প্রথম মুসলিম নারী শাসক, সিংহাসন পেতে কী করেছিলেন?
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : কোনো নারী রাজ্য পরিচালনা করছে। একথা মধ্যযুগে যেন ভাবতেই পারত না কেউ। তবে ইতিহাস বলে নারীরা সফলভাবেই শাসন করেছেন তাদের রাজ্য। নারীরা তাদের বুদ্ধিমত্তা, ক্ষমতা আর যোগ্যতা দিয়েই সফলভাবে রাজ্য পরিচালনা করেছেন।
ক্লিওপেট্রা ছিলেন নারী শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে সফল আর অন্যতম একজন। জানেন কি? মধ্যযুগে নারী শাসকদের মধ্যে প্রথম মুসলিম নারী শাসক কে ছিলেন? আজকের লেখায় থাকছে এই নারী শাসকের দুঃসাহসিক রাজ্য পরিচালনার কাহিনী নিয়েই।
রাজিয়া ছিলেন দিল্লির মামলুক সুলতানিতের প্রথম এবং একমাত্র নারী শাসক। আরবিতে তাকে ডাকা হত রাদিয়া নামে। তিনি ১২৩৬ থেকে ১২৪০ সাল পর্যন্ত প্রায় চার বছর রাজত্ব করেছিলেন। বাবার পরবর্তী উত্তরসূরি হিসেবে সিংহাসনে বসেন। তার যোগ্যতা এবং বুদ্ধিমত্তার কারণে দুই ভাই থাকা সত্ত্বেও তিনি সিংহাসনে বসার সুযোগ পেয়েছিলেন।
সেসময় মুসলিম বিশ্ব এবং খ্রিস্টান ইউরোপ উভয় ক্ষেত্রেই খুব কম রাজ্যেই নারী শাসক ছিল। আর সেসময় এটি খুবই অস্বাভাবিক ছিল। যখন বৈধ কোনো পুরুষ উত্তরাধিকারী থাকত না তখন বাধ্য হয়ে নারীদের শাসনের ভার দেয়া হত। তবে রাজিরার বেলায় হয়েছিল তার উল্টা। তার সৎ দুই ভাই উত্তরাধিকারী হিসেবে থাকার পরও তিনি শাসক হয়েছিলেন।
সুলতান শামস আল-দীন ইলতুৎমিশের ঘরে ১২০৫ সালে রাজিয়ার জন্ম হয়। ইলতুৎমিশ ছিলেন তুর্কি দাস। তিনি মধ্য এশিয়ার উপত্যকা থেকে ভারতে দাস হয়ে এসেছিলেন। তাকে কিনেছিলেন কুতুব আল-দিন আইবাক নামের একজন। তিনি ছিলেন মামলুক দাস বংশের প্রতিষ্ঠাতা। আরো পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে রাজবংশের শাসকরা সবাই পূর্বসূরীদের বংশধর ছিলেন না।
অনেকেই অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। তেমনি একজন ছিলেন কুতুব আল-দিন আইবাক। রাজিয়ার মা তুরকান খাতুন ছিলেন কুতুব আল-দ্বীন আইবাকের কন্যা। ইলতুৎমিশ স্ত্রীর জন্যই তার শ্বশুরের রাজ্যের সিংহাসনে বসেছিলেন। ইলতুৎমিশের শাসনামলে ভারতে মুসলিম শাসন খুবই শক্তিশালী হয়েছিল।
ভারতে ইসলামের প্রচার সেই সঙ্গে বর্ণবাদ দূর করেছিলেন তিনি। বিশেষত নিম্নবিত্তদের মধ্যে যারা ছিল ইলতুৎমিশ তার বড় ছেলে নাসিরুদ্দীন মাহমুদকে তার উত্তরসূরি হিসাবে গড়ে তোলেন। তবে অপ্রত্যাশিতভাবে নাসিরুদ্দীন মাহমুদ ১২২৯ সালে মারা যান। তার অন্যান্য পুত্ররা বিপথে চলে যাওয়ায় একমাত্র নাসিরুদ্দিনকেই যোগ্য মনে করেছিলেন তিনি।
১২৩১ সালে ইলতুৎমিশ গোয়ালিয়র ক্যাম্পেইগিনে যান। সেসময় রাজিয়াকে দিল্লির প্রশাসনের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। রাজিয়া তার দায়িত্ব এত ভালোভাবে পালন করেছিলেন যে, দিল্লীতে ফিরে আসার পরে, ইলতুৎমিশ তার উত্তরসূরির নাম রাখার সিদ্ধান্ত নেন। ইলতুৎমিশ তার মন্ত্রী মুশরিফ-ই মামলাকত তাজুল মুলক মাহমুদ দবিরকে উত্তরাধিকারী হিসেবে রাজিয়ার নাম ঘোষণা করার নির্দেশ দেন।
অনেকেই সেসময় এ নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছিলেন। পুত্র সন্তান থাকা স্বত্বেও কেন তিনি রাজিয়াকে উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করলেন। ইলতুৎমিশ সবার প্রশ্নের একটিই মাত্র উত্তর দিয়েছিলেন, রাজিয়া তার পুত্রদের চেয়ে বেশি দক্ষ। তবে ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পরে অভিজাতরা সর্বসম্মতিক্রমে রাজিয়ার সৎ ভাই রুকনউদ্দিন ফিরুজকে নতুন রাজা হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন। তবে রুকনউদ্দীনের রাজ্য পরিচালনা করার সক্ষমতা ছিল না।
প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের সব দায়িত্ব তার মা শাহ তুর্কানের হাতে ছেড়ে দেন। রুকনউদ্দিন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কুহরাম অভিমুখে যাত্রা করেন। তখন শাহ তুর্কান দিল্লীতে রাজিয়াকে ফাঁসানোর নানা পরিকল্পনা করেই চলেছেন। একদিন নামাজে জমায়িত মানুষদের রাজিয়া শাহ তুর্কের বিরুদ্ধে উস্কে দেন। এরপরে সাধারণ জনতা রাজ প্রাসাদে আক্রমণ করে শাহ তুরকানকে আটক করে।
একথা শুনে রুকনউদ্দিন আবার দিল্লীতে ফিরে আসার জন্য যাত্রা করেন। তখনই রাজিয়ার বাহিনী তাকে বন্দী করে। ১৯৩৬ সালের ১৯ নভেম্বর রুকনউদ্দিনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। রুকনউদ্দিন সাত মাসেরও কম সময় সিংহাসনে থাকতে পেরেছিলেন। এরপর সিংহাসনে বসেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী মুসলিম শাসক রাজিয়া শাহ। সেই সময় সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি রাজিয়ার পক্ষে ছিলেন।
অল্পদিনেই রাজিয়া তার দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সবার মন জয় করে নেন। তবে রাজত্বের প্রথম থেকেই রাজিয়া তুর্কি বংশোদ্ভুত অভিজাতদের কঠোর বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি শক্তিশালী তুরস্ক-বংশোদ্ভূত প্রাদেশিক গভর্নরদের চেয়ে দিল্লির সাধারণ জনগণের সমর্থনে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। তুর্কিদের একেবারেই পাত্তা দিতেন না তিনি।
রাজিয়া বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দিল্লির দুর্গ শহর থেকে একটি বাহিনীকে নেতৃত্ব দেয়। রাজিয়ার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রথম সামরিক অভিযানটি ছিল রন্থাম্বোরের আক্রমণ। যার চাহামানা শাসক ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পরে তার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রাজিয়ার রাজত্বকালে শিয়ারা সুলতানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। সেটিও রাজিয়ার কৌশলী দক্ষতার ফলে সফলভাবে দমন করা সম্ভব হয়েছিল। এছাড়াও অনেক বিদ্রোহ দমন করে টিকে ছিলে রাজিয়া। ১২৪০ সালের এপ্রিলে একদল অভিজাতদের দ্বারা তিনি পদচ্যুত হন। এরপর ইখতিয়ারউদ্দীন আলতুনিয়া নামের একজন বিদ্রোহীকে বিয়ে করেন রাজিয়া।
এটি ছিল তার সিংহাসন ফিরে পাওয়ার একটি কৌশল মাত্র। তবে তা আর সম্ভব হয়নি। সে বছরের অক্টোবরে তার সৎ ভাই মুইজউদ্দিন বাহরামের কাছে পরাজিত হন রাজিয়া। এরপরই তাকে হত্যা করা হয়। রাজিয়া মাত্র তিন বছর ছয় মাস ছয় দিন রাজত্ব করতে পেরেছিলেন।
প্রাচীন দিল্লিতেই রাজিয়ার সমাধি অবস্থিত। চতুর্দশ শতাব্দীর ভ্রমণকারী ইবনে বতুতা উল্লেখ করেছেন, রাজিয়ার সমাধিটি তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে। এক গম্বুজবিশিষ্ট সমাধিটির কাছে অনেকেই আশীর্বাদ চাইতে আসতেন। কথিত আছে, রাজিয়ার সমাধিটি তার সৎ ভাই বাহরামই নির্মাণ করেছিলেন। রাজিয়ার পাশেই তার বোন শজিয়ার সমাধি রয়েছে।
রাজিয়া সুফী সাধক শাহ তুর্কিমান বায়াবানীর এক ভক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে তার সমাধিস্থ স্থানটিই সুফী সাধকের খানকাহ হিসেবে পরিচিতি পায়। অবহেলায় আর অযত্নে আজ সমাধি প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। ২০ শতকের শেষদিকে স্থানীয় বাসিন্দারা এর পাশেই একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে কাইঠালের একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন রাজিয়ার মূল সমাধির স্থান হিসাবে প্রতীয়মান।
১৯৮৩ সালে রাজিয়ার একটি বায়োপিক তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে রাজিয়ার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বলিউডের অন্যতম একজন অভিনেত্রী হেমা মালিনী। ২০১৫ সালে রাজিয়ার জীবন সম্পর্কিত একটি টিভি সিরিজ প্রচার করতে শুরু করে একটি চ্যানেল। টিভি শোটি রাজিয়া সুলতানের প্রকৃত ইতিহাস থেকে অনেক দূরে ছিল। সেখানে দর্শকদের আকৃষ্ট করার জন্য কিছু মনগড়া সিকোয়েন্স দেখানো হয়। টিভি সিরিজে রাজিয়ার ভূমিকায় অভিনয় করেন পানখুরি অবাস্তি।