ঈশ্বরদীতে আশঙ্কাজনক হারে কমছে আবাদি জমি
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঈশ্বরদী : ঈশ্বরদীতে দিন দিন কমতে শুরু করেছে আবাদি জমির পরিমাণ। এসব জমির মধ্যে অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে শিল্প-কারখানা, বাড়ি-ঘর, ইটভাটা, রাস্তা-ঘাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা। কাটা হচ্ছে পুকুর। ফলে আবাদি জমিতে কৃষি পণ্য উৎপাদনে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি বিভাগের আশঙ্কা, এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ব্যাপক খাদ্য সংকটে পড়তে হবে এ উপজেলাকে।
ঈশ্বরদী পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রাচীন সভ্যতা ও ঐতিহ্যে লালিত জেলা, যা পাবনা জেলার অংশ হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই পদ্মার স্নিগ্ধ জলে বিস্তৃত কৃষি জমি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহার ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে রেলওয়ের উন্নয়নের মাধ্যমে ঈশ্বরদী হয়ে উঠেছিল দেশের অন্যতম একটি যোগাযোগ কেন্দ্র, যা ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছিল। এই অঞ্চলের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পদ্মা নদীর পার্শ্ববর্তী অবস্থান এটিকে কৃষি, শিল্প এবং অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ করেছে। ঈশ্বরদী বর্তমানে দেশের অন্যতম শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান এ জেলার অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২৩৬.৬৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের উপজেলাটি ১টি পৌরসভা, ৭টি ইউনিয়ন এবং ১২৩টি গ্রাম রয়েছে। উপজেলায় মোট ভূমির পরিমাণ ৫৮ হাজার ৪৭৫ একর। এর মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ৩৯ হাজার একর।
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ অনুসারে, ঈশ্বরদী উপজেলার মোট জনসংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৫১ হাজার ৪৩৩ জন। এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে বাস করেন প্রায় ১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৪৫ জন এবং শহরাঞ্চলে বাস করেন প্রায় ৭৩ হাজার ৭৮৮ জন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ঈশ্বরদী উপজেলায় মোট আবাদি জমির পরিমাণ —- হাজার —– হেক্টর। এর মধ্যে এক ফসলি জমির পরিমাণ —– হাজার —– হেক্টর, দুই ফসলি জমির পরিমাণ —- হাজার —- হেক্টর ও তিন ফসলি জমির পরিমাণ — হাজার —- হেক্টর।
এ উপজেলায় তিন চতুর্থাংশ মানুষ সরাসরি কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত। এসব মানুষের জীবন-জীবিকা চলে কৃষি উৎপাদন ও কৃষি বিপণন থেকে। জনসংখ্যা অনুযায়ী মোট খাদ্য শস্যের চাহিদা গড়ে ২ লাখ ৯৫ হাজার ৭৯৪ মেট্রিক টন, উৎপাদন হচ্ছে ৩ লাখ ৩৪ হাজার ২২২ মেট্রিক টন।
উপজেলায় ২০১৮ সালে আবাদি জমির পরিমান ছিলো ২১ হাজার ৪৩৮ হেক্টর। ২০২৪ সালে ১৭ হাজার ৮৮৯ হেক্টর। গত পাঁচ বছরে ৩ হাজার ৫৪৯ হেক্টর ফসলি জমি কমেছে। শিল্পকল-কারখানা, ইটভাটা, ঘরবাড়ি তৈরি ও আবাসন প্রকল্পের জন্য জমি ক্রয়/দখল করে বালু দিয়ে ভর্তিকরণ ইত্যাদিই জমি কমে যাওয়ার কারণ ।
এ উপজেলায় কৃষকরা বেগুন, করলা, পটল, শসা, বরবটি, চিচিংগা, ঝিঙা, চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, লালশাক, ডাটাশাক, কচু, আলু, ঢেঁড়স, পেঁপেসহ মৌসুম ভিত্তিক বিভিন্ন সবজির চাষ করেন। এছাড়া আউশ, আমন, রোপা আমন, বোনা আমনধানসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদিত হয় এ উপজেলায়।
এ উপজেলার প্রবীণ নাগরিক প্রাক্তন অধ্যপক উদয় নাথ লাহিড়ী বলেন, “ইচ্ছেমতো জমির ব্যবহার বাড়ছে। চিহ্নিত করা যাচ্ছে না কৃষি ও শিল্পের জমি। রাতারাতি খাল, বিল, ডোবা নালা ভরাট হচ্ছে। যেখানে বছরে দু’বার ফসল উৎপাদন হতো। বর্ষায় জমতো থৈ থৈ পানি। এলাকার সাধারণ মানুষ এই প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ সংগ্রহ করতো, যা ছিল জীবিকারও উৎস। এখন আর এমন কিছু দেখা যায়না। এসব ফসলি জমিতে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছু সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হলেও, এসকল বেশিরভাগ জমিতে কৃষক তিন বার ফসল ফলানো হতো। এমন ফসলি জমিতেও শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে নানা কৌশলে।”
ঈশ্বরদী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর এস এম রবিউল ইসলাম বলেন, “নগরায়ন, শিল্পায়ন ও গ্রামে অপরিকল্পিতভাবে আবাসন নির্মাণের ফলে দ্রুত আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আবাসন নির্মাণ করতে হচ্ছে। তবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে এখনই আবাদি জমি রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্রুত ভূমি রক্ষায় সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ না করলে সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিবে।”
পাকশী রেলওয়ে ডিগ্রি কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ বলেন, “ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে আবাদি জমিতে অবাধে বাড়িঘর না করে একই স্থানে অনাবাদি জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণ করে অধিক লোকের আবাস সংস্থান করা সম্ভব। তা হলেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম খাদ্যাভাবের সম্মূখীন হবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে পরিকল্পিত ব্যবস্থা নিলে কৃষি জমি রক্ষা করা সম্ভব।”
নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আজিজুর রহমান, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত অপরিকল্পিতভাবে কৃষি জমিতে বাড়িঘর নির্মাণ হচ্ছে। এছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে বাড়ি নির্মাণ না করে গ্রামগুলোকে ছোট ছোট শহরে পরিণত করতে হবে। বহুতল ভবনে একাধিক পরিবারের আবাসনের ব্যবস্থা করা জরুরী। তা না হলে ভবিষ্যতে দেশে চরম খাদ্য সংকট দেখা দিবে। যার ফলে চড়া দামে বাইরের দেশগুলো থেকে খাদ্য আমদানি করতে হবে।
নরসিংদীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) অঞ্জন দাস বলেন, আমি যেহেতু এ জেলায় নতুন এসেছি, এ ব্যাপারে না জেনে কিছুই বলতে পারবো না।