৪০০ মিলিমিটার অতিক্রম করেনি, যা জাতীয় গড় ২,৫৫০ মিলিমিটার থেকে ৪৫ শতাংশ কম। গত বছর অবশ্য, এই অঞ্চলে ১৮০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল ও গোমস্তাপুর; রাজশাহীর তনোর ও গোদাগাড়ী; এবং নওগাঁর পোরশা, সাপাহার এবং নিয়ামতপুর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কমপক্ষে ৪৭ মিটার উঁচু।

তবে একই জেলাগুলোতে এমন কিছু অঞ্চল রয়েছে যেগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১০ মিটার উঁচু উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ধান চাষের জন্য কেবল ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার এই উঁচু ও শুকনো অঞ্চলে পানীয় জল দুষ্প্রাপ্য করে তুলতে পারে।’

বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ধান উত্পাদনকারী দেশ বাংলাদেশে সেচের জন্য যে পানি ব্যবহার হয় তার ৭৫ শতাংশই মাটির নিচ থেকে তোলা।

তার মতে, বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের জন্য ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করা উচিত। এছাড়া কম সেচ লাগে এমন ফল এবং সবজি চাষ এই অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি খাবার জন্য সংরক্ষণে সহায়তা করতে পারে।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ভূগর্ভস্থ পানি স্তর নাচোল উপজেলায় ভূপৃষ্ঠের ১০৭ ফুট নিচে রেকর্ড করা হয়েছিল যেটা ২০০৫ সালে ছিল ৭৮.৮ ফুট। মাত্র ১৩ বছরে এখানে পানির স্তর ২৮ ফুট নিচে নেমে গেছে।

তাই পানিকে অপচয় বা দূষণ না করে সঠিকভাবে পানি ব্যবহার করতে হবে এবং অন্যদেরও একই কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

 

 

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে