অতল জলে জলাঞ্জলী ৪র্থ পর্ব: জীবন যেখানে যেমন

প্রকাশিত: ১৭-১০-২০২৪, সময়: ১০:৩১ |

এ কে সরকার শাওন :  শরতের শেষে সেদিন প্রথম পদ্মারপাড়ে গিয়েছিলো জগলু। ছুটির দিন থাকায় মনে হয় তুলনামূলক ভীড়টা একটু বেশী। একটি নির্জন স্থানে গিয়ে একটি দৈনিক খবরের কাগজ বিছিয়ে আরাম করে বসলো। বাবা বলতেন, “যে কোন পরিবেশে সর্বোচ্চ ভালো থাকার চেষ্টা করবে”! কতো বিশাল এই পদ্মা নদী। শুধু নামই শুনে আসছে। আজ সচক্ষে দেখে নয়নযুগল স্বার্থক করলো। এখানে আরও আগেই আসা উচিত ছিলো। তবে পদ্মার জল মেঘনার মত টলমলে স্বচ্ছ নয় । মেঘনার জল দেখলেই স্নানের সাধ জাগে।

একটি অখণ্ড নীল আকাশে শিমুল তুলোর মত কোদালে মেঘের ভেলাদল দ্রুত ভাসছে। এপারে কালচে শ্যামল নদীর তীরে সাদা কাশবন। দূর আকাশে ধবধবে সাদা উড়ন্ত বকের ঝাঁকের আলপনা। কিঞ্চিৎ হিমেল হাওয়ায় দোলায়িত কাশ ফুলদল দূর থেকে দেখে মন হারিয়ে যায় নিমিষেই। কাশফুলে ছেয়ে যাওয়া দিগন্ত রেখায় শুভ্র বালুচরের সাথে নুইয়ে পড়া আকাশ এসে মিশে গেছে মিতালী পাতাতে।

জগলু ভাবলো কবিতা লিখার জন্য যথোপযুক্ত স্থান এবং সময়। কবিতার খাতাটা না এনে বড্ড বোকামী করেছে। কলম তার কাছে আছে কিন্তু কাগজ নেই।
সে হাতের তালুতেই লিখলো

ভাটির দেশে শুভ্র কাশবন
কেড়ে নিয়েছে মন,
নদীর তীর কত যে নিবিড়;
মন হয় উচাটন!

সে ভাবলো না এভাবে হবে না। ইচ্ছে থাকলে একটা না একটা উপায় বের হয়ই।

বাদাম, চীনাবাদাম বলে বাদাম বিক্রেতা যাচ্ছিলো।
জগলু দেখলো ওর বাদামের উপর একটি বই। এই বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ঠোঙ্গা বানিয়ে সে বাদাম বিক্রি করে।
জগলুঃ এই খোকা, আমাকে দু’টাকার বাদাম দাও। আর তোমার এই বইটা দেখি?
বাদাম বিক্রেতার নিকট থেকে বইটি নিয়ে জগলু পৃষ্ঠা উল্টিয়ে একটি খালি পৃষ্ঠা বের করে ছিড়ে নিলো।
বাদাম বিক্রেতাঃ কি করবেন এই পাতা দিয়া?
জগলুঃ কবিতা লিখবো।
বাদাম বিক্রেতাঃ ওহ, আপনে কবি?
জগলুঃ ক্ষুদ্র কবি বলতে পারো। তুমি কবিতা পছন্দ করো?
বাদাম বিক্রেতাঃ করি একটু একটু, বেশী বুঝি না তো! আমি ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি…
জগলুঃ তারপর পড়লে না কেন?
বাদাম বিক্রেতাঃ মায় মইরা যাওনের পর বাপে আবার বিয়া করছে। সৎ মা বই-টই সব চুলায় জ্বালাই দিছে।
জগলুঃ তোমার বাবা কিছু বলে নি?
বাদাম বিক্রেতাঃ হেয় আর কি কইবো? মা মরলে বাপ তালৈ! এমন বাপ থাকা আর না থাকা একই কথা।

জগলুর বুকটা হাহাকার করে উঠলো তার বাবার জন্য। তার বাবা শুধুমাত্র তার সুখের জন্য পুরো জীবনইটাই জলাঞ্জলী দিয়ে গেলো। জগলু কী পারবে তার বাবার মুখে হাসি ফোঁটাতে!
বাদাম বিক্রেতাঃ এই নেন বাদাম।
জগলু বাদাম নিয়ে দু’টো টাকা দিতে গেলে সে না নিয়ে বললো
-আপনে কবি তাই দাম নিবো না!
জগলু আশ্চর্য হয়ে বললো
-তুমি একটা কবিতা শোনাতে পারবে?
-হুম পারমু, তয় চার চরণ…

আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন
‘মানুষ হইতে হবে’ – এই যার পণ৷

জগলুঃ সাবাশ! কে শিখিয়েছে এই কবিতা?
বাদাম বিক্রেতাঃ আমার মা!
জগলুঃ তোমার মা যা শিখিয়ে গেছেন এটাই একটা লোক মানুষ হবার জন্য যথেষ্ট। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিত না হলেও মানব শিশু মানুষ হয়। এই নাও এই টাকাটা রাখ।
জগলু জোর করে দশটি টাকা ওর হাতে ধরিয়ে দিলো। বাদাম বিক্রেতা চলে গেলে জগলু ভাবলো এখনকার বঙ্গ সন্তানদের বাচালতা দেখলে কবি কুসুমকুমারী দাশও অজ্ঞান হতেন। জগলু মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে কবিতা লিখায় মন বসালো…

কবিতার শেষের অংশে ইচ্ছে করেই দিঘী ব্যবহার করেছে। যেন সে গোপালপুর গ্রামের শেফালী দিঘীর পাড়েই বসে আছে। তা’ছাড়া পদ্মার ঘোলা জলে মানুষের ছায়া দেখা যায় না। তবে মেঘনায় যায়। শেফালী দিঘীতেও ছায়া দেখা যায়।

সে দূরে তাকিয়ে দেখলো কবীর ও জিল্লুর দাঁড়িয়ে কোমল পানীয় পান করছে। দু’জনার গায়ে নায়ক জাফর ইকবাল শৈলীতে হাতাকাটা হলুদ গেঞ্জি। জগলু ওদের দু’জনার নাম ধরে ডাকলে ওরা কাছে এসে বসলো।
কবীরঃ বিকেল ঘুম থেকে উঠে দেখি তুই বিছানায় নাই। আমি ভেবে পেলাম না তুই কোথায় গেলি!
জগলুঃ জিল্লুরকে পেলি কোথায়?
জিল্লুরঃ কবীর দাঁড়িয়ে ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে। আমি আমার ফুফার সাথে বুলনপুরে যাচ্ছিলাম। ওকে দেখে তুলে নিলাম। ও বললো পদ্মারপাড়ে নামবে। তাই আমিও নেমে পড়লাম।
জগলুঃ বেশ করেছিস
কবিতার কাগজটা ভাজ করে বুক পকেটে রাখবে এমন সময়
জিল্লুরঃ এই, তোর হাতে ওটা কি?
জগলুঃ কিছু না,
জিল্লুরঃ প্রেম পত্র না তো?
জগলুঃ আরে না!
কবীরঃ তাহলে দেখাচ্ছিস না কেন?
জগলুঃ এই নে দেখ
জিল্লুরঃ এ তো দেখছি কবিতা! কবীর, তুই আবৃত্তি করে শোনা!
কবীর কবিতার কাগজটি জিল্লুরের হাত থেকে নিয়ে আবৃত্তি করতে লাগলো।

অসীম নীলে মাতাল অনিলে
মেঘের তুলো ভাসে!
সবুজ দিগন্ত বন বনান্ত
প্রান খুলে হাসে!

সাদা নীলে দারুণ মিলে
দূর আকাশের গায়!
নীলে সবুজে দারুণ সাজে
দিকচক্রবাল রেখায়!

রংয়ের ছোঁয়ায় মন হারায়
অনিন্দ্য সুন্দর ধরা!
ছন্দ সুরে প্রাণ ভরে
আলোয় ভূবন ভরা!

কলা পাতা দোলায় মাথা
ভাসবে মেঘের সনে;
বাউলের চুল উড়ুক্কু কুন্তল
উড়বে দূর গগনে!

শরৎ আকাশ রম্য ক্যানভাস
স্বচ্ছ রহস্যময় নির্মল;
মেঘের পরে মেঘ উড়ছে
জগলুর চিত্ত বিহ্ববল!

শরীর ছেড়ে মন উড়
বিনি সুতার ডোরে;
উল্লাসে দূরে চিলেরা উড়ে
গোধূলির লাল আবীরে!

স্বচ্ছ টলটলে দিঘীর জলে
আকাশের মোহনীয় ছায়া!
সাঁঝের বেলা জগলু একেলা
জলতলে হারায় কায়া!

কবিতাঃ শারদ সন্ধ্যায়
জগলুল হাসান সরকার

কবীরঃ চমৎকার! শালা, তুই দেখছি কবি!
জগলুঃ এই একটু আধটু
জিল্লুরঃ এবার পুরো কবি হবি। তোর লেখার হাত পাকা। কবীর কবিতাটি দে। রাজশাহীর দৈনিক বার্তার সাহিত্যের পাতা দেখে আমার এক বড় ভাই। আজই তার হাতে দিয়ে আসবো। আমি আশাবাদী সে তোর কবিতাটি প্রকাশ করবে।
জগলুঃ তোকে ধন্যবাদ বন্ধু।
জিল্লুরঃ হয়েছে হয়েছে এবার ওঠ
কবীরঃ হুম বলে উঠতেই পা লেগে মাটিতে রাখা বাদামের পোটলা থেকে সব বাদাম পড়ে গেলো।
-হায়রে কখন বাদাম কিনেছিস! একটাও মুখে দিস নি।
সকলে মিলে বাদাম কুড়ায়ে নিয়ে পদ্মারপাড় ত্যাগ করলো।

এভাবেই কাটতে লাগল জগলুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন। ইদানীং বন্ধু বেড়েছে। খরচও বেড়েছে। গাঁয়ের কথা ভাবা কমেছে। গৃহশিক্ষকতার পরিধি ও বাড়িয়েছে। কবিতার ও গৃহশিক্ষকতার সুনামও ছড়াচ্ছে। গত বৎসর বাড়ীতে গিয়ে সে বাবাকে বলেছে বাবা, আমি গৃহশিক্ষকতা করে যা পাই তাতে আমার চলে যায়। তুমি আমাকে আর কোন টাকা পাঠিয়ো না। বাবা শুধু বলেছিলো, দেখিস লেখাপড়ার যেন কোন ক্ষতি না হয়। জগলু বলেছিলো তুমি আমার জন্য কোন চিন্তা করো না। শুধু দোয়া করো। এখন সে বছরে দু’বারের বেশী বাড়ী যাবার সময় পায় না। জীবন যেখানে যেমন জগলু সেখানে তেমন।

পর্ব-৪ জীবন যেখানে যেমন
উপন্যাসঃ অতল জলে জলাঞ্জলী
এ কে সরকার শাওন
শাওনাজ ভিলা, উত্তরখান, ঢাকা।

উপরে