গোদাগাড়ীতে ভূমিদস্যু চেয়ারম্যানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ইউপিবাসী

প্রকাশিত: জুলাই ২৪, ২০২৩; সময়: ৪:৫৯ অপরাহ্ণ |
গোদাগাড়ীতে ভূমিদস্যু চেয়ারম্যানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ইউপিবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পাকড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জালাল উদ্দীনের নানা অপকর্মে অতিষ্ঠ এলাকার সাধারণ মানুষ। হামলা করে জমি দখল, ধান লুট, মামলা দিয়ে হয়রানি ও অর্থ আদায়সহ এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে ইউপি চেয়ারম্যান জালাল।

এমনকি আদালতের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়াও এক নারীর ২৮ বিঘা জমির প্রায় ৫৫০ মন ধান লুট করে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয় এই ভূমিদস্যু চেয়ারম্যান।

এলাকার জমি দখল করতে ভূমিদস্যূ সিন্ডিকেটসহ ক্যাডার বাহিনী গড়ে তুলেছেন তিনি। ফলে তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে সাহস পায়না। তার বিরুদ্ধে কথা বলে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেন এই ইউপি চেয়ারম্যান।

আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার কোন ইতিহাস না থাকলেও স্থানীয় এমপির মাধ্যমে নৌকার টিকিট বাগিয়ে ২০২১ সালে ১১ নভেম্বর পাকড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হন জালাল উদ্দীন। এর আগে তিনি ওই ইউপির ৬ নং ওয়ার্ডের সদস্য ছিলেন। জনপ্রতিনিধি ছাড়াও জালাল উদ্দীন ব্রাহ্মনগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক।

চেয়ারম্যান হওয়ার পর পরই জালাল উদ্দীনের নজর পড়ে পাকড়ী ইউনিয়নের হাজী মানিকুল্লাহ্ ওয়াক্ফ এস্টেটের জমির উপর। এই জমির দখল নিতে চেয়ারম্যান তার ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট ও ক্যাডার বাহিনী নিয়ে চারবার হামলা চালায় কৃষকদের উপর।

সর্বশেষ গত ১০ জুলাই জমি দখল করতে গিয়ে চেয়ারম্যানের ক্যাডার বাহিনী কৃষকদের উপর হামলা করে চারজনকে পিটিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় পৃথক দুইটি হত্যা মামলা হয়। যার একটিতে ইউপি চেয়ারম্যান জালাল উদ্দীনকে প্রধান আসামী করা হয়েছে।

চারটি ঘটনার মামলায় চেয়ারম্যান জালাল উদ্দীন আসামী হন। এর মধ্যে একটি মামলার তদন্ত শেষে চেয়ারম্যানসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এ মামলায় বেশকিছুদিন কারাগারে ছিলেন তিনি। বাকি মামলাগুলো এখন তদন্তাধীন।

জানা গেছে, পাকড়ী ইউনিয়নের ইয়াজপুর এলাকার হাজী মানিকুল্লাহ্ ওয়াক্ফ এস্টেটের মোতওয়াল্লী আসিকুল ইসলাম চাঁদে কাছ থেকে এস্টেটের ৫১ বিঘা সম্পত্তি লিজ নেয় ইউনিয়ন কৃষকলীগের সভাপতি আজাহার আলী। গত বছরের ২৭ জানুয়ারি নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ের মাধ্যমে তাদের মধ্যে লিজ চুক্তিনামা সাক্ষর হয়। লিজের মেয়াদ ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি বছর বিঘা প্রতি ছয় হাজার টাকা দিতে হবে আজাহার আলীকে। চুক্তি অনুযায়ী এক বছরের লিজের তিন লক্ষ ছয় হাজার টাকা পরিষদ করে।

আজাহার আলী বলেন, লিজ নেয়া জমি চাষ করে লোকজন নিয়ে গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ধান রোপন করতে যায়। এ সময় চেয়ারম্যান তার বাহিনী নিয়ে এসে আমার পিটিয়ে জখম করে এবং জমিগুলো দখল করে নেয়। পরে চেয়ারম্যান নিজে সেই জমিগুলোতে ধান রোপন করে। এ ঘটনায় চেয়ারম্যানসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ মামলা তদন্ত শেষে গত বছরের ৩০ এপ্রিল চেয়ারম্যানসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

তিনি বলেন, এর পর ওই জমির উপর ১৪৪ ধারা জারি করে আদালত। ওই জমিতে যেন নামতে না পারে এ জন্য আসিকুল ইসলাম চাঁদ, ইউপি চেয়ারম্যান জালাল উদ্দীন, তার সহযোগি রজব আলীসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারার আদেশ জারি হয়। কিন্তু তারা আদালতের আদেশ অমান্য করে গত বছরের ৫ মে ওই জমিতে ধান কাটতে এতে বাধা দিতে গেল আবারো আজাহারের লোকজনকে পিটিয়ে জখম করে চেয়ারম্যান বাহিনী। এ ঘটনায় চেয়ারম্যানসহ ৩১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।

আজাহার আলী আরও বলেন, মামলা দুটো তুলে নিতে চেয়ারম্যানের ক্যাডাররা গত ১৪ জুন আমার জামাতা স্থানীয় ইউপি সদস্য মফিজ উদ্দিনকে কুপিয়ে জখম করে। পরে এ ঘটনায় ১৭ জনকে আসামী করে আরেকটি মামলা করা হয়। এ ঘটনার পর থেকে আমরা আর ওই জমিতে যায়নি।

তিনি বলেন, আমার লিজ নেয়া জমিগুলো এখন চেয়ারম্যান নিজে ভোগ দখল করছে। আমার অপরাধ আমি ইউপি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলাম। আমি মনোনয়ন পায়নি। জালাল উদ্দীন পেয়েছে।

এদিকে, ইয়াজপুর গ্রামের মৃত মুক্তার আলীর স্ত্রী নাজরিন আক্তার জানান, গত বছর তার স্বামী মুক্তার আলী মাহাতাব হাজির ২৮ বিঘা জমি লিজ নিয়ে ধান চাষ করে। ধান পাকার আগে কোরনায় মারা যান মুক্তার। ধান পেকে গেলে আমি ধানা কাটার জন্য লোক লাগায়। এ সময় চেয়ারম্যান ও তার লোকজন ধান কাটতে বাধা দেয়। মুক্তার আলীর কাছে অনেকেই টাকা পাবে এ কথা বলে চেয়ারম্যান তার লোকজন দিয়ে ধান কেটে নিয়ে ইউপি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। পরে সেখানে ধানা মাড়াই করে সব বিক্রি করে দেয় চেয়ারম্যান।

নাজরিন বলেন, আমার ধান লুট করে নিয়ে গিয়ে চেয়ারম্যান সাড়ে পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেয়। ওই ধানের আবাদ করতে আমার দুই লাখ টাকার বেশী খরচ হয়েছে। কিন্তু আমাকে এক টাকাও দেয়নি। সব টাকা চেয়ারম্যান আত্মসাত করেছে। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাকে গালাগালিজ ও মামলায় জড়ানো হুমকি দেয়।

অপরদিকে, গোদাগাড়ী পৌরসভা এলাকার মাদারপুর মহল্লঅর নওশাদ আলীর প্রায় কোটি টাকা মূল্যের ৮ বিঘা জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে পাকড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন ও তার ভুমিদস্যু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে থানায় একটি মামলাও হয়েছে। যা তদন্তাধীন।

নওশাদ আলী বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন ও তার নিয়ন্ত্রাধীন একটি শক্তিশারী ভুমিদস্যু সিন্ডিকেট রয়েছে। সম্প্রতি তার ছেলে আলমগীর হোসেন ও মেয়ে আয়েশা খাতুনের নামের ১০৮ নং বাশৈল মৌজার ১২৯ ও ৫৯ নং আরএস খতিয়ানভুক্ত ২২২, ২৭৯ ও ২৯৪ নং দাগের ২ দশমিক ৬৭ একর জমি ক্রয় করেন। জমিগুলির বাজার দাম প্রায় কোটি টাকা। বৈধ কাগজপত্র যাচাই শেষে জমিগুলির মুল মালিকদের কাছ থেকে রেজিষ্ট্রি করে যথারীতি খারিজ সম্পন্ন করে খাজনা পরিশোধ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, চাষাবাদের সুবিধার্থে সম্প্রতি তিনি জমিগুলির আইল সংস্কার করেন কয়েক লাখ টাকা খরচ করে। আমন আবাদের জন্য আমিরুল ইসলাম নামের একজনকে বর্গা দেওয়া হয়েছিল। আমিরুল জমিগুলিতে আমন রোপনের জন্য প্রস্তুত করছিলেন। এ সময় গত ২৬ জুন সকালে চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন ২০/২৫ জনের একটি দলসহ তিনটি ট্রাক্টর নিয়ে জমিতে যায়। তারা আইল ভেঙ্গে তছনছ করে জমিগুলো দখল করে নেয়। এ সময় বাধা দিতে গেলে চেয়ারম্যান নিজে সরাসরি প্রাণনাশের হুমকি দেয়।

নওশাদ আলী আরও জানান, জালাল চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে জমি দখলের সময় জমির মুল মালিক ও বিক্রেতারাও ঘটনাস্থলে গিয়ে কেন তাদের বিক্রয় করা এই জমি দখল নেওয়া হচ্ছে জানতে চান। এ সময় জালাল চেয়ারম্যান বলেন, এটা আমার এলাকা। এখানে বাহিরের কোন লোক জমি কিনে চাষাবাদ করতে পারবে না। আমি ওই জমির ওপর দিয়ে একটি রাস্তা বানাব। এমপি সাহেব আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন।

এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পাকড়ি ইউপি চেয়ারম্যান জালাল উদ্দীন বলেন, আমার বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ সত্য নয়। প্রতিপক্ষ আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

গোদাগাড়ী থানার ওসি কামরুল ইসলাম বলেন, পাকড়ি ইউপি চেয়ারম্যান জালাল উদ্দীনের বিরুদ্ধে জমি দখল ও এলাকায় ত্রাস সৃষ্টিসহ বিভিন্ন ঘটনার ৬/৭টি মামলা অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় তার বিরুদ্ধে চার্জসীট হয়েছে। বাকিগুলোর তদন্ত চলছে। দ্রুত তদন্ত শেষ করে ওই মামলাগুলোও চার্জসীট দেয়া হবে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে