অতল জলে জলাঞ্জলী প্রথম পর্ব “এই তো বাবা!”
এ কে সরকার শাওন: বাংলাদেশের সংস্কৃতির রাজধানী বলে খ্যাত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা। এই জেলায় মেঘনা-তিতাস বিধৌত নবীনগর উপজেলার আড়াই মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি বৃহৎ গ্রাম গোপালপুর। মূল গ্রাম থেকে উত্তরে তিনটি পাড়া যথাক্রমে সাদেকপুর, আয়তলা ও কান্দি। এই পাড়াগুলোও যেন এক একটি গ্রাম। ছায়া ঢাকা সুন্দর সবুজ শ্যামল গ্রামটি এক কথায় চমৎকার। যেন এক টুকরো বাংলাদেশ।
এই গ্রামের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি এ কে সরকার শাওন লিখেছেন,
“সমতটের রূপসী তন্বী
গোপালপুর তার নাম!
সারি সারি সুন্দর বাড়ি
শত গুনী মানীর ধাম!”
এই গ্রামের মাঝে একটি বাজার আছে। এই বাজারের একটি বৈশিষ্ট্য হলো শতকরা নিরানব্বই ভাগ ক্রেতা ও বিক্রেতা এই গ্রামেরই বাসিন্দা। মহাবিদ্যালয় ও বিদ্যালয়গুলোতেও তাই। গ্রামে শনি ও মঙ্গলবার হাট বসে। এই গ্রামের চারদিকে চারটি বৃহৎ চক আছে। এই চকগুলোর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ কখনো ধূসর, কখনো সবুজ, কখনো হলুদ আবার কখনো সোনালী বর্ণ ধারণ করে।
গ্রামের মাঠে বিকেলে ছেলেরা বল খেলে। মুরুব্বীরা সবুজ ঘাসের গালিচায় বসে খেলা উপভোগ করে। মাঠের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে বেশ আড্ডা জমে। আড্ডা অবশ্য প্রতিটি চায়ের দোকানেও জমে। কিন্তু মাঠের আড্ডাটা উন্নত মানের। এই আড্ডায় সাধারণ চিকিৎসা, প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ও শিক্ষকদের । সেখানে আলোচনায় আসে সমকালীন দেশের সংবাদ, রাজনীতি, ভারতবর্ষ, বিশ্ব সংবাদ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে।
বর্ষাকালে গ্রামের সকল রাস্তা জলে ডুবে যায়। তখন চলাচলের একমাত্র সম্বল নৌকা। গয়না নোকা দিয়ে নবীনগরে বা দূরের কোন গ্রামে যাওয়ার মজাটাই আলাদা। বিশ পঁচিশ জন ছেলেরা একটা দল করে মাসচুক্তি নৌকা ভাড়া করে আড়াই মাইল দূরে নবীনগরে পড়তে যায়। কেউ উচ্চ বিদ্যালয়ে কেউ বা মহাবিদ্যালয়ে। এই দলটি মাঠের জল নেমে গেলে বিভিন্ন খেলাধুলায় মেতে ওঠে। শীতকালে নাটক ও সংস্কৃতির চর্চা করে। এই গ্রামের সামপ্রদায়িক সম্প্রীতি চমৎকার।
গ্রামের চারিদিকে জালের মত ছড়িয়ে আছে খাল।
গ্রামের পশ্চিমে বয়ে গেছে বিশাল মেঘনা নদী। গ্রামের উত্তরে ভাঁটা নদী ও বিশাল বিল। বর্ষাকালে বিলের সৌন্দর্য দেখতে বহু দূর থেকে মানুষজন বেড়াতে আসে। জগলুরা মুগ্ধ হয়ে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এই বিলের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে কবি এ কে সরকার শাওন লিখেছেন
সৌন্দর্যে টুইটুম্বুর রূপে ভরপুর
নান্দনিক ছোঁয়া সর্বত্র নির্বিশেষ;
ছবির মত দেশ প্রিয় স্বদেশ
অপরূপা রূপসী বংলাদেশ!
এই গ্রামের দুরন্ত ও খেয়ালী ছেলে জগলুল হায়দার সরকার। সে ছোট বেলায় মা’কে হারায়। বহু কষ্টে তার পিতা হাসান হায়দার সরকার তাকে উচ্চ শিক্ষার দরজায় নিয়ে গেছে। আজ সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে পড়াশোনা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ইতিহাসে তার হয়েছিল। কিন্তু জগলুর বিষয় পছন্দ না হওয়াতে বহুদূরে যেতে হলো। বাবার চোখের মনি ও অন্ধের ষষ্ঠী জগলু আজ চলে যাচ্ছে ২১২ মাইল দূরে রাজশাহীতে। প্রতিবারই রাজশাহী যাবার সময় বাড়ীর সকলে মন খারাপ করে।
উত্তর পাড়ার চন্দ্রিমা ফুফু কতগুলো পাক্কন পিঠা বানিয়ে এনে জগলুর থলেতে ঢোকাচ্ছে।
জগলুঃ ফুফু, এগুলো কেন দিচ্ছো? থলেটা ভারী হয়ে যাচ্ছে তো!
চন্দ্রিমাঃ হোক ভারী! একটু কষ্ট করে নিয়ে যা বাপ। পথে ক্ষিদে লাগলে বা ছাত্রাবাসে রাত-বিরাতে খেতে পারবি। প্রতি সাপ্তাহে চিঠি লিখবি। তোর বাপের খবরা-খবর নিবি।
জগলুঃ আচ্ছা
বাবা বললো
-আচ্ছা আচ্ছা এবার চল। এখন না রওয়ানা দিলে মানিকনগর থেকে দশটার লঞ্চ পাবি না। ভালো করে পড়াশুনা করিস বাবা, আমাদের জন্য কোন চিন্তা করবি না।
জগলুঃ বাবা নৌকা কোথায়?
হাসানঃ আমাদের বামনা পুকুরের পশ্চিম জানে। হুরার নৌকা। ছৈয়া নাই তাই দুইটা ছাতা নিছি।
জগলুঃ বাবা, এই গরমে তোমার মানিকনগর যেতে হবে না। আমি একলা যাবো। তুমি ঘরে বিশ্রাম করো।
হাসানঃ না যাবো, তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
জগলুঃ আর একটা কথা বাবা;
হাসানঃ কি?
জগলুঃ কৃষিকাজ মুনি-মজুর দিয়ে করাবে। তোমার কোন পরিশ্রম করার দরকার নাই বাবা।
হাসানঃ আচ্ছা!আচ্ছা! এবার চল নৌকায় উঠি।
ওরা বাপ বেটা একটু হেঁটে পুকুরের পাড়ে জানের নিকট গিয়ে নৌকায় উঠলে
হুরা কাকা বললো
-ভাতিজা নৌকার গলুইয়ে একটু জল দাও।
জগলু নৌকার গলুইয়ে জল দিল। এর পর হুরা কাকা নৌকা ছাড়লো। বাঁশের লম্বা ছৈড় দিয়ে নৌকা বাইতে লাগলো। সন্মুখে একটি কাঠের বৈঠাও আছে।
জগলু ভাবলো কী কুসংস্কার নৌকার গলুইয়ে জল না দিলে না-কী অমঙ্গল হবে!
নৌকা টলটলে পানি দিয়ে গোপালপুরের মাঝ বরাবর খাল দিয়ে সোজা কান্দির দিকে চললো। কান্দি ডানে ফেলে নৌকা ভাঁটা নদীতে পড়লো। এবার হুরা কাকা বৈঠা বাইতে লাগলো কারন ছৈড় এখানে ঠাঁই পাবে না।
জগলু জানে এবার হুরা কাকা ওকে প্রশ্ন করবে
-হেইও ভাতিজা, রাজশাহী যাইতে তোমায় কয় দিন লাগবো?
হুরা কাকার কিচ্ছু মনে থাকে না। এই একই প্রশ্নের জবাব সে আরো দুই একবার দিয়েছে। আজও দিচ্ছে
-বাড়ী থেকে মানিকনগর ১ ঘন্টা। মানিক নগর থেকে নরসিংদী ২ ঘন্টা। নরসিংদী থেকে গাবতলী ঢাকা ৩ ঘন্টা। গাবতলী থেকে আরিচা ঘাট মানিকগঞ্জ ৩ ঘন্টা । তারপর পদ্মা নদী লঞ্চে পার হতে ৪ ঘন্টা, এরপর নগরবাড়ী পাবনা থেকে ৬ ঘন্টা এই হলো ১৯ ঘন্টা। আরো ২ ঘন্টা অতিরিক্ত যোগ করলে দাঁড়ায় একুশ ঘন্টা। তার মানে আগামীকাল ভোরে আমি রাজশাহী পৌঁছেবো।
হুরা কাকাঃ বাবারে বাবা কতদূর!
নৌকা আয়তলা জেলেপাড়া দিয়ে মেঘনায় পড়লো। এবার হুরা কাকা পাল তুলে দিলো। পরিশ্রম কমে গেলো। হালে জল পেলো। পালে বাতাস লাগলো। হুরা কাকা শক্ত করে হাল ধরে গান গাইতে লাগলো। জগলু নদীর দৃশ্য দেখার বাহানায় চুপ করে চেয়ে রইলো নদীর ওপারে রায়পুরার গ্রামগুলির দিকে। জগলুর বাবা হাসান একটি কথাও বললো না। যেদিন ছেলেটা রাজশাহী যায় সেদিন যেন তার শোকের দিন। যেদিন ছেলে রাজশাহী থেকে বাড়ী আসবে তার সাতদিন আগে থেকে বাড়ীতে ইদ শুরু হয়।
মানিকনগর এসে অপেক্ষা করে কখন নবীনগরের দিক থেকে লঞ্চ আসে। লঞ্চ এলে বাবার সাথে হুরা কাকাও লঞ্চে উঠে দোতলার কক্ষে মালামাল রেখে দু’জনে অপেক্ষা করবে কখন লঞ্চ ছাড়বে। ছাড়ার ভেঁপু বাজলে জগলু লঞ্চের অগ্রভাগে এসে দাঁড়ায়। লঞ্চ ছেড়ে দিলে চোখের জল মুছতে মুছতে বাবা নৌকায় ওঠে। একমাত্র ছেলেকে বিদায় দিয়ে শক্তিহীন বাবা নৌকার মাচায় শুইয়ে পড়ে। জগলু ভাবে নিশ্চয়ই হুরা কাকা আমার বিজ্ঞ বাবাকে নানান উপদেশ দিচ্ছে দুঃখ না করার জন্য। কমপক্ষে দু’দিন বাবা মনমরা হয়ে থাকবে। বাবাকে ভেবে ভেবে জগলুর চোখও ছলছল হয়ে যায়। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বগতোক্তি করবে
-এই তো বাবা!
এই তো বাবা!
উপন্যাসঃ অতল জলে জলাঞ্জলী
এ কে সরকার শাওন
শাওনাজ ভিলা, উত্তরখান, ঢাকা।