বিকেলে ইবলিশ চত্বরে
এ কে সরকার শাওন : রবিবার চারটার একটু আগে ইবলিশ চত্বরের মাঠে মুখোমুখি বসে গল্প করছে দুই বন্ধু। অনতিদূরে পুকুর পাড় ঘেষে দৃষ্টিনন্দন সুউচ্চ গাছগুলো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বছরের পর বছর। সেদিকে তাকিয়ে জিল্লুর বললো
-এই ইবলিশ চত্বর, ঐ পুকুর পাড় আর গাছগুলো আমার খুব ভালো লাগে।
জগলুঃ আমারও।
জিল্লুরঃ তুই তো সময় পেলেই এখানে একা একা বসে থাকিস আর ভাবিস।
জগলুঃ ভাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকে গেলে আমরা একদিন চলে যাবো
জগলুর কথা টেনে যোগ করে জিল্লুর বললো
-কিন্তু স্মৃতিগুলো রয়ে যাবে মনের মুকুরে
জগলুঃ ঠিক বলেছিস জিল্লুর। তোর বাড়ী তো কাছেই নাটোরে। পড়াশোনা শেষ করেও চাইলেই চলে আসতে পারবি বউ বাচ্চা সহ। এমন কী নাতি পুতি সহ। আমি তো সুদূর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোপালপুরে। ছাত্র জীবন শেষে আমার হয়তো আর কোনদিনই আসা হবে না এই প্রিয় ইবলিশ চত্বরে।
জিল্লুরঃ তা তুই ঠিকই বলেছিস। আচ্ছা, এতো নাম থাকতে এই চত্বরের নাম ইবলিশ চত্বর হলো কেন?
জগলুঃ তুই কি সত্যি জানিস না?
জিল্লুরঃ না, জানি না। তুই জানলে বল।
জগলুঃ আমি শুনেছি ১৯৮১ সালে মামুনুর রশীদের বিখ্যাত ইবলিশ নাটকটি এই চত্বরে মঞ্চস্থ হয়। সেই থেকে এ চত্ত্বরের লোকমুখে ‘ইবলিশ চত্ত্বর’ হিসাবে ছড়িয়ে পড়ে।
জিল্লুরঃ বিষয়টি জানা ছিলো না। আজ তোর কাছে জানলাম। চল চা পান করে আসি।
জগলুঃ যেতে হবে না তোর পিছনে চা ওয়ালা।
এই চা মামা! এদিকে এসো। জগলু চা ওয়ালাকে কাছে আসতে ইশারা করলে সে কাছে এসে বললো
-কন কি চা দিমু? দুধ, লেবু না রং চা?
জগলুঃ কি চা পান করবি?
জিল্লুর ঘাড় উঁচু করে সন্মুখের দিকটা পর্যকেক্ষণ করতে করতে বললো
-না, এখন না। তুমি একটু পরে আসো মামা। আমরা আছি সন্ধ্যা পর্যন্ত।
জগলুঃ কেন? এই না বললি চায়ের তেষ্টা পেয়েছে?
জিল্লুরঃ তোর পিছনে আমার বোন জুহি দুই বান্ধবী নিয়ে আমাদের খুঁজছে । তাই বলছি পরে।
-এই জুহি, এই যে… আমরা এখানে… জিল্লুর হাত ইশারা করলো।
জগলুঃ তোকে দেখেছে?
জিল্লুরঃ হুম, আসতেছে।
জুহি ও তার বান্ধবীরা এসে জগলুর পিছনে দাঁড়ালো। জুহি বললো
-পরিচয় করে দেই; উনি আমার মামাতো ভাই জিল্লু ভাই আর উনার সামনে বসা উনার বন্ধু।
জুহিঃ জিল্লু ভাই, ও আমাদের ক্লাসে প্রথমা দীনা, তার পাশে মিনু তারপর রোজী।
জিল্লুর হেসে বললো
-তা তোমরা দাঁড়িয়ে কেন গোল হয়ে বসো। জগলু, তুই আমার পাশে চলে আয়।
জগলু ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে জিল্লুরের পাশে বসলো। সবাই গোল হয়ে বসতেই দীনা জগলু কে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো।
-আসসালামু ওয়ালাইকুম জনাব আপনি?
জগলুঃ হ্যাঁ আমি জগলু সরকার।
জুহি দীনার কাছে জানতে চইলো
-তুই কি উনাকে আগে থেকেই চিনিস?
দীনাঃ অবশ্যই চিনি। উনি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক।
৯ম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি এই জনাবের নিকট ইংরেজি ও গণিত পড়ে পরিপুষ্ট হয়েছি। আজ আমি সম্মানে প্রথম বর্ষে যে প্রথম হয়েছি সেটার ভিতও এই জনাবের গড়া।
জগলুঃ দীনা, থাক না বাদ দাও ওসব। তোমাকে কী উনি ভাড়া করে এনেছেন আমার ইংরেজি জ্ঞান যাচাই করার জন্য?
দীনা ধরা পড়ে গেছে তাই বান্ধবীকে বাঁচাতে মিথ্যা বললো।
-তা হবে কেন জনাব? আমরা তো এমনি এমনি ঘুরতে এসেছি।
জগলুঃ তোমার কোন কথা সত্য কোন কথা মিথ্যা, সেটা বোঝার ক্ষমতাও আমার লোপ পেয়েছে বোধ হয়!
জুহি লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। সবাই চুপ। নীরবতা ভেঙ্গে জিল্লুর বললো
-এখন ওসব কথা বাদ। সবার আগে চা পান করে নেই।
এই চা মামা এদিকে এসো।
পাশ দিয়ে বাদাম ওয়ালা যাচ্ছিলো জগলু ডাকলো
-এই বাদাম, আমাদের সবাইকে বাদাম দাও।
জগলুঃ দীনা, তুমি যে প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে প্রথম হয়ে উঠেছো মনে করো সেইজন্য বাদাম খাওয়াচ্ছি।
বাদাম ওয়ালা জুহিকে বাদাম দিতে চাইলে সে বললো
-না, আমি এখন বাদাম খাবো না। অপমানে নীজের চুল নিজেই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে তার।
সে বসা থেকে উঠে বললো
-জিল্লু ভাই শোন
ওরা জগলুর পিছনে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগলো
জুহিঃ আমার একটা কাজ আছে। আমাকে যেতে হবে।
জিল্লুর গম্ভীর হয়ে বললো
-সোজাসাপ্টা বলো যে পালাচ্ছো।
জুহিঃ হ্যাঁ, মনে করো তাই। না পালিয়ে উপায় আছে? তুমি মার্চের ১ তারিখ থেকে উনাকে বাড়ীতে পাঠিয়ে দিও মিহিকে পড়াতে।
জিল্লুরঃ ও মনে হয় এখন আর পড়াতে যাবে না। আমি ফুফুর কথায় হাতে পায়ে ধরে ওকে রাজী করিয়েছিলাম। তুমি সব গুবলেট করে দিলে।
জুহিঃ তুমি যেভাবে পারো রাজি করায়ে নিয়ে যেও। তুমি পারবে এই বিশ্বাস আমার আছে।
জিল্লুরঃ আচ্ছা। আমি দেখছি।
জুহিঃ আর হ্যাঁ, যেহেতু প্রথম দিন তুমিও অবশ্যই ওনার সাথে আসবে।
জিল্লুরঃ আচ্ছা, আসবো, তুমি যাও।
জিল্লুর ফিরে এসে বিষয়টি হাল্কা করার জন্য হেসে বললো
-চা বাদাম সব শেষ?
জগলুঃ তোমার চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। বাদাম অবশ্য পুঁতিয়ে যায় নি। তা তোমার গুনধর বোনটিকে তো দেখছি না। দীনা, তোমরা বুঝতে পারছো, মাঠে নামিয়ে দিয়ে অধিনায়ক পলাতক।
জিল্লুর একটু রেগে বললো
-তা, তুমি যেহেতু একটু বেশী বোঝ তাহলে একটু চুপ থাকো ভাইটি।
ঠোঁটে আড়াআড়ি তর্জনী রেখে জগলু বললো
-আচ্ছা আমি চুপ। মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললো
-তোমরা চুপ কেন দীনা? মিনু রোজী কিছু তো বলো!
ওর মুখ লুকিয়ে হাসলো।
দীনা জগলুকে বললো
-জনাব, আমরা এখন আসি।
জিল্লুরঃ সে কী! মাত্র তো এলেন! এখনই যাবেন?
দীনাঃ কেন?
জিল্লুরঃ আপনাদের তো কোন আপ্যায়নই করতে পারলাম না!
দীনাঃ পরে কোন একদিন না হয় করাবেন। আজকের আপ্যায়নটা বাকী রইলো।
জগলুর দিকে তাকিয়ে
-জনাব আমরা এখন আসি,
জগলুঃ এসো, খালাম্মা খালুকে আমার সালাম দিও। আমার জন্য দোয়া করতে বলো।
দীনাঃ আচ্ছা, বলবো জনাব।
আসসালামু ওয়ালাইকুম।
জগলুঃ ওয়ালাইকুম সালাম
দীনাঃ এই তোরা চল বাড়ী যাই।
দীনা যাবার সময় জিল্লুরের দিকে একটু মুচকি হাসি দিয়ে হাত নেড়ে বোঝালো আসি। জিল্লুর ওদের যাবার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
জগলু রসিকতা করে বললো
-ওদের তো আর দেখা যাচ্ছে না, চোখ ফেরাও বন্ধু…
জিল্লুরঃ দাড়া, শেষ পর্যন্ত দেখতে দে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিল্লুর বললো
চল আমরাও যাই।
জগলুঃ হুম, চুপ থাকার চেয়ে চলে যাওয়া ভালো।
দুই বন্ধু হাটঁতে হাঁটতে মিলিয়ে গেলো সাঝের আঁধারে।
৭ম পর্বঃ ইবলিশ চত্বরে মুখোমুখি
উপন্যাসঃ অতল জলে জলাঞ্জলী
এ কে সরকার শাওন
শাওনাজ ভিলা, উত্তরখান, ঢাকা।