অতল জলে জলাঞ্জলী ৬ষ্ঠ পর্ব: বিকেলে বায়ব্যে বসতিতে
এ কে সরকার শাওন সরকার: পড়ন্ত বিকেলে দুই বন্ধু রিক্সাযোগে বালিয়াপুকুর জামে মসজিদের পাশে একটি বিশাল বাড়ীর সামনে এলে জিল্লুর বললো
-এই, থামো, এখানেই থামো। বায়ে রাখো।
জগলু রিক্সাতে বসেই দেখলো শ্বেত পাথরে নামফলকে গাঢ় নীল রংয়ে বাড়ীর নাম “বায়ব্যে বসতি” লেখাটি জ্বলজ্বল করছে। জিল্লুর রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে জগলুকে বললো
-নামছিস না কেন?
জগলুঃ আচ্ছা বসতি না হয় বুঝলাম। বায়ব্য মানে কি? এই শব্দটি আজ আমি প্রথম দেখলাম। রিক্সা থেকে নামতে নামতে জগলুর জিজ্ঞাসা।
জিল্লুর হি হি হি করে হেসে বললো
-ওটা ফুফাজীর কাজ।
আমিও কী জানতাম ওর মানে! পরে ফুফার কাছ থেকে মানে জেনে নিয়েছি। উত্তর-পশ্চিম কোণকে বায়ব্য কোণ বলা হয়। ফুফুরা বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিম কোনে মানে রাজশাহীতে বসবাস করেন তাই ফুফাজী বাড়ীর নাম দিয়েছেন “বায়ব্যে বসতি”।
জগলুঃ উনি কী সাহিত্যে পড়াশোনা করেছেন না-কি?
জিল্লুরঃ ঠিক ধরেছিস। ফুফাজী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সনদ অর্জন করেছেন। তোর মত লিখালিখি করেন। চল যাই।
প্রধান ফটক খোলা থাকায় ওরা দু’জনে সহজেই ভিতরে প্রবেশ করে দেখলো মালী চাচা ফুল বাগানে জল দিচ্ছে। নানান জাতের ফুল দেখে জগলু উৎফুল্ল হলো।
জিল্লুর মালী চাচাকে জিজ্ঞেস করলো
-ভিতরে কে কে আছেন চাচা?
মালী চাচাঃ সবাই আছেন। জনাব মনে হয় বাহিরে বের হবেন। গাড়ী বের করতে বলছেন। তাড়াতাড়ি যান বাবাজী।
যাচ্ছি বলে দু’জন এগিয়ে গিয়ে ডাক ঘন্টা চাপলো।
মমতাময়ী এক মহিলা দরজা খুললো। উনার নাম মেহেরুন্নেছা খানম। জিল্লুর তাঁকে পা ছুঁইয়ে সালাম করলো।
জিল্লুরঃ কেমন আছেন ফুপু আম্মা?
মেহেরুন্নেছাঃ বেঁচে থেকো বাবা। আমরা ভালো আছি । উনি কে?
জিল্লুরঃ ও আমার বন্ধু জগলু। জগলু উনি আমার ফুফু…
জগলুও পা ছুঁয়ে সালাম করলো।
মেহেরুন্নেছাঃ বেঁচে থাকো বাবা। তোমরা ভিতরে গিয়ে বসো। ফুফু বাহিরের দিকে গেলো। দুই বন্ধু বসার কক্ষের দিকে গেলো।
বসার কক্ষে ফুফা রবী ঠাকুরের গীতাঞ্জলি পড়ছিলেন। জিল্লুর সালাম দিয়ে জগলুর দিকে তাকিয়ে বললো
-উনিই আমার ফুফাজী। ফুফা ও আমার বন্ধু জগলু।
জগলুও আসসালামু ওয়ালাইকুম বলে সালাম দিলে ভদ্রলোকও ওয়ালাইকুম সালাম বলে উঠে দাঁড়িয়ে কর মর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন।
মনসুরঃ আমি মনসুর আহমেদ খান। আপনারা বসুন।
জিল্লুরঃ আপনি করে বলছেন কেন ফুফা? তুমি করে বলবেন ওকে।
মনসুরঃ ও আচ্ছা, তোমরা বসো।
জগলুঃ আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো।
মনসুরঃ কেন? কেন? মনসুর আহমেদের কৌতূহল।
জগলু একটু ইতস্তত করে বললো
-আপনি লিখালিখি করেন তাই।
মনসুরঃ ওসব একেবারেই সামান্য। কলকারখানা, যন্ত্রপাতি আর শ্রমিক নিয়ে পড়ে থাকলে সাহিত্য চর্চা হয় না। তা তুমি কোথায় পড়াশোনা করছো?
জগলুঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মনসুরঃ কোন বিষয় নিয়ে?
জগলুঃ গণিত নিয়ে
মনসুরঃ ও তোমরা দুইজন সতীর্থ।
জিল্লুরঃ জ্বী ফুফা, আমাদের চাল চলন সবই এক এইজন্য বন্ধুরা আমাদের বলে মানিক জোড় জ জি!
মনসুরঃ জ জি মানে?
জিল্লুরঃ জ জি মানে জগলু জিল্লুর।
মনসুরঃ তা তোমরা কি কক্ষ সংগী?
জিল্লুরঃ না ফুফা, ও জোহা ছাত্রাবাসে আর আমি নওয়াব লতিফে।
মনসুরঃ তা মানিকজোড় হয়ে আলাদা থাকছো কেন? কক্ষ সংগী হলেই তো পারতে।
জিল্লুরঃ এই ধারনা জগলুর। ওর কথা কাছের লোক যত দূরে থাকে ততই মঙ্গল।
মনসুরঃ কথাটি অবশ্য সে ঠিকই বলেছে।
এমন সময় জিল্লুরের ফুফু মেহেরুন্নেছা খানম স্বামীর পাশে এসে বসলেন।
ফুফা তার স্ত্রী কে জিজ্ঞেস করলেন
-আচ্ছা মেহের, আমাদের মিহি মামনির গৃহশিক্ষকের
কী কোন ব্যবস্থা হলো?
মেহেরুন্নেছাঃ দু-তিন জনকে বলেছি। জিল্লুর কেও তো বলেছিলাম।
কী রে জিল্লুর, তুই কী কাউকে বলেছিস?
জিল্লুরঃ হ্যাঁ ফুফু আম্মা বলেছি।
এমন সময় মিহি দৌড়ে এসে বললো
-বাবা বাবা, এক কথায় প্রকাশে আমার বান্ধবী মনিরার সাথে হেরে যাচ্ছি। একটু সাহায্য করো দয়া করে।
পিছন পিছন জুহি এসে রাশভারী কন্ঠে বললো,
-এই মিহি চলে আয় আমার কক্ষে। দেখছিস না বাহিরের লোকজন রয়েছে। তোর একটু যদি বুদ্ধি শুদ্ধি থাকতো!
মনসুরঃ আহ, আসছে যখন বলুক না। মনসুর সাহেব হেসে বললেন। ওদিকে মেজাজী হয়ে জুহি দাঁড়িয়ে আছে।
মনসুরঃ বলো মা, তুমি কোন এক কথায় প্রকাশ করতে পারছো না?
মিহিঃ ক্ষমা করতে ইচ্ছুক এক কথায় কী হবে?
জিল্লুর বলে উঠলো
-এ তো সহজ “তিতিক্ষা”!
মিহিঃ আমিও তাই বলেছিলাম। মনিরা বললো হয় নি।
মনসুরঃ হ্যাঁ, মনিরা ঠিকই বলেছে। ওটার এক কথায় প্রকাশ হলো তিতিক্ষু, মনসুর সাহেব আরো যোগ করে বললেন ক্ষমা করার ইচ্ছা এক কথায় তিতিক্ষা।
-এই মর্জিনা নাস্তার কী হলো!
মেহেরুন্নেছা খানম একটু শব্দ করে দূরে অবস্থান করা গৃহকর্মী মর্জিনাকে বললো।
দূর থেকে মর্জিনার উত্তর
-আর একটু সময় লাগবে খালাম্মা, আপনি একটু এদিকে আসেন।
মেহেরুন্নেছাঃ তোমরা কথা বলো আমি গিয়ে দেখি নাস্তার কতদূর হলো।
জুহি মিহির দিকে তাকিয়ে বললো
-এসব এক কথায় প্রকাশ সব আমার মুখস্থ। আমার সাথে এক কথায় প্রকাশে কেউ পারে না।
মিহিঃ তাহলে এবার বলো আপু
কটিদেশ থেকে পদতল পর্যন্ত অংশ এক কথায় কী হবে?
-অধঃকায় জুহির গর্বিত উত্তর।
ওহ আপু তুমি আসলেই ধীমতী!
জুহিঃ হয়েছে হয়েছে এবার চল্।
ওরা যেতে উদ্ধত এমন সময় জগলু বললো
-আপনি বলেছেন আপনি এক কথায় প্রকাশ করতে পারদর্শী। আমি আপনাকে ৩টি এক কথায় প্রকাশ জিজ্ঞেস করবো। যদি অন্তত একটির সঠিক উত্তর দিতে পারেন তাহলে আপনি শতভাগ নম্বর পেয়ে সফল হয়েছেন বলে ধরে নিবো।
জুহিঃ আর আমি যদি তিনটিই পারি?
জগলুঃ আপনাকে এক কথায় প্রকাশের সম্রাজ্ঞী বলে বিণা বাক্যে মেনে নিবো।
জুহিঃ তাই না কী?
এমন সময় চা নাস্তা আসলো। মর্জিনা পরিবেশন জলখাবার করলো। মনসুর সাহেব বললেন
-সকলে আগে জলখাবার খেয়ে নাও। পরে কথা বলা যাবে।
জুহিঃ জল খাবারের পর আমি আবার আসছি।
জলখাবার খাওয়া শেষ। মর্জিনা থালা বাটি গ্লাস সব নিয়ে গেলো। জুহি এসে তার বাবার পাশের গদি কেদারায় বসে যুদ্ধাংদেহী হয়ে বললো
-হ্যাঁ, এবার বলুন আপনার তিনটি কঠিন এক কথায় প্রকাশ!
জগলুঃ আমি আগেই বলে নেই না পারলে কিন্তু আপনি অপমানিত বোধ করবেন না। আমি উত্তর বলে দিলেই তো আপনি শিখে যাবেন।
জুহিঃ আচ্ছা আচ্ছা আগে আপনি বলুন তো দেখি!
– “চোখের কোন” এক কথায় কি হবে? জগলুর শান্ত ধীর প্রশ্ন।
জুহি চিন্তায় পড়ে গেলো। এরকম শব্দ সে আগে কোনদিনই শোনে নি। সে সোজাসাপটা উত্তর দিলো
-দুঃখিত পারলাম না। অন্য আর একটি বলুন।
জগলুঃ বলছি, তার আগে প্রথমটির উত্তরটি দিয়ে নেই
চোখের কোন এক কথায় অপাঙ্গ। এবার দ্বিতীয়টি
-পুরুষের উদ্দাম নৃত্য এক কথায় কি?
জুহি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।
জিল্লুরঃ তুই কোত্থেকে কোত্থেকে শব্দ এনে কী জিজ্ঞেস করছিস যা আমি জীবনেও শুনিনি। ফুফা আপনি শুনেছেন?
মনসুরঃ না বাবা, আমিও শুনি নি।
জগলু গম্ভীর হয়ে বললো পুস্তকে আছে।
এমন সময় পাশের কক্ষে দূরালাপনি বেজে উঠলো । মনসুর সাহেব কথা বলতে উঠে চলে গেলেন।
জুহি বললো
-না এবারও পারলাম না। তৃতীয়টা জিজ্ঞেস করুন।
জগলুঃ থাক, বাদ দেন ধরে নিলাম তৃতীয়টা আপনি পারবেন।
জুহিঃ ধরে নেবার কিছু নাই। দ্বিতীয়টার উত্তর বলে তৃতীয় এক কথায় প্রকাশ বলুন।
জগলুঃ দ্বিতীয়টার উত্তর তান্ডব।
তৃতীয় এক কথায় প্রকাশ হলো
নাভি পর্যন্ত লম্বা যে হার এক কথায় কী হবে?
-ওরে বাবা, এ যে আরও কঠিন!বিস্মিত মিহি বলে উঠলো।
জগলুঃ কোন কিছু পারলেই সহজ। না পারলে খুবই কঠিন।
জিল্লুর বললো জুহি ভেবে ভেবে উত্তর দাও।
জুহি এবারও পারবে না বলে লজ্জায় তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো। জুহি সহজ সরল ভাষায় বললো
-এটাও পারলাম না দুঃখিত।
জগলুঃ এটার উত্তর ললন্তিকা
মিহি বাহ ভাইয়া বাহ! আপনি তো এক কথায় প্রকাশের রাজা!
জিল্লুরঃ ভাইয়া নয় জনাব বলো মিহি!
তিনি তোমার গৃহশিক্ষক হবেন।
জুহিঃ হবেন, এখনো হন নি।
-তার মানে? জিল্লুর বিস্ময়ে জানতে চাইলো।
জুহিঃ কয়েকটি আসর জমানো এক কথায় প্রকাশ জানলেই ইংরেজি শিক্ষক হওয়া যায় না।
-বেশ তো কী পরীক্ষা নিতে চান বলুন জগলু ঠান্ডা মস্তিষ্কে জানতে চাইলো।
জুহিঃ আপনার সাথে বসবো আগামী রবিবার বিকেল চারটায় ইবলিশ চত্বরে। আমার সাথে আমার দুই একজন বন্ধু থাকবে। জিল্লুর ভাই তো থাকবেই। সেখানেই দেখবো আপনি ইংরেজির কতো বড় জাহাজ।
জগলুঃ ঠিক আছে আমি অবশ্যই থাকবো। ঘড়ির কাটা তখন আটটা পার হয়ে গেলো।
মেহেরুন্নেসা এসে বললেন এই জিল্লুর, জগলুকে নিয়ে খাবার টেবিলে আয়। ওরা দু’জনে খেতে বসতে চায় নি। মেহেরুন্নেছার পীড়াপীড়িতে পরে খেতে বসলো।
মনসুর সাহেবঃ জুহি মা এলো না যে?
মিহিঃ আপা বাহিরের লোকের সাথে বসে খাবে না।
-তোকে বলেছে! দেবো এক চড়! মেহেরুন্নেছার কঠোর উক্তি। জগলুকে বললেন
-আর এক টুকরো মাছ দেই বাবা?
না ফুফু।
মিহি খেতে খেতে বললো।
-জানো আম্মু, জগলু মহাশয় নাকী আমার গৃহশিক্ষক হবেন। তিনি এক কথায় প্রকাশের রাজা।
মেহেরুন্নেছাঃ তাই না কী! খুব ভালো।
-তা কবে থেকে আসবে পড়াতে? মনসুর সাহেব জানতে চাইলো।
জিল্লুরঃ ফুফা, আপনারা এই বিষয়টি নিয়ে ভাববেন না। আমরা জুহির সাথে বিষয়টি চুড়ান্ত করবো।
-তা ১ মার্চ থেকে পড়াতে পারবে তো? জগলুর দিকে তাকিয়ে মেহেরুন্নেছা জানতে চাইলো।
জগলু দ্বিধাগ্রস্ত উত্তর দিলো
-আশা করি পারবো।
মেহেরুন্নেছাঃ তাই যেন হয় বাবা। সামনে আড়াই মাস সময় আছে। জুনের শেষে মধ্যবর্তী পরীক্ষা। মিহি যেন ভালো ফলাফল করতে পারে। তাই যত তাড়াতাড়ি পড়াতে পারো তত ভালো হয়।
জগলুঃ আচ্ছা ফুফু
জিলুরঃ ফুফু, আমরা একটু দ্রুত খেয়ে নিলাম। ফুফা আমরা আজ আসি। মিহি আসি।
মনসুর সাহেব স্মিত হেসে বললেন
-আবার এসো।
ওদের সিড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে ফুফু বললো
-আবার এসো তোমরা।
৬ষ্ঠ পর্বঃ বিকেলে বায়ব্যে বসতিতে
উপন্যাসঃ অতল জলে জলাঞ্জলী
এ কে সরকার শাওন
শাওনাজ ভিলা, উত্তরখান, ঢাকা।