রাবিতে ফলাফল বিতর্ক : আসলে কী ঘটেছিল?

প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০২৩; সময়: ১১:৫৭ পূর্বাহ্ণ |
রাবিতে ফলাফল বিতর্ক : আসলে কী ঘটেছিল?

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, রাবি : সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) ১ম ব্যাচের পরীক্ষা কমিটির বিরুদ্ধে ০.৫ (হাফ) মার্ক বাড়ানো ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে টেবুলেশনের কাজ করানোর অভিযোগ ওঠে। এরপর থেকেই বিষয়টি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পক্ষে বিপক্ষে নানা মতামত উঠছে।

কোর্স শিক্ষকের অনুরোধেই পরীক্ষা কমিটি শিক্ষার্থীর মার্ক বাড়ানোর দাবি করলেও কোর্স শিক্ষক তা অস্বীকার করেছেন। এদিকে ব্যাচের মেসেঞ্জার গ্রুপের স্ক্রিনশট ব্যবহার করে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদকে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করে প্রতিবাদ জানিয়েছে ১ম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।

জানা যায়, আইইআরের ১ম ব্যাচের মাস্টার্সে প্রথম হওয়া শিক্ষার্থী দেলোয়ার হোসেনকে ১০৫১ নম্বর কোর্সে ৭৯ দেন কোর্স শিক্ষক আরিফুর রহমান। পরবর্তীতে ৪ সদস্য বিশিষ্ট ব্যাচের পরীক্ষা কমিটি ০.৫ যোগ করায় তার গ্রেড এ থেকে এ+ হলেও।

এতে তার সিজিপিএ ৩.৯৪ হলেও ব্যাচের কোনো শিক্ষার্থীর মেধাক্রম পরিবর্তিত হয়নি। ওই ব্যাচে স্নাতকোত্তরে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা শিক্ষার্থীর সিজিপিএ ৩.৮৮।

পরীক্ষা কমিটি সদস্যদের দাবি, কোর্স শিক্ষক আরিফুর নিজেই কমিটিকে দেলোয়ারকে ০.৫ নম্বর দিতে বলেন। তবে কোর্স শিক্ষক আরিফুর রহমান বিষয়টি অস্বীকার করেন।

এদিকে ১ম ব্যাচের তিন শিক্ষার্থীকে দিয়ে টেবুলেশনের কাজ করার অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে ব্যাচের মেসেঞ্জার গ্রুপের স্ক্রিনশট নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে কয়েকটি গণমাধ্যম।

তবে ব্যাচ কমিটি ও শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রেশন কার্ডে বাংলায় নাম না থাকায় তারা গুগল ডক ফরমের মাধ্যমে বাংলায় তথ্য সংগ্রহ করে কমিটিকে দিয়েছেন।

এছাড়া রেজাল্ট বা মার্কশিট সংক্রান্ত কোনো কাজে জড়িত ছিলেন না। ব্যাচের মেসেঞ্জার স্ক্রিনশট ব্যবহার ও খণ্ডিত তথ্য ব্যবহার করে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে দাবি করে প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতিও দিয়েছেন ১ম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।

১০৫১ নম্বর কোর্সের (এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত) শিক্ষক আরিফুর রহমান বলেন, “একজন শিক্ষার্থী ৭৯ মার্ক পেলে মানবিকতার জায়গা থেকে আমরা শিক্ষকরা সাধারণত এ+ করে দেয়ার চেষ্টা করি।

কিন্তু এই কোর্সে এই ছেলের পরীক্ষার খাতা দেখার পরে আমার মনে হয়েছিল, এই ছেলে আসলে এই কোর্সে এ+ ডিজার্ব করেনা।”

০.৫ মার্ক যোগ করার বিষয়ে জানতে চাইলে আরিফুর রহমান বলেন, “একটা ছাত্র ০.৫ মার্কের কারণে এ+ পাচ্ছেনা দেখে, স্যার হয়তো মানবিকতার জায়গা থেকে এটা করেছেন।”

এই বিষয়ে পরীক্ষা কমিটির সদস্য ও সহযোগী অধ্যাপক ড. হ্যাপী কুমার দাস বলেন, “উনি (আরিফুর) গত ৯ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর পরীক্ষা কমিটির সভাপতি ও দুইজন সদস্যের সামনে বলেছিলেন যে, আপনারা যখন রেজাল্ট করবেন, তখন মানবিকতার জায়গা থেকে কারো প্রয়োজন হলে একটু বাড়িয়ে দিয়েন। এছাড়া আমরা জানতাম যে পরিস্থিতি বিবেচনায় ০.৫ মার্ক বাড়ানোর আইন ছিল।

তবে এই ঘটনার পরে আমরা জানতে পেরেছি যে, আইনটা এখন আর এটা নেই। তৃতীয়ত, ০.৫ মার্ক বাড়ানোতে কারো কোনো অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি। কারো অবস্থানের পরিবর্তন হলে হয়তো এমনটা করা হতোনা।”

কোর্স শিক্ষক মার্ক বাড়ানোর বিষয়টি অস্বীকার করার বিষয়ে ড. হ্যাপি কুমার দাস বলেন, “আমরা ওনার কথা রেকর্ড করে রাখি নাই। এখন এরকম বলতে পারেন। এটা আমাদের ভুল হয়েছে। কিন্তু ফলাফল তো আনঅফিশিয়ালি প্রকাশিত হয়েছিল ১০ তারিখে (আগস্ট)।

আর গেজেটেড আকারে প্রকাশিত হয়েছে ২২ তারিখে। মাঝখানে ১২ দিনে ফলাফলের বিষয়ে কোনো শিক্ষক-শিক্ষার্থী বা অন্য কেউ এই বিষয়ে অভিযোগ করেনি।

কেউ গুড ইনটেনশন নিয়ে কমিটিকে বললেই ভুল সংশোধন করা যেতো। এভাবে গণমাধ্যমে অভিযোগ তুলে বিষয়টি নিয়ে ইস্যু তৈরী করাটা সত্যিই বিব্রতকর ও দুঃখজনক।”

গণমাধ্যমের বিষয়ে আরিফুর রহমান বলেন, “পত্রিকার সাংবাদিক বিষয়টিকে একটু ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছে। বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ উপস্থাপন করায়, বক্তব্যটা একটু অন্যরকম অর্থে হয়ে গেছে।

রুবাইয়াৎ স্যার কিন্তু আসলেই খুব ভালো মানুষ। আমিও ওনাকে খুবই পছন্দ করি। এখন আমি আসলে জানিনা কেনো এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।”

এই বিষয়ে পরীক্ষা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক রুবাইয়াৎ জাহান বলেন, “ওই শিক্ষার্থী কত পেয়েছিল, সেটা আমি জানতাম না। তার কোর্স শিক্ষক থিসিসের ভাইভাতে (৯ আগস্ট) আমাদের এখানে এসেছিল।

ওইদিন প্রসঙ্গক্রমে একাধিক শিক্ষকের সামনেই তিনি বলেছিলেন যে, দুইজন শিক্ষার্থীকে পারলে আপনারা ০.৫ মার্ক বাড়িয়ে দিয়েন।

এরপর আমি আমার কমিটির সদস্যদেরকে বলি যে, কারো মার্কই আমরা বাড়াবোনা। কারণ এটা অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে পারে।

কিন্তু হিসাব করে যখন আমরা দেখলাম যে, একজন শিক্ষার্থীকে ০.৫ মার্ক দিলে সে এ+ পাবে এবং এতে করে কারো অবস্থানের পরিবর্তন হবেনা, তখন আমরা মানবিকতার জায়গা থেকে তাকে ০.৫ মার্ক দেই।”

তিনি আরও বলেন, “এরপর ১০ আগস্ট আনঅফিশিয়ালি এবং ২২ আগস্ট গেজেটেড আকারে ফলাফল প্রকাশিত হয়। এরপর হঠাৎ করে গণমাধ্যমে মার্ক বাড়িয়ে দেয়ার খবর দেখলাম।

আমরা আসলে বুঝতে পারিনি যে, আমাদের সহকর্মী এভাবে বিষয়টি (মার্ক বাড়ানোর অনুরোধ) অস্বীকার করবে। ওই শিক্ষকের মুখের কথায় বিশ্বাস করে লিখিত নেয়া হয় নাই, এটাই হলো আমাদের অপরাধ।”

এদিকে পরীক্ষা কমিটির সদস্য এনএএম ফয়সাল আহমেদ অভিযোগ করে বলেন, “১ম সেমিস্টারের ফলাফল প্রস্তুত করার সময় স্যার (কমিটির সভাপতি) আমাকে ডেকেছিলেন, কিন্তু ২য় সেমিস্টারের ফলাফল প্রস্তুত সংক্রান্ত কোনো প্রক্রিয়াতেই আমাকে ডাকেননি।

২৫ আগস্ট রাতে ইমার্জেন্সি মিটিংয়ের বিষয়ে আমাকে একটা ইমেইল করেছেন এবং যেদিন ডিফেন্স হয়েছিল, ওইদিন একটা ইমেইল করেছিলেন। এছাড়া, অন্য কোনো প্রক্রিয়াতে আমাকে রাখেননি।

টেবুলেশন শিট তৈরী করে এনে লাস্টের দিন আমাকে সই করার জন্য বলেছিলেন। আমি সেটাতে সই করে দিয়েছিলাম। এটা আমার একটা বোকামি আর কি। টেবুলেশন শিট শিক্ষকরাই তৈরী করেন। আমাকে ডাকলে আমিও হেল্প করতাম, কিন্তু আমাকে ডাকেননি।”

এই অভিযোগের বিষয়ে কমিটির সদস্য সহযোগী অধ্যাপক ড. হ্যাপী কুমার দাস বলেন, “কমিটির সকলেই ফলাফল প্রস্তুত প্রক্রিয়াতে কাজ করেছেন।

টেবুলেশন খুবই নিখুঁত একটা কাজ। এক্ষেত্রে ফলাফলের জন্য তিনটা খাতা হয়। তিনটা খাতায় একজন শিক্ষার্থীর ফলাফলের জন্য মোট ছয়টা করে পঞ্চাশ জন শিক্ষার্থীর জন্য তিনশ’টা সই করতে হয় পরীক্ষা কমিটির সকল সদস্যকে।

এখন কেউ যদি বলে যে, আমি তিনটা খাতায় তিনশতটা সই করেছি, কিন্তু আমি কিছু দেখিনি। তাহলে তো কিছু বলার নেই।

আমরা যখন তিনটা খাতায় সবাই সই করি তার অর্থই হলো খাতার তথ্য ঠিক আছে। এখন তাকে প্রক্রিয়াতে রাখা হয়নি, এ কথা কে কি কারণে বলছে, সে বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছিনা।”

অধ্যাপক রুবাইয়াৎ জাহান বলেন, “তাকে (ফয়সাল আহমেদকে) যদি ফলাফল প্রস্তুত সংক্রান্ত প্রক্রিয়াতে না রাখা হয়, তাহলে তিনি ব্যাচ কমিটি বা ইনস্টিটিউটের পরিচালকের কাছে জানাতে পারতেন কিংবা টেবুলেশন শিটে স্বাক্ষর করতে আপত্তি জানাতে পারতেন। কিন্তু তিনি এসব কিছুই করেনি। এখন তিনি কেন গণমাধ্যমে এমন অভিযোগ তুলছেন সেটা উনিই ভালো বলতে পারবেন।”

টেবুলেশন তৈরীতে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে অধ্যাপক রুবাইয়াৎ বলেন, “এটা খুবই লেম অভিযোগ। টেবুলেশন শিটে শিক্ষার্থীদের বাংলা নাম লেখা হয়। ওইসময় শিক্ষার্থীরা সবাইতো ক্যাম্পাসে ছিলনা।

এখন সবার শুদ্ধ বাংলা নাম আমি কোথায় পাবো? তাই, কয়েকজন ছাত্রকে বলেছিলাম সবার বাংলা নামগুলো সংগ্রহ করে দিতে। এখন এটাকেতো টেবুলেশনের কাজে লাগানো বলা যাবেনা, টেবুলেশনের জন্য নাম সংগ্রহে সহায়তা বলা যেতে পারে।”

এই বিষয়ে ১ম ব্যাচের শিক্ষার্থী মনজুরুল হাসান বলেন, “স্যারেরা বলেছিলো সবার বাংলা নামের শুদ্ধ বানান ও অন্য তথ্য যোগাঢ় করে দিতে। কারণ আমার বন্ধুরা পরীক্ষার পর রাজশাহী ছেড়ে চলে গেছে। এখন আমি ও আমার দুই বন্ধু মিলে গুগল ডক ফরম তৈরী করে তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছি।

এজন্য বেশ পরিশ্রম গেছে। সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে বলে বলে ফরমটা পূরণ করিয়েছি। অনেকেই ফেইসবুকে এক্টিভ ছিলনা, কাউকে ফোন করে বলেছি, আবার কেউ ফোন নাম্বার চেঞ্জ করেছে, তাদের নাম্বার বিভিন্ন ম্যাধ্যমে কালেক্ট করে তথ্য নেয়া হয়েছে।

গুগল ডকে তথ্য দেয়ার পর আমরা প্রায় সবার সাথে পুনরায় যোগাযোগ করে নামের বানান ভেরিফাই করেছি যেন কারও নামের বানান ভুল না হয়।

এই কথাগুলোওই মেসেঞ্জার গ্রুপে আমাদের আলাপ হচ্ছিলো। কিন্তু কে বা কারা সেই স্ক্রিনশট ফাঁস করে গণমাধ্যমে দিয়েছে। ওই কথাগুলোর আগে পিছে কিন্তু অনেক কথা হয়েছে আমাদের।

সেগুলো সংবাদে আসে নাই। এমনকি আমার বক্তব্যও খণ্ডিত আকারে প্রকাশিত হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না এভাবে তথ্য বিকৃত করে ও মেসেঞ্জার গ্রুপের স্ক্রিনশট ফাঁস করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ প্রচার করে কার কী লাভ।”

পরীক্ষা কমিটি কোনো শিক্ষার্থীর মার্ক বাড়াতে পারেন কি না জানতে চাইলে আইইআরের পরিচালক অধ্যাপক দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, “মার্ক বাড়িয়ে দেয়ার বিষয়ে পরীক্ষা কমিটির সভাপতির কোনো এখতিয়ার নেই।

আগে একটা প্রোভিশন ছিল যে, পরীক্ষা কমিটির সদস্যরা মনে করলে ১ মার্ক গ্রেস হিসেবে দিতে পারবেন। কিন্তু সেই প্রথাটা অনেক আগেই বিলুপ্ত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এই বিষয়টি জানেননা, নাও জানতে পারেন, তবে এটা আমার কাছে ঠিক নয় মনে হয়েছে।”

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে