আল্লাহর পরিচয়
মাহমুদ আহমদ : পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন : ‘মানুষ কি মনে করে, তাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে? (সূরা কিয়ামা : ৩৬)। আবার সূরা মুমিনুনের ১১৫ নম্বর আয়াতে মহান স্রষ্টা এ কথাই ব্যক্ত করেছেন ‘তোমরা কি ভেবেছ তোমাদের অহেতুক সৃষ্টি করেছি।’ মোটেও নয় বরং বিশেষ উদ্দেশ্যের জন্যই আমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
যেহেতু আজ আমরা আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য ভুলেতে বসেছি, তাই তো সমাজ, দেশ ও বিশ্বের সর্বত্রে অশান্তি বিরাজমান। আমার অধিকার, আমার প্রাপ্য, আমার সম্মান সব কিছু সম্পর্কেই আমি খুব ভালো বুঝি, অন্যের উপকারের কথা এলেই কেবল আমি বুঝি না। একের পর এক অন্যায় আমার দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে, ক্ষণিকের জন্যও আমি আমার প্রভুকে স্মরণ করি না, তাকে ভয় করি না। অথচ তিনি আমাদের সঙ্গেই আছেন, আমাদের অপকর্ম দেখা সত্ত্বেও আমাদের ছাড় দিচ্ছেন, সংশোধনের সময় দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘যেখানেই তোমরা যাও তিনি তোমাদের সঙ্গে থাকেন আর তোমরা যা-ই কর আল্লাহ তা পুরোপুরি দেখেন’ (সূরা হাদিদ : ৪)। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক এটাও বলেছেন, তিনি আমাদের জীবনশিরা অপেক্ষাও নিকটে রয়েছেন (সূরা কাফ : ১৬)।
আল্লাহপাক আমাদের এত কাছে, তারপরও আমরা তার রহমত থেকে বঞ্চিত থেকে যাই। এর কারণ হলো-আমার যে একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, সব কিছুই যে তার, আমার যে কিছুই নেই, এ বিষয়টা নিয়ে কখনো আমি চিন্তা করি না। আর এ কারণেই আমি আমার সৃষ্টিকর্তা প্রভুকেও চিনতে পারছি না এবং তার কল্যাণ থেকে বহু দূরে অবস্থান করছি। হাদিসে বলা হয়েছে, মহানবি (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি তার নিজ সত্তার পরিচিতি লাভ করতে পেরেছে সে মহান প্রভুকে চিনতে পেরেছে।’
উল্লিখিত হাদিসের কথাই পবিত্র কুরআনে সূরা হাশরের ১৯ নম্বর আয়াতে ভিন্ন ভঙ্গিতে মহান স্রষ্টা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন ‘তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছেন।’ এ কথার অর্থ হলো, আল্লাহকে ভুলে যাওয়া সমান নিজ সত্তাকে ভুলে যাওয়া। আসলে কি মানুষ নিজ সত্তাকে ভুলে যায়?
হ্যাঁ, মানুষ নিজ সত্তাকে ভুলে যায়। আজ আমরা নিজ সত্তাকে ভুলতে বসেছি। যেহেতু আজ আমরা নিজ সত্তাকে ভুলতে বসেছি তাই আজ আমার দ্বারা কেউ আর নিরাপদ নয়। নিরীহ ও নিষ্পাপ শিশুদের ওপর জুলুম অত্যাচার করতে আমার হৃদয় আজ কাঁদে না। অহংকার আর ক্ষমতার দাপটে আমি আমার জন্মের উদ্দেশ্যকে ভুলতে বসেছি। অথচ আমরা দেখতে পাই ইবলিসের সব আমল নষ্ট হয়েছিল কেবল তার অহংকার আর আমিত্বের কারণেই।
সে নিজের সৃষ্টির উপাদানকে শ্রেষ্ঠ মনে করে আদমের সৃষ্টিগত উপাদানকে অর্থাৎ মাটিকে তুচ্ছজ্ঞান করে প্রভুর নির্দেশের অবাধ্য হয়। ফলে তার অর্জিত সব আমল বিনষ্ট হয়ে যায় এবং সে প্রভুর অভিশাপে পতিত হয়। তাই মানুষ যাতে কখনো অহংকারী না হয় এবং আমিত্ব তাকে গ্রাস না করে সে জন্যই মহান প্রতিপালক তাকে তার সৃষ্টিগত উপাদানের কথা পবিত্র কুরআনে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
আজ যারা ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তির গর্ব করে আল্লাহপাকের সৃষ্টিকে কষ্ট দেয় তাদের অবস্থা যে ইবলিসের মতো হবে না তা কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? আজ আমরা সৃষ্টিকর্তা খোদাকে ভুলে গিয়ে হৃদয়ে শতশত মিথ্যা খোদার স্থান দিয়েছি। মুখে এক আর অন্তরে ভিন্ন, এটাই যেন আজ রীতিতে পরিণত হয়েছে। অথচ আমাদের অন্তরে কি আছে তা তিনি খুব ভালো করেই জানেন। তাই মানুষকে নানাভাবে ধোঁকা দেওয়া সম্ভব কিন্তু আল্লাহপাককে ধোঁকা দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ তিনি প্রকাশ্য এবং গোপন, ভেতর এবং বাইরের সব কিছু সম্পর্কেই অবগত।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি বল, তোমাদের অন্তরে যা আছে তা তোমরা গোপন কর বা তা প্রকাশ কর আল্লাহ তা জানেন। আর আকাশসমূহে যা আছে এবং পৃথিবীতে যা আছে তিনি তাও জানেন। আর আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে সর্বশক্তিমান। সেদিন প্রত্যেকেই যা কিছু সে ভালো কাজ করেছে, চোখের সামনে দেখতে পাবে এবং যা কিছু মন্দ কাজ করেছে তাও, ওরা তখন কামনা করবে, যদি তার এবং এসব কর্মের মধ্যে ব্যবধান দীর্ঘ হতো! আল্লাহ তার নিজের সম্পর্কে তোমাদের সাবধান করছেন। আর আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি অতি মমতাশীল’ (সূরা আলে ইমরান : ২৯-৩০)।
এখন সময় এসেছে নিজেকে চেনার ও জানার, নিজেকে সংশোধন করার। অনেকে বলতে পারেন, কেবল নিজেকে চিনলে লাভ কী? হ্যাঁ, লাভ আছে। যেভাবে বিন্দু বিন্দু জল মিলে নদী হয়, ছোট ছোট পাথর মিলে পাহাড় হয়, লতাপাতা, ছোট ছোট গাছ মিলে জঙ্গল হয় এভাবেই এক এক ব্যক্তি মিলে জাতি গঠিত হয়। কোনো জাতির গঠন, উন্নতি, শ্রেষ্ঠত্ব ও দৃঢ়তা অর্জনে ওই জাতির ব্যক্তিরাই মেরুদণ্ডের হাড়ের ভূমিকা রাখে।
এ সত্যকে অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই যে, কোনো জাতির উন্নতির শিখরে পৌঁছার ক্ষেত্রে সে জাতির লোকেরা চাবিকাঠির ভূমিকা রাখে। সেখানে এ বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য, কোনো জাতির অধঃপতনের চরমে নিপতিত হওয়ার ক্ষেত্রেও তারাই দায়ী। আজ যদি আমরা পরের দুঃখে ব্যথিত হই, অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করি তাহলে সে সত্তা যিনি আমাদের জীবনশিরারও কাছে অবস্থান করেন তিনিই আমাদের সব সমস্যা দূর করবেন। আল্লাহতায়ালা আমাদের তার শিক্ষা অনুসারে জীবন পরিচালনার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট