উস্কানি না দিলে সংঘাত হবে না
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : একই সময়ে দুটি বড় রাজনৈতিক দলের সমাবেশের কারণে স্বাভাবিকভাবেই জনমনে আতঙ্ক কাজ করছে। আমার বিশ্বাস, কোনো ধরনের সংঘাত ও সংঘর্ষ ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে উভয় পক্ষের সমাবেশ শেষ হবে। যে পক্ষ সংঘাত সৃষ্টি করবে, তারা জনসমর্থন হারাবে। সাধারণ মানুষ সহিংসতা পছন্দ করে না। রাজনৈতিক সমাবেশ উন্মুক্ত স্থানে এবং ছুটির দিনেই হওয়া উচিত।
যখন বিএনপি সমাবেশ করছে, তখন আওয়ামী লীগ পাল্টা সমাবেশ করে তাদের অবস্থান, জনসমর্থন জানান দিতেই পারে। অতীতেও দেখা গেছে, একই দিনে একাধিক রাজনৈতিক দল কর্মসূচি পালন করেছে। এটি দোষের কিছু নয়। কয়েক দিন আগেও আজকের মতো সমাবেশ বিএনপি-আওয়ামী লীগ একই সময়ে করেছে। কই, সেখানে তো কোনো সংঘর্ষ হয়নি। চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, উস্কানি না থাকলে সংঘর্ষ বাধে না। পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করতে গেলে ঝগড়া তো হবেই। যদি কারও মাথায় সহিংসতার পরিকল্পনা থাকে, তাহলে সংঘাত অনিবার্য।
গণতান্ত্রিক সহনশীলতা থাকলে একই দিনে একাধিক দল বা জোটের সমাবেশ হতে পারে। আমার মত হচ্ছে, আগে-পরে করলে ভালো হয়। সভা-সমাবেশ সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সমাবেশের নামে সহিংসতার অধিকার কোনো দলের নেই। এটি জনগণ গ্রহণ করবে না। শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করতে হবে। জনমনে যে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, তা অবসানের দায়িত্ব সব রাজনৈতিক দলের। সরকারি দল, মাঠের বিরোধী দল সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে– তারা সন্ত্রাস-সহিংসতা করবে না। অতীতে বহুবার এমন অপ্রত্যাশিত কর্মকাণ্ড আমরা দেখেছি। একবিংশ শতাব্দীতে এসে চর দখলের মতো মারামারিতে জড়ানো হলে তা সবার জন্য লজ্জার। এমন আচরণ করে জনসমর্থন আদায় করা যায় না।
নির্বাচন যত কাছাকাছি আসবে, তত রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিবর্তন হবে। এরই মধ্যে বিদেশি প্রতিনিধি দলের সফর শুরু হয়েছে। তারা আসছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছে। এগুলো ভালো লক্ষণ। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, আলোচনার মাধ্যমেই যে কোনো সংকটের সমাধান সম্ভব। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধানের মধ্যে থেকেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। অন্যদিকে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। আমি মনে করি, সংবিধান অক্ষুণ্ন রেখেই অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব। বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের কেউ সফরে এসে বলেননি, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান। বরং তারা বলছেন, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চান। এটি শুধু আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির চাওয়া নয়। ১৭ কোটি মানুষের চাওয়া। আমাদের সংবিধানের মধ্যে থেকেই তা করা সম্ভব।
নির্বাচনকালীন সরকারের সময় নির্বাচন সংক্রান্ত ক্ষমতা থাকে নির্বাচন কমিশনের হাতে। নির্বাচনকালীন সরকারের আকার থাকে ছোট। তারা শুধু রুটিন দায়িত্ব পালন করে। নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত ওই সময় তারা নেয় না। সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকারের বাইরে থেকে নির্বাচন কমিশন পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও স্বাধীনভাবে কাজ করে। তাই অকারণে আতঙ্কিত না হয়ে সবার উচিত শান্তিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করা।
সংলাপে বসলে সমাধান বের হয়ে আসবে। সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানই পথ দেখাবে। আমাদের সংবিধানে সে রকম ধারা-উপধারা আছে। সংবিধান পরিবর্তন না করেই সমাধান বের করে আনা সম্ভব।
রাজনৈতিক মামলায় অতীতেও গ্রেপ্তার করতে দেখা গেছে। আমি মনে করি, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা উচিত নয়। তবে যদি কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে; আগের কোনো মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকে, তাহলে তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করবে– এটিই তো নিয়ম। এসব গ্রেপ্তারকে রাজনৈতিক রং লাগিয়ে দেখানো উচিত নয়। সব রাজনৈতিক দলকেই সতর্ক থাকতে হবে, যেন তৃতীয় পক্ষ নাশকতা করে অন্যদের ঘাড়ে দোষ চাপাতে না পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট তৎপর। নিরপেক্ষ থাকা প্রশাসনের নৈতিক দায়িত্ব। একই সঙ্গে জানমালের নিরাপত্তা বিধান করাও তাদের কর্তব্য। আশা করি, আগের মতোই এবারের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হবে। এর মাধ্যমে জনমনে সৃষ্ট আতঙ্ক কেটে যাবে। যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করবে, তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আমরা সব রাজনৈতিক দলের কাছে দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করছি।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির কারণে সরকার বিএনপিকে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে– এমনটি ভাবার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ভিসা নীতি সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে। বিএনপি গত ১৪ বছরে অনেক সভা-সমাবেশ করেছে। আগেও দেখেছি, অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার জন্য আবেদন করে পাননি। আবার কেউ কেউ পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র কাকে ভিসা দেবে বা কাকে দেবে না– এসব বিষয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া কোনো রাজনৈতিক দলের উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। এটি আমাদেরও চাওয়া। রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের বসে ঠিক করতে হবে কীভাবে সেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। বিদেশিদের কাছে গিয়ে নালিশ করা জনগণ পছন্দ করে না। বরং তারা দেখতে চায়, তাদের দল কী ভূমিকা নিচ্ছে।
প্রায় ২০০ বছর আমরা ব্রিটিশ দ্বারা শাসিত হয়েছি। ২৫ বছর পাকিস্তান আমাদের ওপর অপশাসন চালিয়েছে। এসব কারণে দাসত্বের মানসিকতা আমাদের মাথায় এখনও চেপে আছে। ফলে পান থেকে চুন খসলেই আমাদের দেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা বিদেশের কাছে নালিশ জানান। এর মাধ্যমে যে নিজেদের সক্রিয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে– এটা তারা বোঝেন কিনা জানি না। আমরা বিদেশি মন্ত্রী বিশেষ করে আমাদের দেশে নিযুক্ত তাদের রাষ্ট্রদূতদের যেভাবে অতি মূল্যায়ন করি, এটি আর কোথাও করা হয় না। আমি তাদের মূল্যায়ন করতে নিষেধ করছি না। অতি মূল্যায়ন করলে নিজের দেশের সার্বভৌমত্ব অসম্মানিত হয়। ভিয়েনা কনভেনশনে আছে– অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়।
বিদেশে আমাদের রাষ্ট্রদূতরা সেখানে সীমিত সুযোগ পান। সেসব দেশের সংবাদমাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্রদূতদের খবর রুটিন সংবাদ হিসেবে প্রকাশিত হয়। অথচ আমাদের দেশে বাইরের রাষ্ট্রদূতদের কার্যক্রম প্রধান সংবাদ হয়ে যায়। এ মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। বাঙালি অতিথিপরায়ণ। তাই বলে বিদেশিদের অযাচিত হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। এখানে সবার ওপরে নিজ দেশের নাগরিকের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। বিদেশিদের কাছে ধরনা দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক: প্রাক্তন উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়