সংরক্ষণাগারে চালের বদলে গম, বাড়ছে ঝুঁকি
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সরকারি খাদ্য মজুত ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে দেশের সাতটি সংরক্ষণাগার বা সাইলো নির্মাণ করছে খাদ্য অধিদফতর। এরমধ্যে দেশের সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদন এলাকা ময়মনসিংহের সাইলোটির পাশাপাশি টাঙ্গাইলের সাইলো উদ্বোধন হয়ে গেছে। কিন্তু চালের এই সাইলোতে গম রাখার ঘটনা ঘটছে। কিন্তু ওইসব সাইলোতে গম রাখার প্রযুক্তিগত সুবিধা না থাকায় তা বিপদজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সাইলোতে বিস্ফোরণের আশঙ্কাও করা হচ্ছে।
এদিকে চালের বদলে গম রাখার ঘটনা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে সাইলো কর্তৃপক্ষের কাছে বিস্ময় প্রকাশ করেছে খোদ বিশ্বব্যাংক। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আপাতদৃষ্টিতে নতুন এসব সাইলোতে গম রাখার বিষয়টি ছোটখাট হেরফের মনে হলেও এরমধ্যে রয়েছে বড় গোমর। কারণ আধুনিক ওইসব সাইলোতে চাল রাখলে সেটার হিসেবে হেরফের করা কঠিন, যা দীর্ঘদিন ধরে থানা ও জেলাগুলোর খাদ্যগুদামে (এলএসডি/সিএসডি) চলে আসছে। পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যাবে চাল সংগ্রহ ব্যবস্থায় মিলার ও পরিবহন ঠিকাদারদের বড় উৎকোচ। এছাড়া সংগ্রহ মৌসুমে চাল না কিনেও পুরাতন চাল নতুন বলে ক্রয় দেখানো সম্ভব হবেনা। যে কারণে আধুনিক সাইলোতে এখন চালের বদলে গম রাখার ঘটনা ঘটছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি ময়মনসিংহের সাইলো পরিদর্শন করেছে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদল। তারা চালের সাইলোতে গম দেখে তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪ সালে দেশে আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্পের মাধ্যমে এ সাইলোগুলো নির্মাণের কাজ শুরু হয়। প্রথমে আটটি সাইলো নির্মাণের কথা থাকলেও শেষে নওগাঁর সাইলো বাদ দিয়ে এখন বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মহেশ্বরপাশা, চট্টগ্রাম ও মধুপুরে ৪.৮৭ লাখ টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন আধুনিক স্টিল সাইলো নির্মাণ হচ্ছে।
এসব সাইলো নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য হলো- বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জপূর্ণ সময়ে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, যেমন ঘন ঘন জলবায়ু বিপর্যয়, বন্যাসহ নানা মহামারির মতো সঙ্কটে খাদ্য ঘাটতি থেকে মুক্তি দেওয়া।
খাদ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংয়ের সাইলোর পাশাপাশি টাঙ্গাইলের মধুপুরসহ আরও কয়েকটি সাইলোতে গম রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অধিদফতর। যেজন্য তড়িঘড়ি করে গত জুনে ও সেপ্টেম্বরে দুদফায় ২০ হাজার টন গম চলাচল সূচি জারি করা হয়। এদিকে বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিনিধি দল যখন রাইস সাইলো পরিদর্শনে গিয়েছেন তখন তারা দেখেছেন সাইলোর ক্লিনার টাওয়ার না থাকায় ডাস্ট (ধুলা-ময়লা) দিয়ে বিল লাইনার পুরোপুরি ব্লকড হয়ে গেছে। চিলার ও ফিউমেগেশন প্রক্রিয়া পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে।
চালের সাইলোতে প্রযুক্তিগত কারণে গম রাখা সম্ভব নয়-এমনটা আগেই জানিয়েছিলেন প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রেজাউল করিম শেখ।
এই কর্মকর্তা দায়িত্বে থাকাবস্থার তার ওএমটি রিভিউ রিপোর্টে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সাইলোতে বিকল্প কোনো পণ্য রাখা হলে মেকানিক্যাল যন্ত্রাংশগুলো সঠিক ফ্লো রেটে কাজ করবে না। কিছু কিছু যন্ত্রাংশ শস্য বিনষ্ট করতে পারে। বাকেট এলিভেটরগুলো সঠিকভাবে কাজ নাও করতে পারে। চালের সাইলোর ক্লিনিং ডিভাইসগুলো গমের সাইলোর জন্য সঠিক নয়। এমনকি বিস্ফোরণের আশঙ্কাও বেড়ে যেতে পারে।
অন্যদিকে গত জুনে ময়মনসিংহ স্টিল রাইস সাইলোর সুপার খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে জানিয়ে চিঠিও দেওয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে। যে চিঠিতে বলা হয়, চালের সাইলোতে ক্লিনার টাওয়ার না থাকায় গম ডাস্টমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। চিলার ও নাইট্রোজেন ফিউমিগেশন কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন সাইলো সুপার মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ খান।
এ বিষয়ে সেখানকার সাইলো সুপার মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ খান শিবলী ঢাকা মেইলকে বলেন, বিশ্বব্যাংক) এখানে অর্থায়ন করেছে, তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এটা চালের জন্য। সেখানে অন্যকিছু রাখলে উদ্বেগ জানাবেন এটাই তো স্বাভাবিক।
চালের বদলে গম রাখার বিষয়ে ঝুঁকির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এতে কিছু ঝুঁকি আছে। তারা (প্রতিনিধি দল) জিজ্ঞেস করেছে- এটাতে কেন গম রেখেছেন? আসলে এটা প্রকল্প থেকে বলা হয়েছে আমাদের যে এখানে গম রাখা যাবে। আমরা সেটা প্রতিনিধিদের বলেছি। তারা বিস্মিত হয়েছেন।
খাদ্য অধিদফতরের এ বিষয়গুলো দেখে চাল সংরক্ষণ ও সাইলো বিভাগ। এর পরিচালক মাহবুবুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, প্রকল্পের যে টেকনিক্যাল কমিটি তারা বলেছে, গম রাখা যাবে। যেহেতু আমাদের গমের সাইলো কম, সেজন্য দুটি সাইলো, সেগুলো চালের জন্য করা হলেও পরে গম রাখার জন্য অনুমোদন দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ছাড়া এবং বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদলের উদ্বেগ নিয়ে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এ বিষয়ে টেকনিক্যাল কমিটির সুপারিশের পর মন্ত্রণালয় এমনটা করার অনুমোদন দিয়েছে। অবশ্য গম রাখায় ঝুঁকির কথা বলা প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রেজাউল করিম শেখও টেকন্যিকাল কমিটিতে ছিলেন। আরও ছিলেন প্রকল্পটির একজন কনসাল্টেন্ট, যিনি সাবেক সাইলো প্রকৌশলী। তারা কোন প্রকার পরীক্ষা-নীরিক্ষা না করেই একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন মন্ত্রণালয়ে।
তখন থেকেই খাদ্য কর্মকর্তাদের অভিযোগ, সুবিধাবাদি সিন্ডিকেটের কায়েমি স্বার্থ রক্ষার জন্য উদ্দেশ্যে এ প্রতিবেদন দিয়েছেন তারা।
অবশ্য এই কর্মকর্তার দাবি, মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে কোনো সাইলোতে দীর্ঘমেয়াদী গম রাখার কথা অনুমতির কথা বলা হয়নি। পরীক্ষামূলকভাবে রাখা যাবে সেটা বলেছি।
জানা গেছে, দেশে চাল উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ ময়মনসিংহ। এ বিভাগে ১.১৯ লক্ষ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার ফ্ল্যাট গোডাউন (আগের খাদ্যগুদাম) রয়েছে। যেখানে চাল সংরক্ষণের একটি বড় কর্মযজ্ঞ চলে। এতে সংগৃহীত চাল সরবরাহ, বস্তা ক্রয়, গোডাউনে খামাল করা এবং সেখান থেকে বিভিন্ন এলাকায় পরিবহনসহ নানা কাজে রয়েছে সরকারের বড় বরাদ্দ। এছাড়া কর্মকর্তারা এখান থেকে মিলার ও পরিবহন ঠিকাদারদের বড় উৎকোচ পান। পাশাপাশি সংগ্রহ মৌসুমে চাল না কিনেও পুরাতন চাল নতুন বলে ক্রয় দেখানোর মতো অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া মানহীন চাল ফ্লাট গোডাউনে রাখা যায়, যা আধুনিক সাইলোতে সম্ভব নয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন খাদ্য কর্মকর্তা বলেন, চালের সাইলোতে চাল গেলে অনিয়ম কমে আসবে। সব আটোমেশন হবে।