আগে জীবিকা, নাকি জীবন?
জীবন না থাকিলে জীবিকার কোনো প্রশ্নই আসে না। কিন্তুু জীবিকা না থাকিলে জীবন টিকবে কী করে? তার মানে, মহামূল্যবান জীবনকে রক্ষা করতে জীবিকাই একমাত্র অক্সিজেন। সেই অক্সিজেন ছাড়া বাঁচবে না জীবন। স্পষ্টতই উভয়ে উভয়ের পরিপূরক। করোনার হাত হইতে জীবন বাঁচানোটাই এখন সর্বাগ্রে প্রাধান্য পাইতেছে।
আসলে করোনা এক নূতন বিশ্বায়নের সূত্রে বেধেছে আমাদের। এই বন্ধন সুখের নয়, অসুখের বিশ্বায়ন। আমোদ- প্রমোদ, জীবিকা, টাকাপয়সা ও মানব সম্পদের অবাধ বিশ্বময় যাতায়াতের মধ্য দিয়েই আমাদের এই জগৎ ‘উন্নয়নের ফানুসে’ উড়িতেছিল এতদিন। পুঁজিবিশ্বের দুরন্ত গতির এই কালোঘোড়ার চোখে লালপট্টি পরাইয়া দিয়েছে করোনা ভাইরাস। গোটা দুনিয়ার সীমান্তগুলি আটকাইয়া গিয়াছে। দুনিয়ার অংশ হিসাবে আমরাও বাঁধা পড়েছি এই দমবন্ধ জগতে।
জীবিকার সংস্থান না-থাকলে এমনিতেই না-খেয়ে মরে যাওয়া যেখানে নিয়তি সেখানে জীবন আর কোনো স্বতন্ত্র সত্তা নয়, বরং জীবিকার অধীন এক জৈবিক অস্তিত্ব। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে কেন্দ্র করে তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা খোলা-বন্ধ রাখাকে কেন্দ্র করে পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে সম্প্রতি যে ‘কানামাছি’ খেলা হয়েছে, তাতে জীবন-জীবিকার দ্বৈরথের ফলাফল হিসাবে এ সিদ্ধান্ত সহজেই অনুমান করা যায় যে, আগে জীবিকা পরে জীবন।
করোনা ভাইরাসের মহামারী ঠেকাতে সরকার কার্যত সবকিছু বন্ধ করার/রাখার ঘোষণা দিয়েছিল মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে; এবং বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের তরফ থেকে সেটাই কাম্য এবং করণীয় ছিল সে সময়ের প্রেক্ষাপটে। কাঁচাবাজার, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং ওষুধের দোকান ছাড়া সব ধরনের দোকানপাট, শপিংমল এবং মার্কেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। অফিস-আদালত, ব্যাংক-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে বা ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ চলেছে। সব ধরনের ফ্লাইট, ট্রেন, এবং গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল কিন্তুু তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যাপারে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে মালিকদের ওপর ছেড়ে দিলেন। আর মহামতি মালিকরা কায়মনোবাক্যে চেয়েছিলেন, সরকার নিজে থেকে কারখানাগুলো বন্ধ ঘোষণা করুক যাতে শ্রমিকদের বেতন দেয়ার দায়-দায়িত্বটি সরকারের ঘাড়ে ছেড়ে দেয়া যায়। সরকারও মালিকের চিকন চালাকি ঠাহর করতে পেরে নিজের ঘাড়ে না-নিয়ে মালিকের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিলেন। এভাবেই শুরু হলো, পোশাক শ্রমিকদের জীবনের চেয়ে তাদের জীবন ও মজুরি নিয়ে নানান হিসাব-নিকাশ।
২৪ মার্চ যখন সরকারিভাবে ১০ দিনের জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলো, তখন এদেশের শ্রমজীবী মানুষ দলে দলে গ্রামের বাড়িতে বা ‘দেশের বাড়িতে’ চলে গেছে। কিন্তুু সমস্ত গণপরিবহন ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ থাকলেও এসব শ্রমজীবী মানুষ কিভাবে ঢাকাসহ বড় বড় শহরে ফিরবে তা নিয়ে কারো কোন চিন্তা -ভাবনা নেই। এদিকে করোনা ভাইরাস থেকে নিজেকে, অন্যকে এবং দেশ রক্ষার জন্য ‘সামাজিক দূরত্ব’ বা কমপক্ষে তিন ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা চতুর্দিকে জোরেশোরে বলা হলেও, কিভাবে এ কথিত ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রেখে লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষ ঢাকাসহ বাংলাদেশের বড় শহরগুলোতে ফিরে আসবে তার কোনো দিকনির্দেশনা কোনো পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি।
ফলে, এসব শ্রমজীবী মানুষ দলে দলে ফেরি পার হয়ে, ছোট ছোট যানবাহনে করে, মাইলের পর মাইল হেঁটে ঢাকায় প্রবেশ করল এপ্রিলের ৪ তারিখ কারণ তাদেরকে ৫ তারিখ সকালে কারখানায় যোগদান করতে হবে। জীবিকার নিশ্চয়তা যে জীবনের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এসব শ্রমজীবী মানুষের কাছে, তাই নতুন করে প্রমানিত হলো।
তাই, গাদাগাদি করে তারা করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকিতে তোয়াক্কা না-করে ‘চাকরি’ বাঁচানোর জন্য ঢাকা শহরে প্রবেশ করে। কিন্তুু সদা মৃত্যুভয়ে ভীত মানসিকভাবে প্রায় পুরোটাই করোনাক্রান্ত আমাদের শহুরে-নাগরিক-মধ্যবিত্তের করোনাক্রমের শঙ্কা ও ঝুঁকির প্রবৃদ্ধি ঘটানোর কারণে এসব ‘ছোটলোকদের’ যতসব ‘ননসেন্স’ আচরণকে আমরা গালিগালাজ করে তুলাধোনা করলাম।
সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্ধ দিলেন দেশের অভাবী মানুষের খাদ্য সহায়তা তথা জীবিকা সহায়তার জন্য। আর এই সহায়তার পাবার জন্য কত ধনী মানুষকেও অভাবী সাজতে দেখলাম। কেউ কিছু না করলেও আমরা অনেক জনপ্রতিনিধিকে জেলে যেতে দেখলাম। কিসের দায়ে তারা গেলেন না দেশবাসী সবই জানে।
সমাজের একটি শ্রেণী কখনোই কারো কাছে হাত পাতে না। তারা দিন আনবে দিন খাবে, কারো কাছে আত্মসম্মান বিলি করে দিবে না। উৎকৃষ্ট ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই শ্রেণী। কিš‘ আজ তারা সবচেয়ে অসহায়। চারপাশে এত ত্রাণের ছড়াছড়ি গেল তবুও ঐ শ্রেণীটা আজও কারো কাছে না পারছে হাত পাততে, না পারছে ঘরে বসে থাকতে। এদিকে এমন দীর্ঘকালীন করোনা কালের প্রভাবে ঐ শ্রেণীর মূলধন বা মূল সম্পদে খুব ভালোভাবেই আঘাত করেছে।
এতকিছুর মধ্য দিয়ে জীবন কে পরিচালনা করলে জীবন দিন দিন আরো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে। পুরো জাতিকে গুনতে হবে বড় মাশুল। তার চাইতে জীবনকে পরিচালনা করা উচিত ডারউইনের থিউরির মধ্য দিয়ে। জীবন যুদ্ধ যারা বিজয়ী তারা টিকে থাকবে, অন্যরা হারিয়ে যাবে। অনেকটা অমানবিক মনে হচ্ছে তত্বটি কিন্ত কিছুই করার নেই এই মহুর্তে বিশ্ববাসীর। কেননা অদ্যাবধি কোন চিকিৎসা বা ভ্যাক্্িরন এর আশা অনেক দেশই দেখাচ্ছে কিšুÍ বাস্তবতায় কতখানি এগিয়েছে তা বিশ্ববাসী জানে। যেখানে ব্যক্তির জীবিকা নেই, সেখানে জীবনও থাকতে পারে না। বরং জীবিকা থাকলে জীবন থাকার সম্ভাবনা অধিক। এ আধার নিশ্চয় কেটে যাবে শীঘ্রই দেখা হবে সবুজ পৃথিবীতে। শ্রমজীবি মানুষ যারা নিরন্তর শুধু ছুটে চলে জীবিকার সন্ধানে তারাও একদিন মাথা উচু করে দাড়িয়ে বলবে জীবন থাকলে জীবিকা তাকবে অথবা জীবিকা থাকলে জীবন থাকবে………………………….
লেখক ঃ-মাসুদ আহমেদ, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত এবং সংবাদকর্মী।