বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ বন্ধু যখন দুজনের সহকর্মী

প্রকাশিত: এপ্রিল ২, ২০২৪; সময়: ২:২৯ অপরাহ্ণ |
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ বন্ধু যখন দুজনের সহকর্মী

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাবি : বন্ধুত্ব কিভাবে হয়? বন্ধুত্বে কি কোন বয়সসীমা আছে? বন্ধুত্ব কখন, কিভাবে, কার সাথে গড়ে উঠে সুনির্দিষ্ট কোনো বিধিবদ্ধ নিয়ম নেই। আছে কী?

বন্ধুত্ব এমনই স্বার্থের উর্ধ্বে এক সম্পর্ক যাতে ব্লাড গ্রুপ না মিললেও মিলে যায় মনের গতিপথ। থাকে পরস্পরের প্রতি আবেগ, সম্মান ও ভালোবাসা। একে অপরের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া।

ভিন্ন মতাদর্শ থাকলেও একসাথে পথচলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা। একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা, নিজ নিজ সাধ্য অনুযায়ী সুখে-দুঃখে পাশে থাকা। যার কাছে মনের অব্যক্ত কথাগুলো নির্দ্বিধায় বলা যায়।

বন্ধুত্বের ধারণাও পরিবর্তন হয় সময় ও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে। শৈশবে যেমন খেলতে ভালো লাগেই বলে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, তেমনি পরিণত বয়সে ভালো লাগার পরিধি আরও বড় হয়।

যেমন- বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ব্যক্তির সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। আবেগ-অনুভূতি প্রকাশে পার্থক্য আসে। বন্ধু নির্বাচনে মানুষ আরও সংকীর্ণ হয়। পরিচিত অনেক মানুষ কাছে ভিড়ে, কিন্তু বন্ধু হয় অল্প ক’জনই।

তেমনই পরিচিত হবার পর বন্ধু হয়ে ওঠার গল্প আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্পূর্ণ অপরিচিত দুই ভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে দুটি আত্মা যেন এক হয়ে গেছে, বন্ধুত্ব টিকে আছে ৩৬ বছর ধরে।

সময়ের সঙ্গে গাঢ় হয়েছে সম্পর্ক। এরিস্টটল যেমন বলেছে, বন্ধুত্ব মানে দুই দেহে এক আত্মা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জাহাঙ্গীর আলম সাউদ (লিটন) আর প্রফেসর খালেদ হোসেনও যেন দুই দেহে এক আত্মা।

আজ থেকে ৩৬ বছর আগে দেশের দুই প্রান্ত থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন এই দুইজন। ঘটনা চক্রে পরিচয় দুই তরুণ স্বপ্নবাজের। আঞ্চলিক ভিন্নতা, রুচি-চাহিদা-পছন্দে ফারাক থাকা সত্ত্বেও সময়ের পরিক্রমায় গড়ে উঠে তাদের বন্ধুত্ব।

তারপর তাদের বন্ধুত্বের গল্প দীর্ঘ হতে থাকে। একি সাথে পড়াশোনা শেষ করে ভাগ্যক্রমে একি প্রতিষ্ঠানে কর্মজীবন শুরু। স্বভাবতই মানবীয় কারনে একি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গেলে একটা সময় সম্পর্কের দূরত্ব বাড়তে থাকে। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।

একে অপরের প্রতি বিশ্বাস রেখে ৩৬ বছর তারা চলেছে একি সাথে। বন্ধুত্বের জের ধরেই পারিবারিক সম্পর্কটাও ঘনিষ্ঠ করেছে। দুটি ভিন্ন পরিবারের দু:খ বেদনার সাথে জড়িত তারা। একি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত পাশাপাশি থাকেনও দুটি ভিন্ন পরিবার একি ছাদের নিচে।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে পরস্পর নিজ স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত সেখানে এতো দীর্ঘমেয়াদী বন্ধুত্বও সম্ভব! যেখানে পদোন্নতি, যশ-খ্যাতি সহ নানা ব্যক্তি স্বার্থ জড়িত সেখানে কিভাবে টিকে আছে বন্ধুত্ব!

এটা সম্ভব করেছে দু’জন মানুষ প্রফেসর খালেদ হোসেন এবং প্রফেসর জাহাঙ্গীর আলম সাউদ (লিটন)। এই দীর্ঘ পথচলায় যেখানে ব্যক্তি স্বার্থ নিয়ে সবাই ব্যস্ত সেখানে তাঁরা অনন্য।

সম্মানিত অনুস্বরণীয় শিক্ষকদ্বয় কর্মরত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগে। একি ল্যাবে কাজ করলেও নেই দ্বিধা-দ্বন্দ। তাঁদের বন্ধুত্বের গল্পে পরস্পরের প্রতি সম্মানের বিন্দুমাত্র কমতি নেই।

প্রফেসর সাউদ ও প্রফেসর খালেদের বন্ধুত্বে কোন বিষয়টি পরষ্পরকে ঘনিষ্ঠ করেছে জানতে চাওয়া হলে উভয়ের বক্তব্য সমার্থক। উভয়ের বক্তব্যে ফুটে উঠে সততা, স্বার্থহীনতা, বিশ্বাস ও দায়িত্ববোধ।

প্রফেসর জাহাঙ্গীর আলম সাউদ জীবনের অকৃত্রিম বন্ধুর ব্যাপারে বলেন, খালেদ লোভ লালসার ঊর্ধ্বে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান একজন মানুষ। সে কর্মকে প্রাধান্য দেয়। খালেদ আমার কাছ থেকে কিছু পেয়েছে কিনা জানিনা কিন্তু আমি ওর কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছি।

যেটা আমার জীবন গোছাতে সাহায্য করেছে। হলে যখন একসাথে থাকতাম অনেক রাত শুধু গল্প করেই চলে গেছে আমাদের। এখনও একসাথে থাকার সুযোগ হলে নিজেদের মধ্যে গল্প করি পুরনো স্মৃতি স্মরণ করি।

বিশ্ববিদ্যালযে প্রথম থেকেই এখন পর্যন্ত যে সম্পর্কটা আমাদের মধ্যে আছে। আমি চাই মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত ওর সাথে আমার বন্ধুত্বটা অটুট থাকুক।

প্রফেসর খালেদ হোসেন তাঁর বন্ধুর সম্পর্কে বলেন, সাউদ অত্যন্ত সৎ। হি ইজ ভেরি অনেস্ট। তার অনেস্টি নিয়ে কারো কোন দ্বিমত থাকা উচিৎ না। তার অনেস্টিকে আমি ইমোশনালি রেসপেক্ট করি। অর্থনৈতিক ব্যাপারে এমন সৎ বন্ধু আমার জীবনে খুব কম দেখেছি।

সাউদকে আমার মা সন্তানের মতো দেখে। সে আমার পরিবারের ভালো মন্দের সাথে জড়িত। আমি বলব আমরা পরস্পরকে খুব ভালো চিনি। আমি জানি লিটনের জায়গা কোনটা। সেও জানে আমার জায়গা কোনটা। সে আমাকে রেসপেক্ট করে। সমানভাবে আমিও তাকে রেসপেক্ট করি।

প্রফেসর খালেদের জন্ম কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলায় এবং প্রফেসর লিটনের কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলায়। তাঁরা প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ১৯৮৮-১৯৮৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

১৯৯৪ সালে স্নাতক ও ১৯৯৬ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। উভয়ই মতিহার হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন, থেকেছেন পাশাপাশি রুমে। বন্ধুত্ব নিয়ে এরিস্টটল বলেছেন, ‘প্রতিটি নতুন জিনিসকেই উৎকৃষ্ট মনে হয়।

কিন্তু বন্ধুত্ব যতই পুরানো হয় ততই উৎকৃষ্ট ও দৃঢ় হয়।’ বন্ধুত্বের গল্পের ব্যতিক্রমী দুই বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। বেঁচে থাকুক তাঁদের বন্ধুত্ব, গড়ে উঠুক এমন বন্ধুত্ব।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে