থাইল্যান্ডে বাড়ছে চিকিৎসা পর্যটন, সুযোগ-সুবিধা কেমন?
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় চিকিৎসা পর্যটন গন্তব্য হচ্ছে থাইল্যান্ড। দেশটির চিকিৎসা পর্যটন শিল্প ক্রমেই বাড়ছে। ২০০০ সালের পর থেকে গত দুই দশকে থাইল্যান্ডে যাওয়া চিকিৎসা পর্যটকদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফলে আন্তর্জাতিক চিকিৎসা পর্যটনখাতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটি উঠে গেছে অনেকটাই ওপরে। থাইল্যান্ডে চিকিৎসা পর্যটন জনপ্রিয় হওয়ার কারণ প্রধানত তিনটি। আর সেগুলো হলো- কম খরচে মানসম্পন্ন চিকিৎসা, উন্নতমানের বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র এবং উন্নত পর্যটন শিল্প।
২০২৩ সালের মেডিকেল ট্যুরিজম ইনডেক্স’র তথ্য অনুসারে, সারা বিশ্বের প্রায় ২০ লাখ মেডিকেল ট্যুরিস্ট গত বছরে থাইল্যান্ড ভ্রমণ করেছেন এবং এতে করে দেশটি মেডিকেল ট্যুরিজমখাতে বিশ্বের ৪র্থ জনপ্রিয় দেশ হয়ে উঠেছে। রোগীদের জন্য সাশ্রয়ী চিকিৎসা পদ্ধতি এবং উচ্চদক্ষতা সম্পন্ন চিকিৎসকদের সেবা প্রদানের কারণে থাইল্যান্ড বহুসংখ্যক রোগীর কাছে অগ্রাধিকার গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
মেডিকেল ট্যুরিজম
মেডিকেল ট্যুরিজম বলতে চিকিৎসা পদ্ধতি বা চিকিৎসার জন্য অন্য কোনও দেশে ভ্রমণকে বুঝিয়ে থাকে। মূলত লোকেরা প্রায়শই বিভিন্ন কারণে চিকিৎসা পর্যটনের খোঁজ করে থাকেন, যার মধ্যে কম চিকিৎসা, অস্ত্রোপচারের জন্য অপেক্ষার সময় কতটা কম বা অন্য পরিবেশে অবসর বা বিশ্রামের ফাঁকে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার সুযোগের মতো বিষয়গুলোও এর মধ্যে রয়েছে।
জনপ্রিয় চিকিৎসা পর্যটন গন্তব্যগুলো সাধারণত উচ্চ মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দক্ষ ও পেশাদার কর্মী দিয়ে চিকিৎসা নিশ্চিত করে এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। এর পাশাপাশি রোগীদের এবং তাদের সঙ্গে থাকা ব্যক্তিদের যাত্রা আরামদায়ক এবং সুবিধাজনক করতেও এসব দেশ বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করে থাকে।
থাইল্যান্ডে প্রায় এক হাজার হাসপাতাল রয়েছে, যার মধ্যে ৪৭০ টিরও বেশি বেসরকারি ক্লিনিক। এছাড়া এশিয়ার মহাদেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি হাসপাতালও রয়েছে দেশটিতে। দেশটির বিখ্যাত বামরুনগ্রাদ ইন্টারন্যাশনাল হসপিটালের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে থাই মেডিকেল ট্যুরিজমের প্রবৃদ্ধি হবে অন্তত ৪৩ শতাংশ। ফলে থাই মেডিকেল ট্যুরিজম খাতের আর্থিক আকার দাঁড়াবে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
থাইল্যান্ডে মেডিকেল ট্যুরিজমের সুবিধা
থাইল্যান্ডে চিকিৎসার খরচ বেশ অনেকটাই কম। মূলত পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় দেশটিতে চিকিৎসার খরচ সাধারণত ২০-৫০ শতাংশ কম। সাশ্রয়ী চিকিৎসার কারণে চিকিৎসা পর্যটকরা দেশটিতে ঘোরাঘুরি করার জন্য অর্থও সঞ্চয় করতে পারেন।
এছাড়া থাইল্যান্ডের বেসরকারিখাত ক্রমবর্ধমানসংখ্যক চিকিৎসা অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব অবকাঠামোগুলোকে বিশ্বের সেরা হাসপাতালগুলোর সাথেও তুলনা করা যেতে পারে। এছাড়া থাইল্যান্ডের চিকিৎসকরাও একইভাবে সুশিক্ষিত এবং প্রশিক্ষিত। তাদের অনেকেরই যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ বা উভয় জায়গা থেকে পাওয়া পেশাদার সনদপত্রও রয়েছে।
অত্যন্ত উন্নত পর্যটন অবকাঠামো কারণে থাইল্যান্ড হচ্ছে মনোমুগ্ধকর সৈকত ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক বিস্ময়কর দেশ। আর এটিই দেশটিকে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় অবকাশ স্থলে পরিণত করেছে। দেশটি জনগণের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে এবং সুস্বাদু রন্ধনপ্রণালী নিয়ে গর্ব করার পাশাপাশি তারা পর্যটকদের স্বাগত জানাতেও সবসময় মুখিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ থেকে থাইল্যান্ডে মেডিকেল ট্যুরিজম
কেউ যদি থাইল্যান্ডকে তার মেডিকেল ট্যুরিজম গন্তব্য হিসাবে বিবেচনা করেন বা থাইল্যান্ডে ভ্রমণে যেতে চান তবে ঝামেলাহীন ভ্রমণের জন্য আগাম কিছু পরিকল্পনা করা ভালো। একইভাবে বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড যাওয়ার আগে অবশ্যই কিছু বিষয় জেনে নিতে হবে।
কোন হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা নিতে চান, থাইল্যান্ডের ভিসা নীতি এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে ভ্রমণের জন্য কোন কোন কাগজপত্র সাথে রাখতে হবে সে সম্পর্কে আগেই যথেষ্ট তথ্য জেনে নেওয়া উচিত।
এটি অনেকের কাছে জটিল বলে মনে হলেও বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে যাওয়ার আগে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনে যাওয়াই উত্তম।
১. চিকিৎসা সুবিধা এবং পরিষেবা
উন্নত প্রযুক্তি, সাশ্রয়ী মূল্যের চিকিৎসা সেবা এবং উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন চিকিৎসকদের সাহায্যে উচ্চমানের চিকিৎসা সুবিধা প্রদানের জন্য থাইল্যান্ড বিখ্যাত। দেশটির ব্যাংকক, ফুকেট এবং চিয়াং মাইয়ের মতো প্রধান শহরগুলোতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হাসপাতাল রয়েছে। এই হাসপাতালগুলো জটিল সার্জারি থেকে রুটিন চেক-আপ পর্যন্ত বিস্তৃত চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান করে থাকে।
চিকিৎসা কাজে আধুনিক ওষুধের ব্যবহারের পাশাপাশি প্রায়ই ঐতিহ্যগত থাই ম্যাসেজ, সামগ্রিক চিকিৎসা এবং ভেষজ ওষুধও অন্তর্ভুক্ত থাকে। এছাড়া থাইল্যান্ডে আকর্ষণীয় স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা রিসোর্ট ও স্পা রয়েছে যা ডিটক্স প্রোগ্রাম, মেডিটেশন, যোগব্যায়াম এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য-বিষয়ক সেবা প্রদান করে।
২. ভিসা এবং অন্যান্য নথিপত্র
চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে যেতে হলে সঠিক ভিসা পাওয়া নিশ্চিত করা জরুরি। চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র, অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিশ্চিতকরণের নথি, প্রয়োজনীয় তহবিলের প্রমাণ এবং ভ্রমণের সময়সূচী-সহ বাংলাদেশে থাই দূতাবাস বা কনস্যুলেটের সহায়তায় মেডিকেল ভিসার (অ-অভিবাসী ভিসা “O”) জন্য আবেদন করতে হবে।
৩. খোঁজ-খবর নিয়ে সঠিক হাসপাতাল নির্বাচন
থাইল্যান্ডে যাওয়ার আগে রোগের ধরন অনুযায়ী সেরা হাসপাতাল বেছে নেওয়া উচিত। সেরা হাসপাতাল বেছে নিতে কিছু পদক্ষেপ অনুসরণ করা যেতে পারে। যেমন- যে ক্লিনিক বা হাসপাতালে আপনি যেতে চাচ্ছেন সেটি প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত এবং স্বীকৃত কিনা নিশ্চিত করতে হবে।
এর পাশাপাশি পূর্ববর্তী রোগীদের তথ্য পর্যালোচনা এবং অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ করে হাসপাতালের চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে হবে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে যথেষ্ট দোভাষী বা ইংরেজি-ভাষী কর্মী আছে কিনা সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
৪. ভ্রমণ এবং আবাসন ব্যবস্থা
বাংলাদেশ থেকে ফ্লাইটে উড্ডয়নের আগেই আবাসনের যথাসম্ভব ব্যবস্থা করতে হবে। এতে থাইল্যান্ডে পৌঁছানোর পর ঝামেলা অনেকটাই কমবে। চিকিৎসার জন্য ও চিকিৎসা-পরবর্তী সময়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য হাসপাতালের কাছাকাছি থাকার ব্যবস্থা করা ভালো।
৫. সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বাস্তবতা বিবেচনায় রাখা
অস্বাভাবিক কোথাও যাওয়ার আগে থাইল্যান্ডের সংস্কৃতি এবং শিষ্টাচার, জলবায়ু ও আবহাওয়ার পাশাপাশি জরুরি যোগাযোগের ক্ষেত্রগুলো জেনে রাখা ভালো। থাই রীতিনীতি এবং শিষ্টাচার, যেমন পোষাক রীতি এবং সম্মানজনক আচরণ বজায় রাখা উচিত এবং এগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত।
থাইল্যান্ডের গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুর জন্য উপযুক্ত এবং পর্যাপ্ত পোশাক সাথে রাখতে হবে এবং হাসপাতালে চিকিৎসা সংক্রান্ত পোশাকের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি এক্ষেত্রে আবহাওয়াকেও বিবেচনায় রাখা উচিত।
প্রসঙ্গত, থাইল্যান্ডে বিদেশি যত রোগী যায়, তার অর্ধেক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো নাগরিক। আর বাকিরা আসের মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে। এর বাইরে ইথিওপিয়া ও কেনিয়া থেকেও বেশ কিছু রোগী প্রতিবছর থাইল্যান্ডে ভ্রমণ করে থাকেন।
তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ, চীন, মিয়ানমার ও কম্বোডিয়া থেকেও থাইল্যান্ডে যাওয়া রোগীর সংখ্যা বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।