পশ্চিম রেলে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ১১ কোটি টাকা লোপাট

প্রকাশিত: আগস্ট ১৭, ২০২৩; সময়: ১:৪৯ অপরাহ্ণ |
পশ্চিম রেলে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ১১ কোটি টাকা লোপাট

নিজস্ব প্রতিবেদক : উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যানারে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাটের চাঞ্চল্যকর কাণ্ড ঘটেছে বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয়ে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ রীতিমতো লুট করেছেন।

কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিট জেনারেলের অডিট প্রতিবেদনে অর্থ লোপাটের এমন চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে এহেন অপকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হয়েছে।

অডিট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অধীনে ঈশ্বরদী-ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণে প্রকল্পের পরিশোধিত বিল/ভাউচার পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে ২০১২-২৩ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চুক্তি সম্পাদনকালে এনবিআরের আদেশ মোতাবেক ৫.৫ শতাংশ এবং আয়কর পরিপত্র অনুযায়ী ৫ শতাংশ ভ্যাট কর্তন করা হয়। কিন্তু পরে ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এনবিআরের নির্দেশনায় ৬ শতাংশ ও আয়কর পরিপত্র অনুযায়ী পরিবর্তিত হারে ৭ শতাংশ কাটা হয়।

কিন্তু জিসিসি ক্লজের কথা উল্লেখ করে চুক্তিকালীন সময়ে নির্ধারিত ভ্যাট ও আয়কর সময় সময় পরিবর্তিত করে অতিরিক্ত হারে কর্তন দেখানো হয়েছে। যা পরে ঠিকাদারকে সম্পূরক চুক্তি সম্পাদন করে উক্ত অতিরিক্ত কর্তন হিসেবে দেখানো ভ্যাট ও আয়করের অর্থ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিল আকারে অনিয়মিতভাবে ফেরত প্রদান করা হয়েছে। এতে সরকারের ১১ কোটি ৮ লাখ ১৬ হাজার ৫৯৫ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। অথচ সরকারের রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত ভ্যাট ও আইটির অর্থ প্রকল্প পরিচালক কর্তৃক ফেরত প্রদানের কোনো সুযোগ নেই। তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক এই অনিয়ম করেছেন বলে অভিযোগ। এই টাকা আদায় করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমাদানেরও সুপারিশ করা হয়েছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিট জেনারেলের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ঢালারচর রেললাইন স্থাপন প্রকল্প শতভাগ সমাপ্ত দেখানোর পরও এখানে ইঞ্জিন ভাড়া ও ভ্যাটের ৫৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার-রেনকেনের কাছ থেকে আদায় করা হয়নি। এই প্রকল্পে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত সরঞ্জাম কেনাকাটা করে আরও ৫০ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। সাপ্লাই, ইনস্টলেশন অ্যান্ড কমিশনিং অব টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম কাজের জন্য ডব্লিউইডি-৮ প্যাকেজের আওতায় দুটি লটে অপটিক্যাল ফাইবার সরবরাহের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নূর-ই ইলাহীর সাথে আট কোটি ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকার চুক্তি করা হয়।

চুক্তির দুটি আইটেম নং ১ হতে দেখা যায় ঠিকাদার ৯০ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার সরবরাহ করেছেন। অথচ আইটেম নং ১৭ ও ২০ হতে দেখা যায় ৮৬ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার স্থপান করেছেন। নকশা অনুসারে দুটি লটে মোট ৭৮ দশমিক ১৩৮ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার থাকার কথা। জয়েনিং ও ওয়েস্টেজ বাদে ৭৯ কিলোমিটারের বেশি তার স্থাপন বাস্তবসম্মত নয়। ফলে মজুদে ১১ কিলোমিটার তার থাকবে। কিন্তু তার মজুদে নেই। এবং ৯০ কিলোমিটারের বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এভাবে বিল পরিশোধ করায় ৪৯ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭৭ টাকা লোপাট হয়েছে।

আরেকটি প্রকল্পে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেনাকাটা করে ৮০ লাখ ৪৬ হাজার টাকা লোপাট হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয়ের ঠিকাদারি কাজের চুক্তিপত্র ও বিল পর্যালোচনায় ধরা পড়ে, ১০০ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার ‘ট্র্যাক ডি-স্ট্রেসিং, শ্যালো স্ক্রিনিং অ্যান্ড মেকানাইজড মেইনটেন্যান্স’ কাজের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়। কিন্তু ‘টপ আপ সেস ফর অ্যারেস্ট শোল্ডার ব্যালাস্ট’ আইটেমগুলোতে ট্র্যাকের দৈর্ঘ্য দ্বিগুণ (অর্থাৎ ২০০ দশমিক ১৮ কিলোমিটার) দেখিয়ে প্রাক্কলন চুক্তি করা হয়। সে মোতাবেক ৮০ লাখ ৪৬ হাজার টাকা অতিরিক্ত বিলও পরিশোধ করা হয়েছে।

রেললাইনের স্লিপার সরবরাহের কাজেও প্রায় দেড় কোটি টাকার দুর্র্নীতির তথ্য মিলেছে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সেতু প্রকৌশলী/পাকশী কার্যালয়ে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ‘গ্যালভ্যানাইজড এইচ-বিম স্টিল স্লিপার সাপ্লাই অ্যান্ড রিপ্লেসমেন্ট’-এর জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নূর-ই ইলাহী অ্যান্ড ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেডের সাথে চুক্তি করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২৯৫০টি এইচ-বিম স্টিল স্লিপার সরবরাহ করার কথা। এ জন্য খরচ ধরা হয়েছিল ২৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।

কিন্তু এই চুক্তির বিপরীতে তাইওয়ান থেকে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ১২০ কেজি স্লিপার আমদানি করা হয়েছে। ড্রয়িং অনুসারে প্রতিটি এইচ-বিম স্টিল স্লিপারের ওজন ১৬৫ দশমিক ৮২ কেজি। সেই হিসাবে মোট ২৭৯৯টি এইচ-বিম স্টিল স্লিপার আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু সরবরাহ দেখানো হয়েছে চুক্তিতে উল্লেখিত ২৯৫০টি। অর্থাৎ চুক্তির চেয়ে ১৫১টি কম সরবরাহ তথা রিপ্লেসমেন্ট করা হয়েছে। কিন্তু বিল পরিশোধ করা হয়েছে ২৯৫০টিরই। ফলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত পরিশোধ করা হয়েছে এক কোটি ৪১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা।

অডিট প্রতিবেদনে আরও ধরা পড়েছে, ঢালারচর প্রকল্পে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ৩০০টি বিজি পিএসসি স্লিপার স্থাপন না করেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেড় কোটি টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ৩৩০০টি ব্রডগেজ পিএসসি স্লিপারের পরিবর্তে ডুয়েল গেজ স্লিপার স্থাপন করা হয়েছে। এতে অতিরিক্ত দেড় কোটি টাকা খরচ দেখিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এই অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও ক্ষতিরপূরণের অর্থ আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

পশ্চিমাঞ্চলীয় রেলওয়ের নানা প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজনের রাজশাহী বিভাগীয় কমিটির সভাপতি আহমদ সফিউদ্দিন বলেন, দুনিয়াজুড়ে রেল হলো মানুষের জন্য স্বস্তিদায়ক যাত্রার মাধ্যম। বর্তমান সরকার রেলের উন্নয়নে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। নানা প্রকল্প বাস্তবায়নও করছে। কিন্তু আমলাদের দুর্র্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। অন্যথা সরকারের উন্নয়নের ফল জনগণের কাছে পৌঁছবে না।

অডিট প্রতিবেদনের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার বলেন, ‘অডিট আপত্তি একটি চলমান প্রক্রিয়া। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই এসব মোকাবিলা করে থাকেন। বছরের পর বছর ধরে নিষ্পত্তিও হয় না অনেক অডিট। তবে চূড়ান্ত বিচারে দুর্নীতি বা অনিময় প্রমাণ হলে আইনি ব্যবস্থার মুখোমুখি হতেই হবে। ছাড় পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সূত্র- আমাদের সময়

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে