গভীর ভালোবাসার কারণে নির্মমভাবে কেড়ে নেয়া হয় তার প্রাণ!
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : নীলনদের পূর্ব তীরের শহর থিবেসে তখন গভীর রাত। হাতে মশাল ধরে গুটি পায়ে লোকের আড়ালে নির্জন এক গলিপথ ধরে প্রেমিকের কাছ থেকে নিজ ঘরে ফিরছিলেন এক নারী।
হঠাৎই আড়াল থেকে এক আততায়ী ছুটে আসে ওই নারী দিকে। ছুটে পালাতে গেলেও ব্যর্থ হন নারী। ততক্ষণে তার বুকের পাজর ভেদ করে গেছে আট ইঞ্চির ছুড়ি। অন্ধকার সেই রাতে হয়ত মৃত্যুর আগে আততায়ীর মুখটিও দেখতে পারেনি নারী। ওই নারী নাম ছিল তাকাবুতি।
প্রায় ২৬০০ বছর আগের ঘটনা এটি। তবে তার খুনের রহস্য এতোদিনেও উন্মোচিত হয়নি। সম্প্রতি, তার খুনের বিষয়টি সম্পর্কে জানিয়েছেন গবেষকরা। ধারণা করা হয়, গভীর ভালোবাসাই হয়ত তার মৃত্যুর কারণ ছিল। তিনি ইউরোপের বাসিন্দা ছিলেন বলে জানায় গবেষকরা। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, তার মমিতে হৃদপিণ্ড খুঁজে পাওয়া যায়।
বিখ্যাত মিশর বিশেষজ্ঞ পুরাতত্ত্ববিদ এডয়ার্ড হিঙ্কস, ১৮৩৫ সালের ২৭ জানুয়ারি ‘বেলফাস্ট ন্যাচরাল হিস্টরি মিউজিয়াম’এ থাকা এই কফিনটি খুলেছিলেন। সারকোফেগাসের (কফিন) ওপর লেখা হায়ারোগ্লিফিক লিপি পড়ে হিঙ্কস জানিয়েছিলেন কফিনের ভেতর শুয়ে আছেন এক বিবাহিতা যুবতী, যার নাম তাকাবুতি।
মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ২০ থেকে ৩০ এর মধ্যে। তাকাবুতি ছিলেন সম্ভ্রান্তবংশের মেয়ে। সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন কোনো সম্ভ্রান্তবংশের পুরুষের স্ত্রী। তবে কোনো রাজপুরুষের রক্ষিতা হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি এডয়ার্ড হিঙ্কস। তাকাবুতির বাবার নাম ছিল নেসপারে, যিনি ছিলেন দেবতা আমুনের পুরোহিত। মায়ের নাম ছিল তাসেনিরিক।
তাকাবুতির শরীর থেকে ব্যান্ডেজ খুলে চমকে গিয়েছিলেন এডয়ার্ড হিঙ্কস ও তার সহযোগীরা। কফিনের মধ্যে শুয়ে থাকা যুবতী তাকাবুতির মুখের রং অস্বাভাবিক রকমের কালো। মাথার চুল সোনালি। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় মমি পরীক্ষা করার অভিজ্ঞতা ছিল এডয়ার্ড হিঙ্কসের।
তবে এরকম মমি এর আগে কখনো দেখেননি তিনি। তাকাবুতির কফিনের ওপরের আঁকা মানুষের মুখের ছবিটি দেখে আঁকা হয়েছিল তাকাবুতির কাল্পনিক ছবি। এর পর কেটে যায় ১৮৫ বছর। এই সময়কালে তাকাবুতিকে নিয়ে বহু গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। জানা গিয়েছে তাকাবুতির বয়স ২৬০০ বছর।
মিশরের ২৫তম রাজবংশ বা নুবিয়ান রাজত্বের শেষ দিকের কোনো সময়ে তিনি মারা যান। সম্ভবত ৬৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সর্বাধুনিক ফেস-রিকন্সট্রাকশান পদ্ধতির সাহায্যে জানা যায় তাকাবুতির চেহারা কেমন ছিল? তবে এত গবেষণার পরেও তাকাবুতির মৃত্যুর কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
তাকাবুতির মৃত্যুর রহস্য জানার পূর্বে আগে জেনে নিন তার মমির কফিনটি মিউজিয়ামে কীভাবে এসেছিল? উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বিশ্বজুড়ে মমি পাচার ও বিক্রির রমরমা ব্যবসা ছিল। ১৮৩৪ সালে আয়ারল্যান্ডের হলিউড শহরের শিল্প সংগ্রাহক থমাস গ্রেগ তার ডিলারের কাছ থেকে এমন এক মমির কথা জানতে পারেন। তার মিশরায় ডিলার জানায়, তিনি যেমন মমি খুঁজছিলেন তা মিশরের পশ্চিম থিবেসের সুপ্রাচীন সমাধিক্ষেত্র থেকে পাওয়া গিয়েছে।
কিছুদিনের মধ্যেই তা মিশর থেকে জাহাজে করে ইউরোপে পাঠানো হবে। নির্দিষ্ট সময়ে থিবেস থেকে বেলফাস্টে এসেছিল একটি মিশরীয় সারকোফেগাস (কফিন)। কফিনটির ভেতরে কয়েক হাজার বছর ধরে শুয়ে ছিল এক মমি। নিজের সংগ্রহশালায় রাখার জন্য থমাস গ্রেগ একটি মমি কিনতে চেয়েছিলেন। তবে চড়া দাম দিয়ে কিনেও, মমিটি নিজের কাছে রাখতে পারেননি গ্রেগ।
কারণ আয়ারল্যান্ডে আসা প্রথম মিশরীয় মমিটিকে ঘিরে প্রবল চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। স্থানীয় কাগজে হইচই পড়ে গিয়েছিল। মমিটির কফিন খোলার জন্য প্রায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন আয়ারল্যান্ডের জনগণ। বাড়িতে মমিটি না রেখে এবং কফিনের ঢাকনা না খুলেই থমাস গ্রেগ মমিটি দিয়ে দিয়েছিলেন উলস্টার মিউজিয়ামকে ১৮৩৫ সালে। এরপরই বিশেষজ্ঞ পুরাতত্ত্ববিদ এডয়ার্ড হিঙ্কসে মমিটি পরীক্ষা করেন।
তাকাবুতির মৃত্যু রহস্য ভেদ হলো যেভাবে
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে একদল গবেষক জানান, নির্মমভাবে খুন করা হয়েছিল সুন্দরী তাকাবুতিকে। গবেষকদের দলে ছিলেন ম্যাঞ্চেস্টার ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রোসাইলি ডেভিড, প্রফেসর টনি ফ্রিমন্ট, ডঃ বার্ট ভ্যান ডঙ্গেনসহ প্রমুখ।
তারা অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে তাকাবুতির মমির এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, চুলের পরীক্ষা ও রেডিও কার্বন ডেটিং করে। করা হয় ডিএনএ পরীক্ষাও। এসব পরীক্ষার ফলাফল চমকে দেয় গবেষকদের। সিটিস্ক্যানে দেখা যায়, তাকাবুতির বাঁ দিকের পিঠে গভীর ক্ষত। ক্ষত পরীক্ষা করে গবেষকেরা নিঃসন্দেহ হয়েছেন বড় ও ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করে খুন করা হয়েছিল তাকাবুতিকে।
তার ডিএনএ পরীক্ষা থেকে জানা যায়, তাকাবুতির জিনের সঙ্গে মিশরীয়দের জিনের মিলই নেই বরং মিল আছে ইউরোপীয়দের সঙ্গে। বিজ্ঞানী ড. কনস্টান্টিনা ড্রোসোউ বলেছেন, তাকাবুতির ‘এইচফোরএওয়ান’ জিন মিশরে বিরল। মিশরের প্রাচীন ও আধুনিক মানুষের মধ্যেও এই জিন পাওয়া যায়নি।
গবেষণা থেকে আরো জানা যায়, তাকাবুতির ৩২টির জায়গায় ৩৩টি দাঁত ছিল। তার মেরুদণ্ডে ৩৩টির জায়গায় ৩৪টি কশেরুকা বা ভাটিব্রা ছিল। তাকাবুতির চুলের রং স্বাভাবিক ভাবেই ছিল কালো। তবে সেগুলো কৃত্রিমভাবে কুঞ্চিত ও সোনালি করা হয়েছিল।
জানা গিয়েছে, চর্বি দিয়ে চুলের যত্ন করতেন তাকাবুতি। খেতেন উদ্ভিজ্জ প্রোটিন ও স্বাদু জলের মাছ। সেই যুগে অভিজাতবংশের নারীরা মাথার চুল সম্পূর্ণ কামিয়ে ফেলতেন। তাকাবুতি কেন সেই প্রথা মানেননি, তা নিয়ে অবাক গবেষক দলটি।
তাকাবুতির শরীরের ভেতরে পাওয়া গিয়েছিল হৃদপিণ্ড। মিশরীয় প্রথায় মমি করার সময় মৃত মানুষের শরীরের ভেতরের সমস্ত অঙ্গ বের করে নেয়া হয়। কারণ প্রাচীন মিশরীয়রা মৃত্যুকে জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় বলে মনে করত। তবে তাকাবুতি হৃদপিণ্ডটি শরীরের সঙ্গে লাগানোই ছিল।
মিশরীয়রা মমি করার সময় কেন প্রথার বাইরে গিয়ে তাকাবুতির হৃদপিণ্ডটি শরীরের ভেতরে রেখে দিয়েছিল, এ প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি। তবে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনিভার্সিটির রবার্ট লয়েনস, যিনি তাকাবুতির সিটিস্ক্যান করেছিলেন, তিনি বলেছেন, সিটিস্ক্যানের ফলাফল দেখলে বোঝা যাবে তাকাবুতিকে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে মমি করা হয়নি। তাকাবুতির ক্ষেত্রে কিছু কিছু প্রথাবহির্ভূত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল। যা অন্যান্য মমির ক্ষেত্রে করা হয় না।
বর্তমানে উলস্টার মিউজিয়ামের প্রাচীন মিশরের গ্যালারিতে তাকাবুতির মমিটি রাখা আছে। বিজ্ঞান বলছে তিনি অন্যের হাতে বীভৎসভাবে খুন হয়েছিলেন। তবে ইতিহাস ও বিজ্ঞান এখনো বলতে পারেনি তাকাবুতিকে কে খুন করেছিল, কেনই বা খুন করেছিল।