পদোন্নতি ও পদায়ন জটিলতায় পুলিশে চাপা ক্ষোভ

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৯, ২০২৪; সময়: ৮:৫৭ অপরাহ্ণ |
পদোন্নতি ও পদায়ন জটিলতায় পুলিশে চাপা ক্ষোভ

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : পুলিশের পদোন্নতি ও পদায়নের জট খুলছেই না। অনেক কর্মকর্তা প্রায় এক বছর আগে পদোন্নতি পেলেও তাদের র‌্যাঙ্ক ব্যাচ পরানো হয়নি। এমনকি পদায়ন না হওয়ার কারণে একই পদে বহাল থাকছেন। এসব কারণে অনেকের মধ্যে চাপা উত্তেজনা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। একই ক্ষোভ রয়েছে পিএলে (প্রমোশন লিস্ট) থাকা প্রায় ২ হাজার পদোন্নতি বঞ্চিত এসআই থেকে পরিদর্শক। এরই মধ্যে সুপারনিউমারারি পদ সৃজনের জন্য ৩৫০টি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ৩০০টি এএসপিসহ ৬৫০টি পদ গতকাল রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স।

এর আগে যারা সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি পেয়েছেন তাদের সিংহভাগই পদায়ন জটিলতায় ভুগছেন। আবার বিশেষ স্বার্থের কারণে ঊর্ধ্বতনদের আশীর্বাদপুষ্ট একাধিক জেলার পুলিশ সুপার ও বিশেষ জায়গায় অবস্থানরত কর্মকর্তারা তাদের পুরোনো পদে থাকার আগ্রহ দেখানোর কারণে পদোন্নতি পাওয়া অন্য কর্মকর্তারা পদায়ন বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে প্রস্তাবিত ৬৫০ জনের পদোন্নতির জন্য সরকারের বার্ষিক অতিরিক্ত খরচ দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৭১ লাখ ৮৭ হাজার ৮৭৭ টাকা। একই পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে ১ হাজার ৬৫৪টি পিএএলভুক্ত পরিদর্শকের (নিরস্ত্র-সশস্ত্র) ও (শহর ও যানবাহন) চাকরির মেয়াদ প্রায় শেষ পর্যায়ে হওয়ায় তাদের মধ্যে ৩০০টি সুপারনিউমারারি পদ সৃজনের জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়। তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে ষষ্ঠ গ্রেডে থাকার কথা থাকলেও তারা ৯ম গ্রেডেই বেতন-ভাতা পাবেন।

সুপারনিউমারারিতে পদোন্নতি পাওয়া কয়েকজন অতিরিক্ত ডিআইজির সঙ্গে কথা হলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, পদোন্নতি পেলেও এখনও অনেকের র‌্যাঙ্ক ব্যাচ দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া বিশেষ আর্শীবাদপুষ্ট কর্মকর্তাদের কারণে পদায়ন জটিলতাও আটকে আছে। এমন পরিস্থিতে ছোট-বড় সব পদেই অস্থিরতা বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে পুলিশ সার্ভিস

অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি হলেও এখনও অনেক কর্মকর্তার পদায়ন হয়নি। তবে আমরা আশাবাদী, সরকারের কাছে শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান করবে। পদোন্নতি পাওয়ার পরও বিশেষ সুবিধায় একাধিক জেলা পুলিশ সুপার ও বিভিন্ন ইউনিটে থাকা কর্মকর্তাদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার পদায়ন না করলে এসপিরা বড় পদে যাবেন কীভাবে। এই অভিযোগ সত্য নয় বলে তিনি জানান।

এদিকে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর থেকে পরিদর্শক পদে। প্রায় ২ হাজার এসআইকে পিএলভুক্ত করে পদোন্নতির তালিকা করা হলেও আদৌ তারা কবে নাগাদ পদোন্নতি পাবেন তা নিশ্চিত নয়। এ ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের পুলিশের মধ্যে চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

একাধিক পিএলে থাকা এসআইয়ের সঙ্গে কথা হলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ক্যাডারদের সহজেই পদোন্নতি-পদায়ন করা হচ্ছে। অথচ একই পদে থেকে নন-ক্যাডাররা মাঠ পর্যায়ে কাজ করলেও তাদের পদোন্নতি হয় না ১০-১২ বছর। এ ছাড়াও এসআই পদে দশম গ্রেড থেকে পরিদর্শক পদে ৯ম গ্রেড আনা হলে তাদের বেতন থেকে ঝুঁকিভাতা কেটে যাবে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকা। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতি হলে ষষ্ঠ গ্রেডে উত্তীর্ণ হবে। প্রতিটি পরতে পরতে নন-ক্যাডারদের জটিলতার সৃষ্টি করা হচ্ছে।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স সূত্র জানায়, সুপারনিউমারারি পদে ক্যাডারদের ৬৫০ জনের জন্য সুপারিশ পাঠানো হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। এ ছাড়াও ৩০০ জন পরিদর্শকদের জন্য সুপারনিউমারারি হিসেবে পদোন্নতির জন্য আবেদন করা হয়েছে।

সুপারিশপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন পদবির ক্যাডার পদ বৃদ্ধির পরও পদোন্নতি জন্য অপেক্ষমাণ কর্মকর্তাদের সংখ্যার তুলনায় তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে কোনো একটি ব্যাচ থেকে খুবই সীমিত সংখ্যক কর্মকর্তা পদোন্নতি পান এবং একই ব্যাচে অনেক কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত থাকেন। এ সমস্যা সমাধানের ৩৬৫টি সুপারনিউমারারির পদ সৃজন করা হয়েছে। ফলে এসপি থেকে তারও ঊর্ধ্বতন পদে পদোন্নতি বিদ্যমান সমস্যা অনেকাংশে লাঘব হয়েছে। কিন্তু এএসপি এবং অতিরিক্ত এসপি পদে এ সমস্যা রয়ে গেছে। এএসপি থেকে অতিরিক্ত এসপি পদে ভবিষ্যতে শুধু অবসর বা মৃত্যুজনিত প্রকৃত শূন্যপদের বিপরীতে পদোন্নতি দিলে বহু সংখ্যক এএসপি পদোন্নতি বঞ্চিত হবে এবং পদোন্নতি একপ্রকার স্থবির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫তম বিসিএস (২০১৭) পদোন্নতি প্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন মোট ক্রমাযোজিত ১১৪ জন। তাদের সাত বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও পদোন্নতি পায়নি।

৩৬তম ব্যাচের (২০১৮) রয়েছেন ১১৩ জন। ছয় বছর পূর্ণ হলেও পদোন্নতি হয়নি। ৩৭তম ব্যাচের (২০১৯) রয়েছে ৯৭ জন। তাদের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। বিভাগীয় পদোন্নতিসহ মোট ৩৮৩ জন পদোন্নতি অপেক্ষায় ঝুলে আছে বছরের পর বছর। কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, প্রশাসন ক্যাডারসহ অন্যান্য ক্যাডারে ৩৭তম ব্যাচের পদোন্নতি সম্পন্ন হয়েছে।

জননিরাপত্তা বিভাগে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ৩৮৩ জনের পদোন্নতি ও পিএলজনিত কারনে শূন্যপদের বিপরীতে পদোন্নতি প্রদান করা হলে ৩৫তম বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি সম্পন্ন হবে ২০২৭ সালে এবং ৩৭তম কর্মকর্তাদের সময় লাগবে ২০৩০ সালে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে ঊর্ধ্বতন ধাপে প্রয়োজনীয় সংখ্যক না হওয়া পর্যন্ত সুপারনিউমারারি হিসেবে ৩৫০টি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গ্রেড-৬ পদে সৃজন করা প্রয়োজন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। একইভাবে পরিদর্শক থেকে এএসপি পদে ভবিষ্যতে শুধু অবসর বা মৃত্যুজনিত শূন্যপদের বিপরীতে পদোন্নতি প্রদান করা হলে বহু সংখ্যক ইন্সপেক্টর পদোন্নতি বঞ্চিত হবে এবং পদোন্নতি প্রায় স্থবির হয়ে পরবে। তাদের মধ্যে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৯ সালে চাকরিতে যোগদান করেছেন অনেকে। তাদের চাকরির বয়স হয়েছে ২৫ থেকে ৩৩ বছর পর্যন্ত। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে অধিকাংশ পরিদর্শক অবসরে চলে যাবেন। ২০২৮ সাল পর্যন্ত এএসপি পদে যে কয়টি শূন্যপদ সৃষ্টি হওয়ার কথা সে তুলনায় অপেক্ষমাণ কর্মকর্তা তুলনামূলক খুব কম।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক পরিদর্শক মাজহারুল ইসলাম জানান, সম্প্রতি আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিকে জানিয়েছি, যেন আমার দিকটাও তারা দেখেন। পুলিশ ক্যাডার থেকে ১৫ বছরে তারা চারটি পদোন্নতি নিচ্ছেন। আমাদের চাকরির মেয়াদ ৩০ বছর। এসআই পদেই ১৫ বছর পেরিয়ে যায়। এরপর পরিদর্শক পদ থেকে ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও একটি পদোন্নতি হয় না। অথচ প্রায় ২ হাজার পরিদর্শক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে প্রমোশন লিস্টে (পিএল) থাকলেও সেখান থেকে বেরোতে পারছেন না।

তিনি বলেন, রোববার সুপারনিউমারারির জন্য পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। আমাদেরও যেন কোটা অনুযায়ী পদোন্নতি দেওয়া হয় আমরা সেই প্রত্যাশা করছি। আমাদের বেলায় যেন পদ বৈষম্য না হয় এটিই অনুরোধ। মাজহারুল ইসলাম আরও বলেন, যারা প্রায় শেষ বয়সের তাদের জন্য ৩০০ জনের মতো পদ সৃজন করা হচ্ছে বলে শুনেছি। সেটি হলেও অনেকটা মর্যাদাপূর্ণ হবে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে