অতল জলে জলাঞ্জলী দ্বিতীয় পর্ব “বাড়ী ও বাবার কথা”

প্রকাশিত: ০৩-১০-২০২৪, সময়: ১০:৪০ |

এ কে সরকার শাওন : জগলু রাজশাহী এসে নিয়মিত শ্রেণি করতে লাগলো। সে ছাত্রাবাস থেকে খুব একটা বাহিরে যায় না । বড়জোড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকগুলোর বাহিরের রাজপথ পর্যন্ত। মাঝে মাঝে বিভিন্ন চত্বরে ঘুরে আসে একা একা। পড়াশোনায় সে কোন ফাঁক রাখে না। কোন বিষয়ে আঁটকে গেলে রাজশাহী প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়ে চাচাতো খায়ের ভাইয়ের কাছে যায়। তিনি ত্বরিত সমাধান করে দেন।

এবার বাড়ী থেকে আসার পর এক মাস হয়ে গেলো। আজ পড়ন্ত বিকেলে জোহা ছাত্রাবাসের সামনে বসে জগলু বাড়ীর কথা ভাবতে লাগলো। বাড়ী থেকে আসার পর সাতদিন লাগে তার ধাতস্থ হতে। নিশ্চয়ই বাবাও এরকম করে। দু’টি মানুষের মনের মাঝেও অবশ্যই নিউটনের তৃতীয় সূত্র কাজ করে।

বর্ষাকাল শেষ হয়েছে কুড়ি দিন আগে। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে ভাঁটার পানি লালচে রং ধারন করে। নিশ্চয়ই এখন খালের পানি নেমে যাচ্ছে । বন্ধুরা হয়তো খালে পলো বা ঠেলা জাল বা ঝাঁকি জাল দিয়ে মাছ ধরছে। ক’দিন পর দল বেঁধে বিলেও মাছ ধরতে যাবে। মাছ ধরতে জগলুর খুব ভালো লাগে। এই জন্য বাবা তাকে একটা ঝাঁকি জালও কিনে দিয়েছেন। গতবার এই দিনে দক্ষিণ পাড়ার আমীর আলী, মোবারক ও জসিমের সাথে উছা বাইছিলো। বাইম, গুতুম, টেংরা ও ছোট ছোট চিংড়ি পেয়েছিলো।

এতোদিনে খেলার মাঠ থেকেও হয়তো পানি নেমে সবুজ মখমলে ঘাস গজিয়েছে। যেখানেই যাক না কেন বাড়ী ফিরে গায়ের মাঠের কোমল ঘাসে বসে বন্ধুদের সাথে প্রানবন্ত আড্ডার মত লোভনীয় জিনিস জগলু আর খুঁজে পায় না। আর আজ সে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে একা একা চলাফেরা করে। হায়রে পড়াশোনা! এর জন্য জগলুর জীবনের অনেক সুখ জলে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে! পরে সে বই পড়ে চীনের রাজারাকে পড়ালেখার আবিষ্কারক বলে জেনেছে। আরো মর্মান্তিক কাজটি করেছিলো পরীক্ষা চালু করে এক মার্কিনী। যার নাম হেনরি ফিশেল। তা না হলে জগলু বাড়ীতে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতো, নৌকা চালিয়ে মেঘনায় দোলতো, বিলে মাছ ধরতো, গঙ্গা ফড়িং, ঘাস ফড়িং ও প্রজাপতির পিছু নিয়ে দূরের কোন গায়ে হারিয়ে যেতো। ফুল, পাখি, লতা-পাতার সাথে বন্ধুত্ব করে চিরকাল বাড়ি থাকতো। তাহলে বাবাও বাড়ীতে তার জন্য মনমরা হয়ে থাকতো না।

জগলু হিসেব করে দেখেছে পড়াশুনার জন্য প্রতি মাসে যা খরচ হয় তার সাথে পড়াশুনা না করে কিছু আয় করে যে টাকা পাওয়া যায় এই দু’টি যোগফল করে যে সম্মিলিত টাকা পাওয়া যায় তা যদি প্রতিমাসে একটি ব্যাংকে রাখা হয় তাহলে কুড়ি বৎসরে যে টাকা জমবে তাতে জীবনটা হেসে খেলে চলে যাবে। সৎপথে থেকে ৩৩ বছরে তা আয় করা সম্ভব নয়।

পৃথিবীতে বাবা ছাড়া আর জগলুর আর কে আছে ? জগলু আত্মীয়দের কাছে শুনেছে তার স্বাধীনচেতা বাবা প্রথম জীবনে বীমা কোম্পানিতে চাকরী করতো। তখন না-কি বাবা লাহোরে মা’কে নিয়ে গিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে বিমানে লাহোর। সেখানে জগলুর বড় বোনের জন্ম হয়। বাবা নাম রেখেছিলো সুলতানা মমতাজ বেগম। পাকিস্তানীরা বাঙ্গালীদের সকল ক্ষেত্রে হেয় প্রতিপন্ন করতো বিধায় বাবা দেশে ফিরে আসেন। তখন না-কী দেশে ছাত্রদের আন্দোলন তুঙ্গে ছিলো। দেশে আসার পরের বছর জগলুর জন্ম হয়। একই বছরই বাবার নাকী খাদ্য পরিদর্শক হিসাবে চাকরী হয়েছিল। বিক্রমপুর সদরে ও সিলেটের ছাতকে চাকরী করেছিলো সাত/আট বছর।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চাকরী ছেড়ে যুদ্ধে যুক্ত হন বাবা। এর আগে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে ৭ মার্চ ছাতক থেকে ঢাকায় এসে পরদিন আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে বাড়ী গিয়েছিলেন। যুদ্ধ চলাকালে জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষের দিকে বাবা একবার বাড়ী এসেছিলো। মুখভর্তি কালো দাড়ি ছিলো। বাবাকে চেনা যাচ্ছিল না। তখন বাড়ীতে আরও তিন/ চারজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলো। ওরা চারজন মিলে বাড়ীর সবাইকে বলে দিয়েছিলো পাকসেনাদের সন্দেহ দূর করতে সকলের বাড়ীতেই যেন পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করে রাখে। তারপর আমাদের বাড়ীতে ঘরে ঘরে পাকিস্তানী পতাকা লাগিয়েছিলো। ১৭ ডিসেম্বর সবগুলো জড় করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করেছিলো।

একাত্তরে একদিন বাবা আর উত্তর পাড়ার চন্দ্রিমা ফুফুর স্বামী মানে মালেক ফুফাকে নিয়ে মানিকনগরের আড়ংয়ে গেলেন বড় মাছ কিনতে। আড়ং মানে প্রত্যুষের স্বল্প সময়ের বাজার। এমন সময় গতি নৌকায় মেঘনা নদী দিয়ে মানিকনগরে কতগুলো পাকসেনা নামলো। মাছ কেনার সময় বাবা ও ফুফাকে পাকড়াও করলো পাক সেনারা। বাবা তার ভগ্নীপতিকে আস্তে আস্তে বললেন স্বাভাবিক থাকতে।

ওরা মেঘনা নদীর পাড় ঘেঁষে মানিকনগরের পূর্ব পাশের গ্রাম নাসিরাবাদে যাবে মুক্তি ধরতে। কিন্তু গুলির বাক্স পেঁটরা বহন করার জন্য দু’জন সুঠামদেহী লোক চাই কারন কুলি নাই, এমনকি যানবাহনও নাই। আড়ংয়ের অন্যরা পালাতে পারলেও যারা পণ্যে কেনা বেচায় বিভোর ছিলো তারা ধরা পড়েছে। পাকসেনারা এদের কাউকে চড় মারছে, কাউকে গুলি করে নদীতে ফেলছে, কাউকে সঙ্গীন দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে। কাউকে সামরিক শক্ত জুতার নীচে পিষে মারছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সবুজ-শ্যামল মানিকনগর একটি রক্তাক্ত নরকে পরিণত হলো।

বাবা এবং ফুফাকে ওদের দলে নিয়ে কুলির কাজ করাবে। তাই আগে দু’জনার মুসলমানিত্বের নিদর্শন দেখে নিলো। পরে কলেমা ও সুরা পড়তে বললো। উপরোক্ত দু’টি পরীক্ষায় পাশ করার পর তাদের দেশপ্রেমের পরীক্ষা নিতে দলনেতার কাছে নিলো। দলনেতা পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত গাইতে বললো।

পাকসার জমিন সাদ বাদ দু’জনেই সমস্বরে চমৎকার ভাবে গাইলো। উপরন্তু বাবা এক সময় লাহোর অবস্থানের কথা জানালো। লাহোর থাকার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ওদের সাথে উর্ধু ভাষায় কথা বললো।
তাতে দলনেতা খুশী হয়ে বললো
-এ দোনো লোগ সাচ্চা পাকিস্তানি!
বহুত আচ্ছা মুসলমান ভি হ্যায়!

তখন তাদের চোখ খুলে দিয়ে বড় বড় দু’টি গুলির বাক্স মাথায় দিয়ে হাঁটতে বললো। ইতিমধ্যে হাঁটতে হাঁটতে ওদের সাথে দু’জন রাজাকার ও যোগ দিয়েছে। মাথার বোঝা ভারী হওয়ায় ওরা পিছনে পড়ে গেলো। ফুফা একজন রাজাকারকে মিনতি করে বললো
-জনাব, মাথায় খুব লাগছে
রাজাকার এক ধমক দিয়ে বললো
-শালা, গেঞ্জি খুলে মাথায় দে!
রাজাকারদ্বয় পাকিস্তানিদের খুব চামচামি করাতে ওরা হাসি তামাশায় মত্ত হয়ে বেশ এগিয়ে গেলো। ওদের থেকে বাবা ফুফা কুড়ি/পঁচিশ হাত পিছনে পড়লো।
দূর থেকেই রাজাকারটা জোরে বললো
-এই, জোরে পা চালা শালার পুতেরা
আব্বাও জোরে বললো
-অ্যা রাহা হে ছাহাব
ফুফা বললো
-হাসান ভাই, আমি আর পারতাছি না!
হাসানঃ মালেক, আর একটু ধৈর্য ধরো। আর একটু পর নাসিরাবাদের পশ্চিম চক আসবে। পুরো চক জুড়ে লম্বা পাট ক্ষেত। আমি ইশারা দিলে পাট ক্ষেতে বসে গুলির বাক্স রেখে দক্ষিণ পশ্চিম কোণা বরাবর দৌড় দিবো। এতো বিশাল পাট ক্ষেতে আমাদের খুঁজে পাবে না। ওরা এসে এলোপাতাড়ি গুলি করতে করতে আমরা অনেকদূর চলে যাবো। বুঝছো?
মালেকঃ হ বুঝছি।
হাসানঃ আমাকে হারালে চিন্তা করবা না। আমরা শ্যামগ্রাম বিদ্যালয়ে গিয়ে মিলিত হবো। সেখান থেকে পূর্ব দিকে লহরী বাজারের হয়ে গোপালপুর যাবো। বুঝছো?
মালেকঃ হ বুঝছি

একটু পর বাবা বললো হাসান, চলো পালাই
বাবার শেষ কথা “পালাই” বলার সাথে সাথে পাকিস্তানিরা টের পায় নি। একটু সময় পর পিছনে ফিরে দেখে দুই বাঙালী হাওয়া।
ওরা পিছনে এসে পাট ক্ষেতে এলোপাতাড়ি কিছু গুলি ছুড়ে রাজাকারদের মাথায় গুলির বোঝা চাপিয়ে নাসিরাবাদের দিকে যেতে লাগলো।দলনেতা চিৎকার করে গালিগালাজ করে বললো
-কোয়ই বাঙ্গালী বাচ্চা ক্যাভি অ্যাচ্ছা নেহি হ্যায়
এভাবেই বাবা ও ফুফা সেযাত্রা দ্বিতীয় বার জীবন পেলো।

মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেলেও বাবা কোনদিনই সনদ নেন নাই। তিনি বলতেন, দেশকে ভালবেসে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। এর বিনিময়ে কোন সনদ বা সুযোগ নিতে হবে কেন? জগলুর আজো আবছা আবছা মনে পড়ে। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর জ্বরের কারনে সে বিছানায় পড়ে ছিলো। তখন মুক্তিরা বাড়ীতে কতগুলো রাজাকার ধরে এনে বামনা পুকুরের পূর্ব পাড়ে কালা আম গাছ ও সিঁদুইরা আম গাছে ঝুলিয়ে পেটাচ্ছিলো।

নাদিরা আপা, শুকিয়া আপা, মুছা ও আমীর ভাই রাজাকার পেটানো দেখে এসেছে। কিন্তু মা তাকে বিছানা থেকে উঠতেই দেয় নি। এমন একটা ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হতে না পারার দুঃখটা জগলুর আজীবন থাকবে।

সে পরে শুনেছে আলমগীর ভাই মানে শাহজাদা ভাই, সাব বাড়ীর আলমগীর (পরে নায়ক হয়েছে), ধন মিয়া ভাই, শাহজালাল ভাই পরে বিমান বাহিনীর ফ্লাইট সার্জেন্ট, জসীম কাকা পরে ইউপি চেয়ারম্যান ও কান্দির খাইরুল ভাই ওদের বিলে নিয়ে আরও পেটায়। কয়েকটিকে নাকী সাদেকপুর বাজারের ধারে মেঘনায় বিলীন করে দেয়। শাহাজাদা ভাই নাকী তার আপন খালুকেও ছাড় দেয় নি রাজাকার হবার কারণে।

স্বাধীনতার পর বাবা বললেন স্বাধীন কৃষি কাজ পেশাটাই বেছে নিলাম। সেই থেকে বাবা গর্বিত কৃষক।
তিনি প্রায়শই বলতেন

“সবাই করে চাকরগিরি
আসলে কর্পোরেট কামলা!
কাজের রাজ কৃষিকাজ,
বুঝতে যায় যে সারাবেলা!”

বাড়ীতে সবসময়ই সারা বছরের জন্য একজন মুনি মানে চাকর ছিলো। গলায় জল আটকে মা’য়ের মৃত্যুর পর থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ বাড়ীতে আছেন জোহর আলী কাকা। সে-ই জগলুকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন । মায়ের মৃত্য পর মায়ের শোক সইতে না পেরে মমতাজ বুবুও চলে যান মায়ের নিকট। বাড়ীতে রান্না বান্নার জন্য ইরানী নামে একজন মহিলাও আছে। তবে এটা জোহর আলী কাকার বিভাগ। এবার বাড়ী ছেড়ে আসার সময় জোহর আলী কাকা শ’দুয়েক মিষ্টি কুমড়া নিয়ে রামচন্দ্রপুর বাজারে গিয়েছিল। তাই রাজশাহী আসার সময় দেখা হয় নি।

বাড়ী ও বাবার কথা!
উপন্যাসঃ অতল জলে জলাঞ্জলী
এ কে সরকার শাওন
শাওনাজ ভিলা, উত্তরখান, ঢাকা।

উপরে