রোমাঞ্চকর এক ভ্রমণে রাবি ট্যুরিস্ট ক্লাবের সদস্যরা

প্রকাশিত: এপ্রিল ১, ২০২৪; সময়: ৮:০১ অপরাহ্ণ |
রোমাঞ্চকর এক ভ্রমণে রাবি ট্যুরিস্ট ক্লাবের সদস্যরা

ইবতেসাম শান্ত, রাবি : পাহাড় ভালোবাসে না এমন মানুষ খুব কমই আছে। যদি আপনি পাহাড়প্রেমী হন তবে বান্দরবান হতে পারে সেরা জায়গা। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ পাহাড় আর তার উপর সাদা মেঘের আনাগোনা বান্দরবানকে করে তুলেছে দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন জেলা। তবে, আপনার মনে যদি পর্যটক সত্ত্বার চেয়ে অভিযাত্রী সত্ত্বার প্রভাব বেশি থাকে তবেই আপনি উপভোগ করতে পারবেন বান্দরবানের আসল সৌন্দর্য।

নিজের অভিযাত্রী মনের খোরাক মেটাতে বান্দরবানের গহীনে চলে যেতে পারেন বিনা সংকোচে। দুর্গম পাহাড়ি পথ আর অধিবাসীদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি আপনাকে মুগ্ধ করবে এ কথা বাজি ধরেই বলা যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পাহাড় চূড়ায় কবিতায় বলেন, “অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ। কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না। যদি তার দেখা পেতাম, দামের জন্য আটকাতো না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ট্যুরিস্ট ক্লাব প্রতি মাসে ট্যুরের আয়োজন করে থাকে। এই ইভেন্টটি ছিলো আমিয়াখুম নাফাখুম রেমাক্রিফলস ট্যুর। ট্যুরের অভিজ্ঞতা বর্ণনাকারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এবং ট্যুরিস্ট ক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মৃনাল রায়। বলে রাখি -বাংলাদেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বিভিন্ন পর্যটন স্থান গুলোকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াই জটঞঈ এর উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ট্যুরিস্ট ক্লাব বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ট্যুর আয়োজন করে থাকে। দারুণ বিষয় হলো এই ট্যুর গুলোতে যে কেউ যুক্ত হতে পারে।

আমিয়াখুম নাফাখুম এর জলপ্রপাতের সাথে শাড়ি পড়ে ছবি তোলা বর্তমানে মেয়েদের কাছে সেরা একটি জায়গা। শাওলি, তৃষা, তিতির ট্যুরিস্ট ক্লাবের অন্যতম সদস্য। শাওলি ও তিতির মৃনালের বড় আপু এবং তৃষা বন্ধু। তারা প্রায় মৃনালকে বলতো আমিয়াখুমে একটা ট্রিপ দেয়ার জন্য। তাদের অনুরোধে এই ট্রিপটি আয়োজন করা হয়েছিল। বিভিন্ন ঝামেলা পর শেষমেশ ১৪ জন হয়ে গেলো ট্যুরে যাওয়ার জন্য। চোদ্দো জন সুন্দর একটা দল। অতঃপর ২০ ফেব্রুয়ারি রওনা রাজশাহী থেকে নাটোর স্টেশনে। আমির, মাহিন, কাওছার ভাই, ওসমান গণি ভাই, অনিক দা, পাপন দা সহ সবাই নাটোর স্টেশনেই একত্রিত হওয়ার জন্য। সেখান থেকে সবাই একসাথে ট্যুরের উদ্দেশ্যে রওনা।

পরের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৭টায় বাস সবাইকে চকরিয়াতে নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে আবার যাওয়া লাগে আলিকদম। আলিকদমে সকালের নাস্তা করে আগে থেকে রিজার্ভ চান্দের গাড়িতে রওনা এবার থানচির উদ্দেশ্যে। আলিকদম থেকে থানচির দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলো এবং যেতে সময় লাগে ৪ ঘন্টা।

ট্যুরিস্ট ক্লাবের রুট প্লান ছিলো আলিকদম> থানচি> পদ্মমুখ/পদ্মঝিরি> হরিশ্চন্দ্র পাড়া> নতুন পারা> থুইসা পাড়া> দেবতা পাহাড়> আমিয়াখুম> সাতভাইখুম> ভেলাখুম> থুইসা পাড়া> জিন্নাহপাড়া> নাফাখুম> রেমাক্রি ফলস> বড় পাথর> থানচি> আলিকদম> চকোরিয়া।

থানচি সদর থেকে সব ফরমালিটিস সেরে সবাই ঘাটে এসে উপস্থিত। ঘাটে ইন্জিন চালিত নৌকাগুলো যেগুলোতে ৫ জন করে ওঠা যায় সেগুলো ঘাটেই অপেক্ষা করছিলো। ৩ টি নৌকা নিয়ে পুরো দল রওনা পদ্মঝিরির উদ্দেশ্যে। থানচি থেকে পদ্মঝিরি নৌকা যেতে মোটামুটি দেড় ঘন্টার পথ। সাঙ্গু নদীর পাড়ের পাহাড়ী বাড়িগুলো ও মাচাং এর ঘরগুলো কি সুন্দর লাগে তা বলতে গিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেললেন মৃণাল। মৃণাল বললেন, “পাথুরে সচ্ছ সাঙ্গুর স্রোতের বিপরীতে নৌকা চলতে থাকলো। এই গাড়িগুলো অনেক জোরে যায়। যখন ২-১ ফোটা জল গায়ে এসে লাগে, মনে হয় পৃথিবীর সব সুখে যেনো এখানেই।

পদ্মঝিরিতে নৌকা সবাইকে নামিয়ে দিলো তখন দুপুর ১:৪০ মিনিট। ২টার সময় দুপুরের খাবার খেয়ে সকলে পদ্মমুখ হয়ে থুইস্যাপাড়ার উদ্দেশ্যে আবার রওনা। থানচি থেকে দুইপথে আমিয়াখুম যাওয়া যায়। রুট ১: থানচি > পদ্মঝিরি > থুইসাপাড়া > দেবতাপাহাড় > আমিয়াখুম। রুট ২: থানচি > রেমাক্রি > নাফাখুম > জিনাপাড়া > থুইসাপাড়া > দেবতাপাহাড় > আমিয়াখুম। প্রথম পথে শুধুমাত্র পদ্মঝিরিতেই প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা ট্রেকিং করতে হয় এবং অনেক সময় রাতের বেলাতেও ট্রেকিং করতে হতে পারে।

পদ্মমুখ হয়ে থুইস্যাপাড়া প্রায় ৭ ঘন্টার ট্রাকিং। অনেক কঠিন পথ। পাহাড়ি ঝিরি, কাদাময় রাস্তা, এক পাড়া থেকে আর এক পাড়া। পাহাড়ি রাস্তা, খুম, নদী কি নেই এই রুটে। তবে আর একটি রাস্তা ছিলো আমিয়াখুম নাফাখুম যাওয়ার জন্য সেটি থানচি -রেমাক্রি ফলস হয়ে ২ ঘন্টা হাটলেই নাফাখুম পাড়াতে যাওয়া যায়। একটু বেশি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিতেই মৃনালরা মূলত এই কঠিন রুট বেছে নেয়।

৪ ঘন্টা হাটার পর বিকেল তখন শেষ প্রায়। পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। ট্যুর গাইড বললো পাশের এই পাহাড়টাই তাজিংডন ও সাথে যে খাড়া পাথুরে পাহাড়, সেটা দ্যোতং পাহাড়। টিমের মধ্যে মাহিন একটু স্বাহ্যবান ও শরীরটা ভারী। সাথে ইন্ট্রোভার্ট হওয়াতে কোথাও যায় না, বেশি মানুষের সাথে কথাও বলে না সে। কিন্তু ক্লাবের গত কয়েকটা ট্রিপে মাহিন সবসময় মৃনালের সাথে যাচ্ছে। কারন সে যতটা মজা পাচ্ছে, ততটা শিখছে, নিজেকে একটা সুন্দর জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছে। বদ্ধ জগৎটার বাহিরে গিয়ে পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করছে। সে বেচারা বার বার বলেই যাচ্ছে মৃনাল ভাই আর পারব না।কোনো ভাবেই না। তাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ইতোমধ্যে ৫ ঘন্টা ধরে হাটিয়েছে গাইড ও মৃনাল।পরে ট্রাকিং সু শেষ পর্যন্ত রাস্তায় রেখেই অংশৈই খিয়াং দা তার ব্যাগ ও তার হাত ধরে রওনা দিলেন থুইস্যাপাড়ার উদ্দেশ্যে।

রাত তখন ৮ টা। দীর্ঘ ২৮ ঘন্টা শেষে সবাই ক্লান্ত দেহ নিয়ে পৌছালো থুইস্যাপাড়াতে। মাচাং ঘরে একটা রুমে ব্যাগ গুলো রেখে রাতের খাওয়া শেষে সবাই ঘুমাতে গেলো। বাকিদের রুমে রেখে মৃনাল অংশৈই খিয়াং দাদার পরিবারের সাথে খেতে বসলো। রাতের খাবারে বউদি পাহাড়ি শাকসবজি ও নাপ্পি দিলো মৃনালকে। মরিচ ও নাপ্পি দিয়ে পাহাড়ি শাকসবজি খাওয়ার যে অভিজ্ঞতা তা কখনো নাকি মৃনালের কখনোই ভোলা সম্ভব না। সাথে তো ছিলো সুখ দুঃখের গল্পও। তার পরিবারে ৪ জন ছেলে মেয়ে। ৩ জন শহরে পড়াশোনা করে।

২য় মেয়ে চেইমরা খিয়াং এবার ইন্টার ১ম বর্ষে পড়ে। থানচি কলেজে আবাসিকে থাকে সে। ৩য় ছেলে বান্দরবানে নবম শ্রেণিতে পড়ছে। এবং চতুর্থ ছেলে জন খিয়াং সে কেবল ৪ বছরের বাচ্চা।অনেক গল্প শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। কেননা আগামী কাল সকাল ৬ টায় উঠতে হবে।

সকালে অনেক কুয়াশা। প্রচন্ড ঠান্ডা। কিন্তু এই ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে সবাই ডিম খিচুরি খেয়ে রওনা দিলো দেবতাপাহাড় হয়ে আমিয়াখুম, সাতভাইখুম, ভেলাখুমের উদ্দেশ্যে। রুমে মাহিন সুয়েই থাকলো।কেননা তার পক্ষে আর যাওয়া সম্ভব না। বিজয় দাদা ভাঙ্গা পা নিয়ে সবার সাথে চলা শুরু করলেন। মৃনালের জীবনে বন্ধুত্বের সেরা উদাহরন হলো বিজয় দাদা, ওসমান গনি ভাই ও বাপ্পি ভাই এর বন্ধুত্ব। সেই অনেক বছর আগে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ। কিন্তু তাদের সম্পর্ক, যোগাযোগ, কোনো কমতি নেই। না দেখলে এটা বোঝানো সম্ভব না যে তাদের বন্ধুত্ব কি দারুণ।

কিন্তু বিজয় দা ভাঙ্গা পা নিয়ে দেবতাপাড়াতে উঠে আর নামার শক্তি পেলেন না। কেননা ১৫০০ ফিট উচু এই দেবতাপাড়ার পুরো ৯০ ডিগ্রি এঙ্গেলে।নিচে সেই আমিয়াখুম, সাতভাইখুম, ভেলাখুম। একটা দোকানে বিজয় দা, বাপ্পি ভাইকে রেখে দেবতাপাহাড় নামা শুরু করা হলো। দেবতাপাহাড় নামতে দেড় ঘন্টা সময় লাগলো। তার পর যা দৃশ্য! পরাণ জুড়িয়ে গেলো সবার। সেই কাঙ্খিত মাহেন্দ্রক্ষণ।

মৃনাল তার এই ভ্রমণের অনুভূতি প্রকাশ করে বলছিলেন, বাংলাদেশে এমন ঐশ্বর্যের অবস্থান যারাই দেখে তারাই বিমোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। পাথুরে পাহাড়ের মাঝে এমন দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে সবাই যেন কথা হারিয়ে ফেলে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যায় শতকষ্ট স্বীকার করে এখানে আসার সব ক্লান্তি, অবসাদ। বর্ষায় টগবগে যৌবন ফিরে পায় আমিয়াখুম। সুবিশাল জলধারা প্রবল গতিতে নেমে যায়। পাথর কেটে তীব্র বেগে ছুটে চলে নিচের দিকে।

পাহাড়ে হাটা যে এত কঠিন সমতলে যারা থাকে বেশিরভাগ মানুষের জন্য তা বোঝার বাহিরে। বিকেল ৩ টায় থুইস্যাপাড়াতে ফিরে দুপুরের খাবার খাওয়া শেষে পরের গন্তব্য নাফাখুমপাড়া। জন খিয়াং তখন কান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কেননা সে বাবার সাথে যেতে চায়। কিন্তু তার জন্য এটা অনেক কঠিন। অংশৈই খিয়াং দাদার পরিবারকে বিদায় জানিয়ে নাফাখুমপাড়ার উদ্দেশ্যে আবার রওনা। রাত ৮ টায় সবাই পৌঁছে নাফাখুমপাড়ায়। তখন পূর্ণিমায় চাঁদের আলোতে পুরো পাড়া আলোকিত। বাগানবিলাসের গাছগুলো ফুলে পরিপূর্ণ ছিলো। সেই রাতটা। সেখানের রাতটা মৃনালের জীবনের সেরা একটা রাত ছিলো। জলপ্রপাতের পানির শব্দ, চা আড্ডা আর ক্যাম্প ফায়ারে কত গান, গল্পে মেতে উঠেছিলো সবাই। কখন যে রাত ২ টা বেজেছে কেউ টেরই পাইনি।

পরের দিন সকালে খিচুরি ডিম ভুনা খেয়ে রেমাক্রি ফলসের দিকে চলে যাই পুরো টিম এবং সেখান থেকে নৌকা করে থানচিতে পৌছায়। রেমাক্রি টু থানচি আড়াই ঘন্টার জার্নি টা ছিলো মনে রাখার মতো। সাঙ্গু নদীকে বুঝি এজন্য বাংলাদেশের সবথেকে সুন্দর নদী বলা হয়। পাহাড়ী আঁকাবাকা, পাথুরে নদী, আর সাঙ্গুুপাড়ের মানুষের জীবন এ এক দৃষ্টিনন্দন ছবির মতো। অতপর থানচিতে এসে নেটওয়ার্ক পাওয়ার পর সবাই নিজের মতো বাসায় কথা বলতে শুরু করে। এই ভ্রমণের সময়টা জীবনের সেরা কাটানো সময়গুলোর একটা ছিলো মৃনালের কাছে। পাহাড়ের কি মায়া, কি সৌন্দর্য, আদিবাসীদের জীবন, কত কাছ থেকে দেখা গল্পের পর গল্প বললেও যেনো শেষ হবে না।

কষ্টের দিক গুলো বলতে গিয়ে মৃনাল বলেন, “গোটা পাহাড়েই ছাতিম, কড়ই, জারুল, গামারি, চাপালিশ, বান্দরহোলা, বহেরা গাছগুলো এত পরিমান কাটা হয়েছে সেটা দেখলেই বোঝা যায় পাহাড়ে গাছ কাটার প্রতিযোগিতা নেমেছে। আর শিক্ষার জন্য এখনো থানচি উপজেলার সবাইকে থানচি, রুমা, লামা, আলিকদমে আসতে হয় এবং যেতেহু ৮০-১০০ কিলো দুরে তাই ক্লায় ১ এর শিশুরাও আবাসিকে থাকতে হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আবাসিক ব্যবস্হা একটু বেশি মনোযোগ দেয়া দরকার। অন্য দিকে চিকিৎসা ব্যবস্থা পার্বত্য জেলাগুলোতে এখনও খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। বিশেষ করে দূর্গম পাহাড়ী এলাকাগুলোতে। বড় রকম কিছু হলে নিরুপায় হয়ে থাকতে হয় করার কিছু থাকে না।

যেহেতু তারা আমাদের বাংলাদেশের নাগরিক। সেই হিসেবে তারাও মৌলিক অধিকারগুলো ভোগ করার দাবি রাখে। এই পাহাড়ি মানুষ গুলোর জন্যই বাংলাদেশের পাহাড়ি প্রাকৃতি এতো সুন্দর। ভালো থাকুক পাহাড়ের মানুষগুলো। পাহাড়ের মতো যাদের মনটাও অনেক অনেক বড়, শুদ্ধ ও পবিত্র।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে