রাজশাহীতে বৃষ্টিহীন বাতাসে আগুন

প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২৪; সময়: ১০:১১ অপরাহ্ণ |
রাজশাহীতে বৃষ্টিহীন বাতাসে আগুন

সরকার দুলাল মাহবুব: প্রায় মাসব্যাপি রাজশাহীসহ আশে-পাশের জেলায় বইছে প্রচন্ড দাবদাহ। বাতাসে যেন আগুন জ্বলছে। বিপাকে পড়েছেন কৃষক-শ্রমিকসহ খেটে খাওয়া মানুষ। একইসঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টির দেখা নেই। তীব্র তাপপ্রবাহে রাজশাহীর সব এলাকার খাল-বিল শুকিয়ে গেছে। অনেক স্থানে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সাধারণ নলকূপেও পানি উঠছে না। জীবকুলে তাহি তাহি অবস্থা বিরাজ করছে।

এদিকে বর্তমানে রাজশাহী জেলাসহ এ অঞ্চলে বোরো ক্ষেত বাঁচানোই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাওয়ায় সেচের আশংকা বাড়ছে। তবে বোরো আবাদে সেচ নিশ্চিতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে কার্যকরি পদক্ষেপ নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। যার ধারাবাহিকতায় ১৫ এপ্রিল রাজশাহী বিভাগের আরইবি’র এলাকায় চলমান সেচ মৌসুম ও গ্রীষ্মকালে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সংক্রান্ত মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের সম্মেলন কক্ষে রাজশাহী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আয়োজিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর। তিনি বছরে গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন লোডের চাহিদা ও প্রাপ্তির ভিত্তিতে দুই দফা মেজারমেন্টপূর্বক বন্টন রেশিও পুনঃনির্ধারণ করাসহ নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার আশ্বাস প্রদান করেন। এরপরেও দীর্ঘ খরায় কৃষক-চাষিদের সেচ নিয়ে ভাবনার শেষ নেই।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, গতবছরের চেয়ে এবারে জেলায় বেশী বোরো আবাদ হয়েছে।

গতবছর জেলায় চাষ হয়েছিল ৬৮ হাজার ৬৬০ হেক্টর (৫ লাখ ১০ হাজার ৮৩০ বিঘা)। এবারে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে বোরো আবাদ। জেলায় এবারে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল, ৭০ হাজার ১৬৫ হেক্টর। এ পর্যন্ত আবাদ হয়েছে ৭০ হাজার ২শো’ হেক্টর (৫ লাখ ২২ হাজার ২৮৮ বিঘা) জমিতে। এছাড়াও জেলায় রয়েছে বিভিন্ন সবজির আবাদ প্রায় ৯ হাজার হেক্টর ( প্রায় ৬৭ হাজার বিঘা)।

অপরদিকে প্রচন্ড গরমে শ্রমজীবীরা ক্ষেতে এক বেলার বেশি কাজ করতে পারছেন না। অনেক কৃষক অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে গোটা জেলার কৃষি। চাষিরা খরার হাত থেকে জমির ফসল রক্ষায় সেচ দিতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছেন। ক্ষেতের ফসল বাঁচাতে অন্য বারের তুলনায় তিন গুণ বেশি সেচ দিতে হচ্ছে, যার ফলে উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। আর অনিয়ন্ত্রিত পানি উত্তোলনে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছরই অস্বাভাবিক হারে নিচে নামছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজশাহী আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, সপ্তাহজুড়ে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি বা এর আশেপাশে ওঠানামা করছে। সোমবার (২০ এপ্রিল) বেলা ৩টায় জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া বাতাসের আর্দ্রতা ১৪-১৫ তে ঘোরাফেরা করছে। আর্দ্রতা বেশি থাকায় ভ্যাপসা গরমে জনজীবনে নেমে এসেছে তীব্র অস্বস্তি।

স্থানীয় চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাসখানেক থেকে বৃষ্টি হয়নি। প্রকৃতির বিরূপ আচরণে তারা চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। আর বোরো আবাদ নিয়ে দুঃস্বপ্ন তাদের তাড়া করছে। ক্ষেত বাঁচাতে বৃষ্টির গুনছেন তারা। গত বছরও দীর্ঘতম খরার কবলে পড়ে তারা ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এক বছরের মাথায় আবার খরার কবলে পড়ে তারা মহাসংকটে। তারা জানান, গভীর নলকূপের মাধ্যমে বোরো জমিতে সেচ দেওয়া হলেও ভুট্টা, পাট ও অন্যান্য সবজির জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।

পবা উপজেলার তেঘর গ্রামের চাষি আফাজ উদ্দিন সরকার বলেন- ‘ধান, পাট, ভুট্টার আবাদ করেছি। ২-৩ বার সেচ দিয়েছি। আবার ধান ক্ষেতে প্রায় দিনই সেচ দিতে হচ্ছে। প্রচন্ড খরায় ক্ষেতে পানি দিতেই নাই হয়ে যাচ্ছে। কাজের কাজ হচ্ছে না। আবার পানি কম উঠাই এবং সময় বেশী লাগাই খরচ বেশী হচ্ছে। এতে করে আমরা পোষাতে পারছি না। এভাবে সেচ দেওয়ার পর যে ফসল পাবো তাতে উৎপাদন খরচ উঠবে না।

কৃষি শ্রমিক রবিউল ইসলাম জানান, তীব্র গরমের জন্য তারা জমিতে অস্থির হয়ে কাজ করতে পারছেন না। কাজ ফেলে ক্ষেত থেকে চলে আসতে হচ্ছে। তার মত অন্যান্য শ্রমিকরাও সারাদিন কাজ করতে পারছেন না। এতে তাদের সংসারের খরচ চালাতেও সমস্যা হচ্ছে।

ওই গ্রামের চাষিরা জানান, গভীর নলকূপগুলো থেকে চাহিদার অর্ধেক পরিমাণ পানি উঠছে। এ ছাড়া অগভীর নলকূপগুলোতে শুধু রাতের বেলায় কিছুটা পানি পাওয়া যায়। এতে মাঠের খাল-বিলে গভীর নলকূপের পানি কিছুটা জমা হলেও তা মুহূর্তেই শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে মাঠের জমিতে পানি সেচ দিতে পারছে না কৃষক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কৃষিবিদ বলেন, ধান চাষের সময় সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর যদি ওঠে, তাহলে চিটার পরিমাণ বেশি হতে পারে। এ মুহূর্তে অনেকের মাঠের ধানে থোড় এসে পড়েছে, এখন ক্ষেতের মধ্যে কমপক্ষে দুই ইঞ্চি পানির ধারা থাকতে হবে। কিন্তু তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে চাইলেও সেই পানির প্রবাহ ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাপমাত্রা বেশি থাকার কারণে ধানের ফুল পলিনেশন করতে পারছে না, অনেক ফুল ঝরে যাচ্ছে। একারণে ধারণা করা যায়, ধান চাষে গড়ে ৩০ শতাংশের মতো ক্ষতির মুখে পড়তে পারে কৃষক।

পবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ফারজানা তাসনিম বলেন, ‘সেচ নিয়ে এই উপজেলার কোথাও কোন ধরণের ব্যত্যয় ঘটেনি। এখন পর্যন্ত বোরোসহ সমুদয় আবাদ ভাল আছে। কৃষককে বোরো ক্ষেতে পানি রাখতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। আবাদ নিয়ে কোন ধরণের অসুবিধায় পড়লে দায়িত্বে থাকা উপ-সহকারি কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানানোর কথা বলা হয়েছে’।

রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মরিয়ম আহমেদ বলেন, ‘দীর্ঘদিন বৃষ্টি না থাকলে তাপমাত্রা বাড়বে-এটা স্বাভাবিক। তবে এই উপজেলায় কৃষি, বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বিদ্যুৎ বিভাগের কার্যকরি পদক্ষেপে বোরো ক্ষেতে সেচের কোন ঘাটতি হয়নি। মাঠে ধান কাটা শুরু হয়েছে। ১০-১৫ দিনের মধ্যে পুরোদমে ধান কাটবে চাষিরা। ঝড়-শিলা না হলে চাষিরা শতভাগ ধান ঘরে তুলতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন’।

পবা উপজেলা বরেন্দ্র বহুমূখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) কর্মকর্তা প্রকৌশলী জামিলুর রহমান বলেন, ‘দীর্ঘ খরায় কিছুটা হলেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টি না থাকায় পানির স্তর নেমে যাওয়ায় উপজেলার অনেক নলকুপ আবারো নতুনভাবে স্থাপন করে সেচের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আশানুরুপ বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকায় পানি কম উঠলেও চাষিরা পুষিয়ে নিতে পারছেন। এখন পর্যন্ত আবাদ ভাল আছে’।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাজশাহীর উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) উম্মে সালমা বলেন, ‘খরা বা অনাবৃষ্টি একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এতে কারও কিছু করার নেই। তারপরও চাষিদের ক্ষতি পোষাতে নানা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। জমিতে সেচ চালু রাখার জন্য বলা হচ্ছে। আর সেচের জন্য বিদ্যুৎ যেন নিরবচ্ছিন্ন থাকে সে ব্যাপারে বিদ্যুৎ বিভাগসহ বিএমডিএ’র সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করায় আশানুরূপ সুফল পাওয়া যাচ্ছে’।

রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, জেলায় এবারে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল, ৭০ হাজার ১৬৫ হেক্টর। এ পর্যন্ত আবাদ হয়েছে ৭০ হাজার ২শো’ হেক্টর (৫ লাখ ২২ হাজার ২৮৮ বিঘা) জমিতে। যার মধ্যে পবা উপজেলায় ৫ হাজার ৮৩৭ হেক্টর, মোহনপুর উপজেলায় ৭ হাজার ৭৮ হেক্টর, তানোর উপজেলায় ১৪ হাজার ২৬০ হেক্টর, গোদাগাড়ী উপজেলায় ১৬ হাজার ৬৮০ হেক্টর, বাগমারা উপজেলায় ১৭ হাজার ৯৬৮ হেক্টর, পুঠিয়া উপজেলায় ২ হাজার ৭৫০ হেক্টর, দুর্গাপুর উপজেলায় ৪ হাজার ২৯৭ হেক্টর, চারঘাট উপজেলায় ৩১৫ হেক্টর, বাঘা উপজেলায় ৯৭৭ হেক্টর, মতিহার ও বোয়ালিয়ায় ৩৮ হেক্টর। এছাড়াও জেলায় রয়েছে বিভিন্ন সবজির আবাদ প্রায় ৯ হাজার হেক্টর ( প্রায় ৬৭ হাজার বিঘা)।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে