জাকাত ধনীর সম্পদে গরিবের অধিকার
মোহাম্মদ সোহেলোর রহমান সাইফী : ইসলামের মৌলিক পাঁচ ভিত্তির অন্যতম ‘জাকাত’। পবিত্র কুরআনে এসেছে ‘এবং তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জাকাত আদায় করো। অতঃপর তিনি তা দ্বিগুণ করে দেবেন’ (সূরা রুম-৩৯)। জাকাত আদায়ের ব্যাপারে বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহপাক জাকাত দেওয়া ফরজ করেছেন যেন তোমাদের অবশিষ্ট সম্পদকে নির্দোষ বা নির্বিঘ্ন করে দিতে পারেন’। (আবু দাউদ শরিফ)।
জাকাতের আভিধানিক অর্থ পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা। জাকাত যেহেতু অর্থসম্পদকে পুঁজিবাদের অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করে, মানুষের মন-মস্তিষ্ককে গর্ব-অহংকার, লোভ-লালসা ও কৃপণতার মলিনতা থেকে পরিচ্ছন্নতা রাখে। নিজের উপার্জিত সম্পদে সমাজের অবহেলিত শ্রেণির দাবি-দাওয়া পূরণে উৎসাহ জোগায় এ জন্য ইসলামের এ তৃতীয় স্তম্ভের নামকরণ হয় জাকাত। শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদ মুসলমান গরিবকে আল্লাহর ওয়াস্তে পুরোপুরি মালিক বানিয়ে দেওয়াকে জাকাত বলে।
জাকাত হচ্ছে একটি আর্থিক ইবাদত। নিজের সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরিব মিসকিন ও অভাবী লোকদের মধ্যে বণ্টন করাকে জাকাত বলা হয়। এটি নামাজ রোজার মতোই একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। দ্বিতীয় হিজরিতে মদিনায় জাকাত ফরজ হয়। মহান আল্লাহ মহাগ্রন্থ আল কুরআনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৮২ জায়গায় এ জাকাতের কথা বলেছেন। জাকাত শব্দ দ্বারা ৩০ বার, আল ইনফাক শব্দ দ্বারা ৪৩ বার, আস সাদাকাহ শব্দ দ্বারা ৯ বার। ৩০+৪৩+৯= ৮২ বার।
এতবার যে বিষয়টি সম্পর্কে মহান রব বলেছেন অবশ্যই বিষয়টি খুবই গুরুত্বের দাবি রাখে। কিন্তু আমাদের অনেককে দেখা যায়, আমাদের ওপর ইসলামের এ মহান হুকুমটি ফরজ হয়ে আছে এরপরও আমরা এর প্রতি খেয়াল করি না। আমরা ভাবি আমাদের সম্পদ কমে যাবে। আসলে জাকাত দিলে সম্পদ কমবে না বরং বৃদ্ধি পায়। জাকাত দিলে যে সম্পদ বৃদ্ধি পাবে তা মহান আল্লাহ নিজেই বলেছেন : আল্লাহতায়ালা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন আর দান-সদকাকে বৃদ্ধি করেন। আল্লাহতায়ালা অকৃতজ্ঞ পাপিষ্ঠ ব্যক্তিদের কখনো পছন্দ করেন না।
ধনী সম্পদশালী ব্যক্তিরা মনে করেন যে, জাকাতের দ্বারা সম্পদ কমে যায়, তা নিছক ভুল ধারণা। কেননা আল্লাহপাক পবিত্র কালামে পাকে ওয়াদা করেছেন যে, ‘জাকাত আদায়ের ফলে তিনি বান্দার সম্পদ দ্বিগুণ করে দেবেন’। জাকাত ইসলামের অন্যতম খুঁটি। কুরআন-হাদিসে জাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে বারবার তাগিদ করা হয়েছে।
কুরআন-হাদিসের অকাট্য প্রমাণাদি দ্বারা জাকাতের বিধান প্রণোদিত হয়েছে। তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ কারও নেই। জাকাত অস্বীকারকারীকে শরিয়ত কাফির বলে আখ্যা দিয়েছে। কেননা ফরজের বিধান অস্বীকার করা কুফুরির অন্তর্ভুক্ত। যে তা আদায় না করবে সে ফাসিক। আর যে আদায় করতে বিলম্ব করবে সে গুনাহগার তার সাক্ষী গ্রহণযোগ্য নয়। (আলমগিরি : তরিকুল ইসলাম বাংলা ২য় খণ্ড, পৃ. ২৬৫)।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, প্রতিদিন সকালে দুজন ফেরেশতা অবতরণ করেন। তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! দাতাকে তার দানের উত্তম প্রতিদান দিন আর অপরজন বলেন, হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করে দিন। (বুখারি)। অন্য হাদিসে এসেছে : জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল (সা.) বলেছেন যখন তোমাদের কাছে জাকাত আদায়কারী আসবে তখন সে যেন তোমাদের কাছে থেকে তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যায়। (মুসলিম)।
উপরোক্ত আয়াতগুলো দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়, জাকাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এতে কোনো মুমিনের অনীহা প্রকাশ করার সুযোগ নেই। এর অস্বীকারকারী মুমিন থাকে না।
যার ওপর জাকাত ফরজ
নিসাব পরিমাণ সম্পদ আছে-এমন স্বাধীন ও পূর্ণবয়স্ক মুসলিম নর-নারীর ওপর জাকাত ফরজ। তবে এর জন্য শর্ত হলো-১) সম্পদের ওপর পূর্ণাঙ্গ মালিকানা থাকতে হবে। ২) সম্পদ বর্ধনশীল হতে হবে। ৩) নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে। ৪) সারা বছরের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর পর অতিরিক্ত সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ। ৫) ঋণমুক্ত হওয়ার পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে। ৬) নিসাব পরিমাণ সম্পদের সময় এক বছর পূর্ণ হতে হবে। যে পরিমাণ ধনসম্পদ থাকলে জাকাত ফরজ হয়, ইসলামি পরিভাষায় তাকে বলা হয় নিসাব। সম্পদের নিসাব হলো স্বর্ণ সাড়ে সাত ভরি, রুপা সাড়ে বায়ান্ন ভরি অথবা এর কোনো একটির সমমূল্যের নগদ টাকা বা ব্যবসার পণ্য। সুতরাং এ পরিমাণ সম্পদের ৪০ ভাগের এক ভাগ (২ দশমিক ৫০ শতাংশ) জাকাত দিতে হবে।
জাকাত দেবেন কাকে?
সূরা তাওবার ৬০ নম্বর আয়াত অনুযায়ী যারা জাকাত পাওয়ার উপযোগী, তারা হলেন- ১. ফকির : যার বেঁচে থাকার মতো সম্বল নেই বা খুব সামান্য। ২. মিসকিন : এমন অভাবী, যার রোজগার তার নিজের এবং তার ওপরে নির্ভরশীলদের অপরিহার্য প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। ৩. জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণ কাজে নিয়োজিত কর্মচারী, যাদের আমিলিন বলে। ৪. নব্য মুসলিম যার ইমান পরিণত হওয়ার পথে আছে অথবা ইসলাম গ্রহণ করতে ইচ্ছুক কোনো অমুসলিম। ৫. মুক্তিপণ ধার্যকৃত দাস বা রিকাব। ৬. ঋণী ব্যক্তি যিনি জাকাতের অর্থে ঋণ পরিশোধ করতে চান। ৭. আল্লাহর পথে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত ব্যক্তি (মুজাহিদ)। ৮. বিপদগ্রস্ত মুসাফির।