ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু
আশিকুজ্জামান আশিক (১৬), রাজশাহী : “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো”এ উক্তি দিয়েছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, সমগ্র বাংলা তথা বাঙালীর গর্ব নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম হয় ১৮৯৭ সালের ২৩শে জানুয়ারী, বর্তমান ওড়িশার কটক শহরে| তাঁর বাবার নাম ছিলো শ্রী জানকীনাথ বসু এবং মা ছিলেন শ্রীমতী প্রভাবতী দেবী|
বাবার কাছে ইংরেজি শিখে দুনিয়া জয়ের কথা আর গৃহিণী মায়ের কাছে ভারতের রূপকথার গল্পের মাধ্যমে পারিবারিক শিক্ষা শুরু। বাবা তার ইচ্ছানুযায়ী ভর্তি করে দিলেন র্যাভেন ‘শ কলেজে। সেখানে গিয়েই বাঙালি আর ইংরেজি-সংস্কৃতির চিরাচরিত দ্বন্দ্ব সুভাষকে একটু একটু করে আঘাত করলো। কিন্তু মাকে লেখা এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, তিনি আর যা-ই করেন পিতৃপুরুষের সংস্কৃতি জলাঞ্জলি দিতে পারবেন না।
১৯১৩ সালে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজেও ভর্তি হয়েছিলেন।একদিন প্রেসিডেন্সী কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষ একদিন তার ক্লাস লেকচারে ভারতীয়দের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে বসলেন।নেতৃত্বেই একদল ছাত্র প্রতিবাদ করলো অধ্যক্ষের এই মন্তব্যের। ইংরেজ অধ্যক্ষ ভারতীয় ছাত্রদের এই আচরণকে মোটেই ভালভাবে নিতে পারলেন না। বরং দৈহিক আক্রমণের অভিযোগ তুলে সুভাষ চন্দ্রকে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বহিষ্কার করে দিলেন।
প্রতিবাদী সুভাষ এরপর ভর্তি হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্কটিশ চার্চ কলেজে। সেখান থেকে ১৯১৮ সালে বিএ পাশ করেন।
এরপর সুভাষচন্দ্র কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজউইলিয়াম হলে উচ্চশিক্ষার্থে ভর্তি হন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়ে তিনি প্রায় নিয়োগপত্র পেয়ে যান।
কিন্তু বিপ্লব-সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি সেই নিয়োগ প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো সরকারের সমাপ্তি ঘোষণা করার সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হল তা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া।’
১৩ই এপ্রিল ১৯১৯, যখন অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ড ও দমনমূলক রাওলাট আইন সমস্ত ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে । এইরুপ বিশৃঙ্খলার পর, নেতাজী ‘স্বরাজ’ নামক একটি খবরের কাগজের হয়ে লেখালেখি শুরু করেন এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচারের দায়িত্বে নিযুক্ত হন |
এরপর চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৪ সালে যখন কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র হন, সেইসময় সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর অধীনে কাজ করতেন । চিত্তরঞ্জন দাশই ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক গুরু, কারণ তাঁর কাছ থেকেই সুভাষচন্দ্রের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় |রাজনৈতিক জীবনে, প্রায় ১১ বার গ্রেফতার হন ব্রিটিশদের হাতে |
১৯৩৮ সালে তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন আর ১৯৩৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য ত্রিপুরা অধিবেশনে কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন ।
সুভাষচন্দ্র বসু এই নির্বাচনে জয়লাভ করলেও গান্ধীজির বিরোধিতার ফলস্বরূপ তাকে বলা হয় পদত্যাগ পত্র পেশ করতে; নাহলে কার্যনির্বাহী কমিটির সব সদস্য পদত্যাগ করবে । এইসব নানা কারণে তিনি অবশেষে নিজেই কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেণ এবং “ফরওয়ার্ড ব্লক” নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন ।
জার্মানি গিয়ে তিনি প্রথমে বার্লিনে “ভারতীয় মুক্ত কেন্দ্র” গড়ে তোলেন, আর তারপর ভারতের স্বাধীনতার জন্য তিনি জার্মান নেতা এডলফ হিটলারের সাহায্য চান কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সাহায্যের ব্যাপারে এডলফ হিটলারের কোনো ইচ্ছা না থাকায়, তিনি তা বুঝতে পেরে খুব দুঃখ পান | এরপর ১৯৪৩ সালে তিনি অবশেষে জার্মানি ত্যাগ করেন এবং একটি সাবমেরিনে চেপে পোঁছে যান জাপানে, হিদেকি তোজোর সাহায্যের আশায় |
জাপানে রাসবিহারি বসু গড়ে তুলেছিলেন ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী | ১৯৪৩ সালে সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে তিনি সেই বাহিনীর দায়িত্ব তুলে দেন | নারী-পুরুষ মিলিয়ে এই বাহিনীতে মোট সৈন্য সংখ্যা ছিলো প্রায় ৮৫০০০ মতো | পরে এই বাহিনীর নাম বদলে “আজাদ হিন্দ” করে দেওয়া হয় |
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে যখন জাপান আত্মসমর্পণ করে আমেরিকার কাছে, তখন সেইসাথে তাঁর জাতীয় সেনাবাহিনীও আত্মসমর্পণ করে নেয় |
ধারণা করা হয়, ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইওয়ানে একটি বিমান দুর্ঘটনায় সুবাষ চন্দ্রের মৃত্যু হয়। তবে তার এই তথাকথিত দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর বিরুদ্ধ প্রমাণও বিদ্যমান।
ভারতে তুমুল জনপ্রিয় এই নেতার মৃত্যু সংবাদ অনেকেই মেনে নিতে পারেননি।অনেকে আবার আশায় বুক বেঁধেছিলেন সুভাষ হয়তো তার নেতৃত্বের ঝলকানিতে অন্ধকার ভারতে আলো নিয়েই ফিরবেন।
সুভাষের আর ঘরে ফেরা হয়নি, ‘নেতাজী’ হয়েই চিরকাল বেঁচে রইলেন ভারতের সাধারণ মানুষের অন্তরের মণিকোঠায়। কিন্তু তার দেখানো সংগ্রামী পথে হেঁটেই ভারত ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। যুগে যুগে বিপ্লবীদের প্রেরণা হয়ে তাই আজও বেঁচে আছেন ‘নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু’।